ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে গুরুতর গম সংকটে মধ্যপ্রাচ্য
ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন ও এরপর রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর সংকটে পড়েছে ইউরোপিয়ান দেশগুলো, দীর্ঘদিন ধরেই তারা গ্যাসের জন্য রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীল। ইউক্রেন সংকটের কারণে জ্বালানি সম্পদের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি হয়েছে, বেড়ে গেছে তেল, গ্যাস, কয়লা ও অন্যান্য পণ্যের দাম।
কিন্তু, ইউক্রেনের যুদ্ধের প্রভাব শুধু জ্বালানি সরবরাহের ওপরেই পড়বে না। বৈশ্বিক খাদ্য নিরাপত্তাও ঝুঁকিতে আছে। বিশেষ করে, মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকান দেশগুলোতে (মেনা) গমের সাপ্লাই চেইন ব্যাহত হতে পারে।
চীন ও ভারতের পর সবচেয়ে বেশি গম রপ্তানি করে রাশিয়া, গম উৎপাদনে চীন ও ভারতের পরেই দেশটির অবস্থান। মধ্যপ্রাচ্যের মানুষ খাদ্যাভ্যাসের কারণে তাদের গম রপ্তানির ওপর অনেক বেশি নির্ভরশীল।
ইউক্রেন থেকে লেবানন তাদের ৬০ শতাংশ গম আমদানি করে। সবচেয়ে বেশি গম আমদানি করা দেশ মিশর, রাশিয়া আর ইউক্রেন থেকে ৭০ শতাংশ গম আমদানি করে। তুরস্কের ৫০ শতাংশ গম আমদানি এবং তিউনিসিয়ার ৮০ শতাংশ শস্যও আমদানি হয় এই দেশ দুটি থেকে।
সময়ের প্রশ্ন:
ইউক্রেনে গম উৎপাদন ও রপ্তানিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা কিছু অংশে বর্তমানে রাশিয়ান সৈন্যরা ঢুকে পড়েছে। ইউএস ডিপার্টমেন্ট অব এগ্রিকালচারের (ইউএসডিএ)তথ্য অনুসারে, ইউক্রেনের বেশিরভাগ গম উৎপাদিত হয় দেশটির দক্ষিণ-পূর্বে। কৃষ্ণসাগরে প্রবেশ বন্ধ করলে মেনা (মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা) অঞ্চলে গম সরবরাহ ব্যাহত হতে পারে।
ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (আইএফপিআরআই) এর একজন সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ডেভিড লেবোর্ড ডিডব্লিউকে বলেন, মেনা অঞ্চলের বেশিরভাগ রপ্তানিই সমুদ্রপথে হয়, তাই ইউক্রেনের গমের সরবরাহ চক্রের জন্য কৃষ্ণসাগর কৌশলগতভাবে অনেক গুরুত্ব রাখে।
"এখন যে গম বিক্রি হচ্ছে, তা ২০২১ সালের জুলাইয়ের ফসল। অর্থাৎ রাশিয়ার আক্রমণের আগে। ওই ফসলের চার ভাগের এক ভাগ বাকি আছে, কিন্তু বন্দরপথে চলাচল বন্ধ থাকায় মিশর ও লেবাননের মতো দেশগুলোতে ঘাটতি তৈরি হবে", বলেন লেবোর্ড।
এই যুদ্ধের কারণে মেনা অঞ্চলের খাদ্য নিরাপত্তা কতোটুকু ক্ষতিগ্রস্ত হবে তা নির্ভর করছে এই সংকট কতোদিন চলবে তার উপর।
এ বছরের জুলাইয়ের মধ্যে ইউক্রেনের কৃষকরা গম চাষ করে ফসল তুলতে না পারলে সরবরাহ চক্র ব্যাহত হবে। তবে, উৎপাদন হলেও তা বন্দরে পরিবহন করা যাবে এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই।
ইউক্রেন ও রাশিয়ার গমের ওপর নির্ভরশীলতা
মেনা অঞ্চলের দরিদ্র দেশগুলির জন্য বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়াতে পারে গমের বাজারমূল্য। রাশিয়ান বাহিনী ইউক্রেন আক্রমণ করার পর থেকে গমের দাম ইতোমধ্যে ৩৫ শতাংশ বেড়েছে।
লেবাননের অর্থমন্ত্রী আমিন সালাম রয়টার্স-কে জানিয়েছেন, নগদ অর্থ সংকটে থাকা দেশটিতে সর্বোচ্চ এক মাসের গমের মজুদ আছে, বিকল্প হিসেবে বিভিন্ন দেশের সাথে আমদানি চুক্তি করতে চাইছে দেশটি।
তুরস্ক বলছে, এখনই খাদ্যশস্য ঘাটতি তৈরি হবে না তাদের, গত বছরই এ বছরের জন্য প্রয়োজনীয় বেশিরভাগ শস্য আমদানি করা হয়ে গেছে। তবে দাম বাড়ায় দেশটি গম কেনা কমাতে শুরু করেছে।
গম আমদানি নিয়ে সরকারি কর্মকর্তাদের কোনো মন্তব্য করতে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে তিউনিসিয়ার সরকার, দেশটির গমের মজুদের প্রায় ৮০ শতাংশই আমদানি করা হয়।
শীর্ষ আমদানিকারক মিশরেরও এখনও গম মজুদ রয়েছে, তবে ইতোমধ্যে অন্যান্য দেশ থেকে বিকল্প খুঁজছে এ দেশটিও।
এই যুদ্ধকে ইয়েমেনের জন্য 'বিপর্যয়ের ঘণ্টা' হিসেবে অভিহিত করেছে, আমদানিকৃত খাদ্যশস্যের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল দেশটি।
মধ্যপ্রাচ্যে গম সরবরাহ বিশেষজ্ঞ ও কৃষি সরঞ্জাম বিক্রির লেবানন ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান এআইডিসিও এর প্রধান নির্বাহী (সিইও) মুনির খামিসের মতে, ইউক্রেন সংকটের প্রভাব পড়বে সমগ্র মেনা অঞ্চলের ওপর। তিনি ডয়েচে ভেলে-কে বলেন, সময় বেশি লাগায় এবং পরিবহন খরচ বেশি হওয়ায় উত্তর এবং দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলো থেকে গম ও অন্যান্য শস্য আমদানি বেশ ব্যয়বহুল।
"রোমানিয়া, রাশিয়া এবং ইউক্রেনের সীমানা কৃষ্ণ সাগর। তাই লেবানন এবং মেনা অঞ্চলের অন্যান্য দেশগুলোতে জাহাজ পাঠানো সহজ"।
যদিও এ অঞ্চলের দেশগুলো পশ্চিমা কোম্পানিগুলোর সঙ্গে বাণিজ্যের মাধ্যমে তাদের পণ্য আমদানিতে বৈচিত্র্য আনতে পারে, কিন্তু পরিবহনে বেশি সময় লাগায় বড় ঘাটতি তৈরি হবে। অঞ্চলটির কিছু দেশ নিজেরাই গম উৎপাদন করে, কিন্তু দেশীয় উৎপাদন সার্বিক চাহিদা মেটানোর জন্য যথেষ্ট না।
"লেবাননের শুধু বেকা উপতক্যাতেই গম চাষ হয়,", "এবং কৃষকরা শুধু শক্ত গম উৎপাদন করে, এটি দিয়ে রুটি বানানো যায় না"।
গম সংকটের প্রভাব
খাদ্য নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ লেবোর্ড ডয়েচে ভেলে-কে বলেন, মেনা অঞ্চলের অনেক দেশে ভর্তুকি থাকায় এখনই মানুষ গমের দাম বাড়তে থাকার বিষয়টি বুঝতে পারবে না। কিন্তু দেশগুলোর সরকার এক পর্যায়ে রেশন করা শুরু করতে পারে অথবা গম ব্যবহৃত পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিতে পারে। এরমধ্যে ইতোমধ্যে অর্থনৈতিক সংকটে ভোগা দেশগুলোতে সামাজিক অস্থিরতা তৈরি হতে পারে।
ইউক্রেন যুদ্ধের জন্য মিশর সবচেয়ে বেশি আশঙ্কার মুখে পড়লেও উত্তর আফ্রিকার দেশগুলোতেও বড় প্রভাব পড়তে পারে। ভূমধ্যসাগর দিয়ে দেশগুলো অন্যান্য দেশ থেকে খাদ্যশস্য আমদানির চেষ্টা করতে পারে। তবে এ ধরনেরও বিকল্প ব্যবস্থায়ও রাশিয়া আর ইউক্রেন থেকে আমদানি করা গমের চেয়ে কম চালান পাবে দেশগুলো।
রাশিয়ার ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার গমের বাজারে প্রভাব ফেলতে পারে কিনা এমন প্রশ্নের উত্তরে লেবোর্ড বলেন, এটি নির্ভর করছে কীভাবে নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়ন করা হবে এবং রাশিয়ান গম কোম্পানিগুলোর ওপর এর প্রভাব পড়বে কিনা তার উপর।
লেবোর্ড বলছে, বৈশ্বিক খাদ্য নিরাপত্তা এই সংকটের আগে থেকেই হুমকির মুখে ছিল।গত বছর পরপর অনেকগুলো সংকটের মুখে পড়েছে বিশ্ব। কোভিড-১৯ অতিমারি অনেক মানুষের জীবনে প্রভাব ফেলেছে, অনেকের আয় কমে গেছে, বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে।
"রাশিয়া-ইউক্রেন দ্বন্দ্ব বিষণ্ণ পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে, আমরা জানি না, এর পরের মৌসুমে গম রোপণ আর ফসল তোলা হবে কিনা। আরেকবার উৎপাদন আর বাণিজ্য বাধা মোকাবিলা করতে প্রস্তুত না বিশ্ব", বলেন তিনি।
সূত্র: ডয়েচে ভেলে