চালক সংকটে ৫০ শতাংশ কমেছে পণ্যবাহী ট্রেন চলাচল, পোর্ট ইয়ার্ডে ওয়াগন জট
মাইলেজ ইস্যুতে রেলওয়ের রানিং স্টাফদের চলমান আন্দোলনে যাত্রীবাহী ট্রেনের পাশাপাশি এবার অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে পণ্য পরিবহনেও। চট্টগ্রাম গুডস পোর্ট ইয়ার্ড (সিজিপিওয়াই) থেকে গত শুক্রবার ছেড়ে যায়নি কোন পণ্যবাহী ট্রেন। চালক (লোকোমাস্টার) সংকটে যাত্রা বাতিল করা হয়েছে দুটি কন্টেইনার, একটি গম ও একটি তেলবাহীসহ চারটি ট্রেনের।
রেলের মাইলেজ সুবিধা পুনর্বহালের দাবিতে গত মঙ্গলবার (২৫ জানুয়ারি) থেকে ওভারটাইম ডিউটি করছেন না রেলের রানিং স্টাফরা। রেলওয়ের রানিং স্টাফদের ১০০ মাইলের বেশি অথবা ৮ ঘণ্টার অধিক সময় দায়িত্ব পালনের জন্য দৈনিক মূল বেতনের ৭৫ শতাংশের বেশি রানিং ভাতা প্রদান বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয় অর্থ মন্ত্রণালয়। এছাড়া পেনশন ও আনুতোষিক হিসাবের ক্ষেত্রেও একই নিয়ম বিবেচনা করা হবে। রেলের দেড়শ বছরের পুরনো স্বতন্ত্র বেতন-কাঠামো পুর্নবহালের দাবিতে আন্দোলনে নামে রানিং স্টাফরা। দাবি আদায় না হলে ৩১ জানুয়ারি থেকে কর্মবিরতি পালনের কথা রয়েছে। ফলে দেশের পুরো রেল যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
রেলওয়ে সূত্র জানিয়েছে, রেলওয়ে ট্রেন চালক থাকার কথা ১ হাজার ৭৮৬ জন। কিন্তু চালক রয়েছে মাত্র ১ হাজার ১৭ জন। এ কারণে টানা ট্রেন চালানোর পর বিশ্রাম না করে আবার কাজে যোগ দিতে হয় লোকমাস্টারদের। অতিরিক্ত ডিউটি (ওভারটাইম) না করায় চালক সংকটে দেশের বিভিন্ন জেলার অভ্যন্তরীণ গত পাঁচ দিনে অন্তত ১০০টি ট্রেনের যাত্রা বাতিল করা হয়েছে। এছাড়া অর্ধশতাধিক পণ্যবাহী ট্রেন যাত্রা বাতিল করা হয়েছে। চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশনের ম্যানেজার রতন কুমার চৌধুরী টিবিএসকে বলেন, গত ৫ দিন ধরে ১০টি ট্রেনের যাত্রা বাতিল করা হয়েছে।
এদিকে পণ্য পরিবহন থমকে থাকায় সিজিপিওয়াইয়ের সব রেল লাইনে সৃষ্টি হয়েছে জট। অন্যদিকে শুক্রবার রাতে দেশের বিভিন্ন রুট থেকে পণ্য আনলোডিং শেষে সিজিপিওয়াইতে ফেরতে আসে চারটি ট্রেন। ফলে পণ্যবোঝাই এবং ফিরতি ট্রেনের অবস্থানের কারণে পুরো সিজিপিওয়াই ওয়াগনভর্তি হয়ে গেছে। এমন অবস্থায় সিজিপিওয়াইতে ট্রেন চলাচলে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্টরা। দ্রুত পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে ট্রেনে পণ্য পরিবহন ব্যবস্থা স্থবির হয়ে পড়বে।
সিজিপিওয়াই এর প্রধান ইয়ার্ড মাস্টার আবদুল মালেক টিবিএসকে বলেন, রেলওয়ের এলএম এবং এএলএম সংকটে শুক্রবার শিডিউলে থাকা চারটি ট্রেন বাতিল করতে হয়েছে। এর মধ্যে ছিল চট্টগ্রাম বন্দরের আমদানি পণ্যবাহী দুটি কন্টেইনার ট্রেন। শুক্রবার বিকাল ৫টা ৩০ মিনিটে ৬০৩ আপ ট্রেন এবং রাত ১০টা ৩০ মিনিটে ৬০৫ আপ ট্রেন দুটি ঢাকা কমলাপুর আইসিডিতে যাওয়ার শিডিউল ছিলো। এছাড়া রাত ১১টা ৩০ মিনিটে গম নিয়ে আশুগঞ্জ যাওয়ার কথা থাকলেও সেটি বাতিল হয়ে যায়। সর্বশেষ রাত ২টায় তেলবাহী সিলেটগামী ট্রেনটির যাত্রা বাতিল হয়েছে।
তিনি আরো বলেন, শুক্রবার রাতে ঢাকা থেকে চারটি ট্রেন ইয়ার্ডে প্রবেশ করেছে। সিজিপিওয়াই এর সব লাইনে গাড়ি ব্লক হয়ে যাওয়ার উপক্রম ইয়ার্ডে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সিজিপিওয়াইয়ের কর্মকর্তা কর্মচারীদের হিমশিম খেতে হচ্ছে।
কন্টেইনারবাহী একটি ট্রেনে ৬০ টিইইউএস (টুয়েন্টি ফিট ইকুয়েভিলেন্ট ইউনিট) কন্টেইনার পরিবহন করা হয়। শুক্রবার শিডিউল বিপর্যয়ের কারণে ১২৪ টিইইউএস কন্টেইনার পরিবহন করা সম্ভব হয়নি।
সিজিপিওয়াই সূত্র জানিয়েছে, প্রতিদিন স্বাভাবিক সময়ে সিজিপিওয়াই থেকে ঢাকা, সিলেট সহ দেশের বিভিন্ন গন্তব্যে প্রায় ৮টি পণ্যবাহী ট্রেন চলাচল করতো। চালক সংকটের কারণে ৫০ শতাংশ কমিয়ে ট্রেনের সংখ্যা চারটিতে কমিয়ে আনা হয়েছে।
সিজিপিওয়াই থেকে শনিবার সকাল ১০টা এবং দুপুর সাড়ে ১২টায় ঢাকাগামী দুটি কন্টেইনারবাহী ট্রেন ছেড়ে যায়। এছাড়া বিকাল সাড়ে ৫টায় একটি তেলবাহী এবং সন্ধ্যা ৭টা ও রাত ১১টায় দুটি কন্টেইনার ট্রেনের শিডিউল ছিল।
এদিকে কন্টেইনারবাহী ট্রেনের যাত্রা বাতিলের কারণে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে রেলপথগামী কন্টেইনারের জটের আশংকা তৈরী হয়েছে। গন্তব্যে না যাওয়ার কারণে কন্টেইনার বোঝাইয়ের জন্য বন্দরে প্রবেশ করতে পারবেনা কোন ট্রেন। এতে ঢাকা আইসিডি থেকে আমদানিকারকরা সময়মতো পণ্য ডেলিভারি নিতে পারবে না বলে জানিয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর সূত্র।
চট্টগ্রাম বন্দরের টার্মিনাল ম্যানেজার কুদরত-ই-খুদা বলেন, একটি কন্টেইনার ট্রেনে ৬০ টিইইউএস কন্টেইনার লোড করা হয়। শুক্রবার ৪টি ট্রেনে কন্টেইনার লোড দেওয়া হয়েছিলো। বন্দর থেকে কন্টেইনার লোড করে সেগুলো সিজিপিওয়াইতে পাঠাতে হয়। এরপরের কাজ রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের। শনিবার দুপুর ১২টা ৪৫ মিনিট নাগাদ একটি ট্রেনে কন্টেইনার লোডিংয়ের কাজ চলছিলো। রেলযোগে কন্টেইনার পরিবহন বন্ধ হয়ে গেলে বন্দরেও এর প্রভাব পড়বে।
এদিকে আন্দোলন শুরু হওয়ার পর গত মঙ্গলবার আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে চেয়ে চিঠি দিয়েছিল রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। কিন্তু তা প্রত্যাখ্যান করেছিল রানিং স্টাফরা। রেলওয়ের একটি সূত্র জানিয়েছে, আগামী সোমবার আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে চেয়েছে রেল সচিব। এতে রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজনেরও থাকার কথা রয়েছে। তবে আলোচনাটি রোববারই করতে চাচ্ছে শ্রমিক নেতারা।
তবে এ বিষয়ে এখনো আনুষ্ঠানিক চিঠি দেওয়া হয়নি বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ রেলওয়ে রানিং স্টাফ ও শ্রমিক কর্মচারী পরিষদের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক মুজিবুর রহমান। টিবিএসকে তিনি বলেন, "আমরাও চাই না যে, ট্রেন বন্ধ থাকুক। রোববার রাত ১২টার পর থেকেই আমাদের কর্মবিরতি শুরু হবে। শুধু অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে বলে দিলেই হবে।"