বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর, সাফল্য ব্যর্থতা- কোন পাল্লা ভারী?
বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জনের ৫০ বছর- সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করছে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর সাথে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ যুক্ত হওয়ায় সমগ্র আয়োজনটি ভিন্ন মাত্রা পায়। বছরব্যাপি ছিল নানা আয়োজন। সমাপ্ত হল, ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের দুইদিনের উৎসবের মধ্য দিয়ে। স্বাধীনতার ৫০ বছর সংখ্যার হিসেবে অনেকটা সময়। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী যেমন উৎসবের তেমন একটু ফিরে দেখা, কেমন কাটলো এই ৫০ বছর?
অনেকে নানা আঙ্গিকে নানা বিশ্লেষণ সামনে আনছেন। আমরা কোথায় এগিয়েছি, কোথায় পিছিয়ে, তার অনেক খেরোখাতা আমাদের সামনে। ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও উন্নয়নের সংজ্ঞা ও পরিমাপ যন্ত্রগুলো নিত্য নতুন সূচকের সামনে দাঁড় করাচ্ছে। এখন আর 'এক থালা ভাত'কে খাদ্য বলা হয় না। খাদ্যকে এখন, পরিমাণগত, গুণগত (পুষ্টিমান) ও প্রাপ্যতা উভয় পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়। '৭১ সালে আমাদের ৮০ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে ছিল আর এখন ৮০ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার উপরে অবস্থান করে। গত ৫০ বছরে এই দারিদ্র্য পরিমাপের সূচকেরও ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে। সময়ের সাথে সাথে মানুষের চিন্তা, দৃষ্টিভঙ্গি, আকাঙ্ক্ষার পরিবর্তন ঘটে। সে কারণে যে কোনো তুলনামূলক আলোচনায় 'সময়' ও 'প্রেক্ষিত' গুরুত্বপূর্ণ।
এই ৫০ বছরে আমাদের অর্থনীতি ও আর্থিক সক্ষমতা এগিয়েছে অনেকটা। অনেকে এটাকে বিস্ময়কর বলে থাকেন। আমাদের জিডিপি'র আকার, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, মাথাপিছু আয়, বাৎসরিক বাজেটের পরিমাণ, চলমান উন্নয়ন প্রকল্প সমূহ, জিডিপি প্রবৃদ্ধির ধারাবাহিকতা, কোভিড অতিমারি মোকাবেলা, করোনা আক্রান্ত রোগীর ব্যবস্থাপনা, রপ্তানি আয় বৃদ্ধি, মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধি- এসবই জাতীয় আর্থিক সক্ষমতার লক্ষণ। আমরা তৈরি পোশাক রপ্তানিতে চীন ও ভিয়েতনামকে অতিক্রম করেছি।
আমাদের অর্থনীতির নেতিবাচক উপাদানের তালিকা আরো দীর্ঘ। আর্থিক খাতের অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি ও সুশাসনের ঘাটতির কথা অনেক পুরাতন। অর্থপাচার, তামাদি ব্যাংক ঋণ, পশ্চাৎপদ অর্থনৈতিক নীতি- কৌশল আর্থিক খাতের গতি সঞ্চারের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক। আমাদের জিডিপি- কর অনুপাত এখনও ১২/১৩ এর মধ্যে। বাংলাদেশ এখন অতিমাত্রায় ধন বৈষম্যের দেশ। গত ৫০ বছরে আমাদের সার্বভৌমত্ব দৃঢ়তা পেলেও গণতন্ত্র মজবুত অবস্থায় যেতে পারেনি। সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও দুর্নীতি দমনে আমরা পিছিয়ে। এগুলোর প্রভাব পড়ে আর্থিক খাত সহ অন্যান্য সেক্টরেও। সমাজে গণতন্ত্র, সুশাসন ও জবাবদিহিতার সংস্কৃতি কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে নেওয়া গেলে আমাদের আর্থিক অগ্রগতি জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পেতো তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
এতো কিছুর পরও বাংলাদেশ চলতি বছরে বন্ধুপ্রতীম প্রতিবেশি দেশ শ্রীলংকাকে ২০০ মিলিয়ন ডলার ঋণ সহায়তা দিয়েছে। বিশেষ ধরনের মুদ্রা বিনিময় ব্যবস্থা 'কারেন্সি সোয়াপ' এর মাধ্যমে এ ঋণ কার্যক্রম বাস্তবায়িত হবে। বাংলাদেশ থেকে প্রাপ্ত ডলারের বিপরীতে শ্রীলংকা তাদের মুদ্রায় ডলারের বিনিময় হার অনুযায়ী অর্থ একটি নির্দিষ্ট অ্যাকাউন্টে জামানত হিসাবে রাখবে। ঋণের মেয়াদান্তে শ্রীলংকা চাইলে তার নিজস্ব মুদ্রায় বাংলাদেশকে ঋণ পরিশোধ করতে পারবে। বাংলাদেশ- শ্রীলংকা দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের লেনদেনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ঐ মুদ্রা (শ্রীলংকান মুদ্রা) ব্যবহার করতে পারবে। এই একই পদ্ধতিতে চীনের সাথে শ্রীলংকার দ্বিপাক্ষিক সহায়তা আগে থেকেই চালু। শ্রীলংকার রাবার দিয়ে চীনের ঋণ পরিশোধ করার উদাহরণও আছে। ভারতের প্রায় ৪০০ কোটি ডলার শ্রীলংকার সাথে কারেন্সি সোয়াপের মাধ্যমে ঋণ সহায়তা বিদ্যমান।
আমাদের আর এক বন্ধু রাষ্ট্র মালদ্বীপ একই ধরনের ঋণ প্রস্তাব দিয়ে রেখেছে। বাংলাদেশ সম্মত হলে শ্রীলংকার মত তারাও বাংলাদেশ দেশ থেকে ঋণ সহায়তা পেতে চায়। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন মালদ্বীপ সফরে বিষয়টি চুড়ান্ত হতে পারে। এসবই আর্থিক সক্ষমতার ইঙ্গিত। বাংলাদেশের অর্থনীতি ভঙ্গুরতার মাপকাঠিতে উত্তীর্ণ। ঝুড়ির তলদেশ এখন বেশ মজবুত তা বিশ্ববাসী জানে। এগুলো সাফল্যের মুকুটে এক একটি পালক।
দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম দেশ শ্রীলংকার সাথে আমাদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক অনেক মিল রয়েছে। উভয় দেশ ব্রিটিশ উপনিবেশের অধীনে ছিল। আমাদের অল্প পরেই শ্রীলংকা ব্রিটিশদের উপনিবেশ মুক্ত হয় অর্থাৎ স্বাধীনতা লাভ করে, ১৯৪৮ সালে। ১৯৭২ সালে অফিসিয়ালি নাম পরিবর্তন করার পূর্ব পর্যন্ত শ্রীলংকাকে সিলন নামে ডাকা হতো। ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত শ্রীলংকার রাষ্ট্রভাষা ছিল ইংরেজি। এরপর সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর ভাষা সিংহলিকে রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দেওয়া হয়। শ্রীলংকার সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী সিংহলি যারা মোট জনসংখ্যার ৭৫ ভাগ।
প্রাচীনকাল থেকেই শ্রীলংকা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের তীর্থস্থান হিসেবে পরিচিত। দেশটির জনসংখ্যার ৭০ শতাংশ বৌদ্ধ, এরপর রয়েছে হিন্দু ১২.৬ শতাংশ ও মুসলমান ৯.৭ শতাংশ। দেশটি উত্তর পূর্বাঞ্চলে তামিল অধ্যুষিত এলাকা নিয়ে স্বাধীন হতে চেয়েছিল। মোট জনসংখ্যার ১২ শতাংশ মানুষ তামিলভাষী। তিন দশকের অধিক সময় ধরে চলা সশস্ত্র রক্তক্ষয়ী লড়াই ২০০৯ সালে এক সর্বাত্মক যুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন তামিল জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের পরিসমাপ্তি ঘটে।
চারদিক সমুদ্র দিয়ে ঘেরা দেশটির বর্তমান অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি পর্যটন, চা, কফি, নারিকেল, রাবার, গার্মেন্টস ও কৃষি। দেশটির মোট জিডিপি বা আভ্যন্তরীণ উৎপাদনের ৫৮ শতাংশ আসে সেবা খাত থেকে, ২৮ শতাংশ শিল্প থেকে ও ১২ শতাংশ আসে কৃষি থেকে। বাংলাদেশের অনেকটা কাছাকাছি। দেশটির জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৫.৫ থেকে ৬ এর মধ্যে উঠা নামা করছে কয়েক বছর ধরে। অথচ সেখানে এখন তিন মাসের আমদানি ব্যয় মিটানোর মত ডলার রাষ্ট্রের হাতে নেই। ডলার সংগ্রহ করার নানা পদক্ষেপ তেমন কাজে আসেনি। ডলারের মূল্য বেঁধে দিয়েছে সরকার কিন্তু তাতেও সাড়া মেলেনি।
আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে ঋণ নেওয়ার জন্য দেশটি প্রথমবারের মতো ৫০ কোটি ডলার সমমূল্যের সভ্রেইন বন্ড ছাড়ে এবং আস্তে আস্তে এই বন্ডের মাধ্যমে ঋণ নেওয়ার প্রতি ঝুঁকে পড়ে। স্বল্পমেয়াদি এই সব বন্ডের শর্ত বেশ কঠিন এবং সুদের হার ৬ শতাংশের উপরে। বন্ডের মাধ্যমে ঋণ নেওয়ার এই প্রবণতা দেশটিকে আরো ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেয়।
২০১৯-এ করোনা মহামারিতে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রধান খাত পর্যটন, তৈরি পোশাক, চা ও প্রবাসী রেমিটেন্স মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। করোনা মহামারির শুরুতে দেশটির বৈদেশিক মুদ্রার স্থিতি ৭ বিলিয়নের বেশি থাকা সত্ত্বেও এক বছরের মাথায় এসে দাঁড়ায়, তিন বিলিয়নে।
লকডাউনের সময় ২০২০ সালে শ্রীলংকার ৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন বা ৪৫০ কোটি ডলারের পর্যটন শিল্প সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয় এবং এর প্রভাব দেশটির মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির উপরেও পড়ে এবং দেশটির রপ্তানি কমে যায় ১৭ শতাংশ। দেশটি আমদানি নিষেধাজ্ঞা ও জ্বালানি সাশ্রয়সহ নানা উপায় অবলম্বন করছে এই সংকট মোকাবেলার জন্য।
অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা যদিও ভিন্ন কথা বলছেন। শ্রীলংকার চলমান সংকট অনিবার্য ছিল। করোনা পরিস্থিতি সংকটকে তরান্বিত করেছে মাত্র। চরম কর্তৃত্ববাদী সরকার তামিল সংকট সামরিক কায়দায় মোকাবেলা করলেও সেই এ্কই উপায়ে চলমান অর্থনৈতিক ও খাদ্যবাজার মোকাবেলায় ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্তাদের ওপরই নির্ভর করছে। একেক সেক্টর থেকে বেসামরিক প্রশাসন সরিয়ে সেনা কর্তাদের নিয়োগ দিচ্ছে সরকার।
দেশটির বর্তমান প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাক্ষে অতীতে সশস্ত্র বাহিনীতে কাজ করেছেন এবং ছিলেন প্রতিরক্ষাসচিবও। পরিস্থিতি মোকাবেলায় তিনি সামরিক বাহিনিকে যত বেশি রাস্তায় নামাচ্ছেন পরিস্থিতি ততবেশি নাজুক হয়ে উঠছে। অথচ সবাই জানে, এই সংকটের মূলে রয়েছে সরকার প্রধানের পরিবারের অনেককে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া। পারিবারিক শাসন সংস্কৃতি শ্রীলংকার সামগ্রিক শাসন ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে ফেলেছে। শাসন ব্যবস্থা থেকে সুশাসন বিদায় নিয়েছে অনেক আগেই এবং দুর্নীতি সমাজের গভীরে প্রবেশ করেছে।
দেশটির প্রেসিডেন্ট হঠাৎ ঘোষণা দিয়েছেন, কৃষিতে রাসায়নিক সার ব্যবহার চলবে না। অরগানিক কৃষি দিয়ে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিবেন। রাসায়নিক সারের বিকল্প জৈব সারের ব্যবস্থা না করেই সরকারের এই ঘোষণা কৃষিকে সীমাহীন সংকটের মধ্যে ফেলে দেওয়া হয়েছে। জগৎখ্যাত চা শিল্প হুমকির সম্মুখিন।
শ্রীলংকার বর্তমান অর্থনৈতিক সংকট আমাদের জন্য অনেকগুলো সর্তকবার্তা সামনে নিয়ে আসে। সর্বাগ্রে আর্থিক খাতের শৃংখলা, সুশাসন, আইনের কঠোর প্রয়োগ, অর্থপাচার রোধ জরুরি। রাজনৈতিক অঙ্গনেও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে ঐকমত্য প্রয়োজন। গণতন্ত্র শক্ত ভিতের উপর দাঁড়ালে সকল খাতে শৃংখলা প্রতিষ্ঠিত হয় এবং দুর্নীতি হ্রাস পায়। বিশ্বশ্রম বাজারের কথা মাথায় রেখে দক্ষ জনশক্তি তৈরি করতে হবে। বিদেশি শ্রম বাজার ও বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য সম্ভাব্য সব পথ অনুসরণ করতে হবে।
আমাদের রপ্তানি বাণিজ্যে তৈরি পোশাক দীর্ঘদিন ধরে শীর্ষস্থান দখল করে আছে। এই বাজার ধরে রাখা এবং বাজার সম্প্রসারণের উদ্যোগ অব্যাহত রাখতে হবে। অর্থনৈতিক ধারাবাহিকতার জন্য এই অতি সাধারণ ও প্রাথমিক এ কাজগুলো করা গেলে অর্থনীতির ভঙ্গুরতার পথগুলো বন্ধ করে দেওয়া সম্ভব হবে।