রায়বাবুদের বাড়ি যাই
(সত্যজিৎ রায়ের জন্মশতবার্ষিকীতে বাংলাদেশ থেকে প্রসূন রহমান নির্মাণ করছেন একটি ট্রিবিউট ফিল্ম, প্রিয় সত্যজিৎ নাম। ছবিটিতে দেখা যাবে সত্যজিৎকে নিয়ে একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করতে চান একজন নির্মাতা (মৌটুসী বিশ্বাস)। তাঁর তথ্যচিত্রের অভিনেতা হিসাবে বেছে নেন আসিফ মাহমুদকে (আহমেদ রুবেল), যিনি সত্যজিৎময় জীবন যাপন করেন। সত্যজিৎ রায়ের জন্মদিন ২ মে'তে ছবিটি মুক্তি পাবে। চলচ্চিত্রটির অভিনেত্রী মৌটুসি এ নিয়ে লিখেছেন তার অভিজ্ঞতা-অনুভূতির কথা।)
ছোটবেলায় একটা মোটা বইয়ের ওপর দাড়িওয়ালা এক লোকের ছবি দেখতাম। ছবির নিচে নাম লেখা, উপেন্দ্র কিশোর রায়চৌধুরী। আরেকটা বই এনেছিলেন বাবা, সেটা পথের পাঁচালী, ছোটদের মতো করে লেখা। তাতে অপু আর দুর্গার ছবিও ছিল। বাসায় বড়দের পথের পাঁচালীও ছিল। তবে সেটা বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের উপন্যাস সমগ্রের মধ্যে। আমার বাবা যিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলার অধ্যাপক ছিলেন বিভূতিভূষণের ওপর গবেষণা করেছেন। তাই দুই তিন বছর তিনি নিয়মিত বিভূতিবাবুর বাড়ি গিয়েছেন। বাবার ইচ্ছা ছিল অপুকে যিনি পর্দায় জীবন্ত করেছেন, তিনি চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় (১৯২১ থেকে ১৯৯২), তাঁর বাড়িও যাবেন। অনুরোধ করবেন গবেষণা পুস্তকের প্রচ্ছদ এঁকে দিতে। রায়বাবুর পুত্র সন্দ্বীপ রায় কথাও দিয়েছিলেন, হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরলে বাবাকে তিনি অনুরোধটি জানাবেন। এও বলেছিলেন, বাবা নিশ্চয় অনুরোধ রাখবেন। কিন্তু সত্যজিৎ রায় আর সেবার বাড়ি ফেরেননি। তিনি হাসপাতাল থেকেই না ফেরার দেশে চলে গিয়েছিলেন। এভাবেই অপু, পথের পাঁচালী আর রায় পরিবারের সঙ্গে সম্পক গাঁথা হলো।
এবারের দুর্গা পূজার আগে
প্রসূনদা মানে চলচ্চিত্র নির্মাতা প্রসূন রহমান দুর্গা পূজার আগে আগে মেসেনজারে একটি সিনপসিস (বই, নাটক বা চলচ্চিত্রের সারাংশ) পাঠালেন, সঙ্গে একটি টীকা বা নোট। জানতে চেয়েছেন, পড়ে যেন জানাই কেমন লাগল। পড়ে দেখলাম বেশ অন্যরকম একটি গল্প। বাস্তবের সঙ্গে অতীতের কয়টি চরিত্রকে জুড়তে চাইছেন তিনি। আর বুঝতে অসুবিধাও হলো না বর্তমানের সঙ্গে অতীতের সূত্রধর হিসেবে আমাকে চাইছেন। কথা বললাম প্রসূণদার সঙ্গে। রাজি কী আর না হই? তারপর পুরো দেড় মাস কাটালাম রায় বাবুর লেখা ও তাঁকে নিয়ে বিভিন্ন বই পড়ে। সেসঙ্গে চলচ্চিত্রগুলোও আবার দেখে নিলাম। পড়তে পড়তে সত্যজিৎ দাদা উপেন্দ্রকিশোরকেও আমি দেখতে পাচ্ছিলাম দিব্যচোখে। আর তাঁর স্ত্রী ভারতের প্রথম নারী চিকিৎসক কাদম্বিনী দেবীও মনে আসন গেড়েছিলেন। তাঁরা প্রথমে সংসার পাতেন কিশোরগঞ্জে। আমি ভাবলাম, এতো কাছে অথচ যাওয়া হয়নি কোনোদিন কিশোরগঞ্জের মসূয়ায়। শুটিং তো সেখানেই শুরু হবে। আমার চরিত্রটি একজন তথ্যচিত্র নির্মাতার যে কি না অনুসন্ধিৎসু।
আমিও গেলাম রেকিতে
সাধারণত পাত্র-পাত্রীরা রেকিতে (তথ্য অনুসন্ধানের নিমিত্তে নির্দিষ্ট স্থানে যাওয়া) যান না। ক্যামেরাপারসন, সহকারী পরিচালক প্রমুখদের নিয়ে রেকিতে যান পরিচালক। আমি প্রসূনদার কাছে জানতে চাইলাম, আমার যাওয়ার সুযোগ আছে কি না। তিনি খুশি হয়ে বললেন, রেকিতে আমি যা যা করব আপনি ছবিতে তাই তাই করবেন কিছু সংলাপ জুড়ে। তাই আপনি গেলে বেশ একটা কাজের কাজ হয়। আমরা ফিরেও আসব রাত হওয়ার আগে আগে। ভোর বেলাতেই আমি তৈরি। নির্দিষ্ট সময়ে যাত্রা হলো শুরু। কিশোরগঞ্জ সদর ছাড়িয়ে পরে মশুয়া। তারপর পেলাম একটা বিশাল মাঠ আর মাঠের ওপারেই সেই বাড়ি। আসলে তো ধ্বংসাবশেষ। ভাগ্য ভালো বলতে হয়, এখনো দখল হয়নি। বরং কিশোরগঞ্জবাসী রায়দের সম্মান জানিয়ে একটি সাইনবোর্ড টানিতে রেখেছে। আমার আনন্দ আর ধরে নাÑসত্যজিৎ রায়ের আদি বাড়ি! আহা! ঘুরে ঘুরে দেখলাম উপেন্দ্রকিশোর, সুকুমার, সত্যজিৎ হয়ে সন্দ্বীপ রায়ের বাড়ি। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে চারজন গুণী মানুষ এক পরিবারে সহজে মেলে না।
শুটিং শুরু হলে
আমার খুব আরাম হয়েছিল। আমি তো চরিত্র নিয়ে আগেই তৈরি হয়ে গিয়েছিলাম। সংলাপের মহড়াও দিয়ে ফেলেছি। তাই আয়েশেই শুটিং শুটিং করতে করতে কিশোরগঞ্জ পৌঁছালাম। মসূয়ার বাড়িটিও অনেক চেনা লাগছিল। তাই কোথাও থমকাতে হয়নি। রুবেল ভাইকে (অভিনেতা আহমেদ) ভালোভাবেই ঘুরে ঘুরে দেখাতে পেরেছিলাম, রায়েদের বাড়ি। অপরাজিতা (আমার চরিত্রের নাম) আর মৌটুসী মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল। আমার বারবারই মনে পড়ছিল, উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর 'যখন বড় হব' কবিতার দুটি পঙক্তি:
আমি তাই ভাবি বসে ছেলেবেলা কদিন রবে
শেষে যখন বড় হব তখন কিবা করব সবে।