ফ্যাব-ইন্ডিয়া: ভারতের জনপ্রিয় পোশাক ব্র্যান্ড নিয়ে কেন মোদি সমর্থকদের মাথাব্যথা?
ভারতীয় পোশাকের অন্যতম সুপরিচিত রিটেইল ব্র্যান্ড ফ্যাবইন্ডিয়া। ব্র্যান্ডটিকে প্রায়ই ভারতের ডানপন্থীদের তোপের মুখে পড়তে দেখা যায়। কিন্তু জাতীয়তাবাদীরা কেন স্থানীয় ঐতিহ্যের ওপর গড়ে ওঠা পোশাক বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানের ওপর ক্ষিপ্ত?
গত অক্টোবরে একজন বলিউড চলচ্চিত্র নির্মাতা ভারতের সবচেয়ে বড় পোশাক ব্র্যান্ডটির ওপর চড়াও হন। দ্য কাশ্মীর ফাইলসের নির্মাতা বিবেক অগ্নিহোত্রী ক্ষমতাসীন দল ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) সমর্থক হিসেবে পরিচিত। ভারতের তাঁত ও হস্তশিল্পের বিভিন্ন পণ্যের সবচেয়ে বড় খুচরা বিক্রেতা ফ্যাবইন্ডিয়ার প্রতি তিনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
একই মাসে উর্দু ট্যাগলাইন "জশন-ই-রেওয়াজ" ব্যবহারের জন্য ডানপন্থী কট্টর হিন্দুত্ববাদী দলগুলোর তোপের মুখে দীপাবলির বিশেষ বিজ্ঞাপন প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয় ফ্যাবইন্ডিয়া।
পাঁচ থ্রেডের টুইটে অগ্নিহোত্রী লিখেন, ভারতের শ্যাম্পেনে চুমুক দেওয়া 'আনকালচারড' লিবারেল গোষ্ঠী ফ্যাবইন্ডিয়া পছন্দ করেন, যারা প্রধান বিরোধীদল কংগ্রেস ঘেষা। তিনি ছয় দশক পুরোনো প্রতিষ্ঠানটির যাত্রাকালীন বিদেশি মালিকানার বিষয়টি সামনে আনার সুযোগটিওহাত ছাড়া করেননি। ১৯৬০ সালে আমেরিকান ব্যবসায়ী জন বিসেল ফ্যাবইন্ডিয়া প্রতিষ্ঠা করেন। ফোর্ড ফাউন্ডেশনের সহায়তায় তিনি ভারতে আসেন।
ভারতের ১২৩টি শহরের ৩০০-র বেশি আউটলেট রয়েছে ফ্যাবইন্ডিয়ার। ভারতের বাইরেও তাদের আন্তর্জাতিকভাবে ১১টি আউটলেট রয়েছে। তবে অগ্নিহোত্রীই যে প্রথমবারের মতো ফ্যাবইন্ডিয়ার চড়াও হয়েছেন, তা নয়।
বেস্ট-সেলিং লেখক চেতন ভগত ২০১২ সালে এক টুইটে লিখেন, ফ্যাবইন্ডিয়া পরলেই আপনি বুদ্ধিজীবী হবেন না।
২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদির হিন্দু জাতীয়তাবাদী দল ক্ষমতায় আসার পর থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভারতের উদারপন্থীরা ক্রমাগত হয়রানির শিকার হয়ে আসছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো ভারতেও ডানপন্থীরা লিবারেলদের বিরুদ্ধে নেমেছে।
অন্যদিকে ফ্যাবইন্ডিয়ার এথনিক হাতে বোনা ও হ্যান্ড প্রিন্টের পোশাক পরা নিয়েও ঠাট্টা থেকে শুরু করে যোগাযোগমাধ্যমে বিদ্বেষপূর্ণ বক্তব্যও উঠে এসেছে। দেশজুড়ে যে বিভক্তি সেটিই প্রকট হয়ে ধরা দিয়েছে।
অগ্নিহোত্রী সরাসরি আক্রমণ করে টুইটে লিখেছিলেন, "ফ্যাবইন্ডিয়া যাদের জন্য পোশাক বিক্রি করে তারা সিউডো বা ছদ্মধারী মানুষ...ভারতীয় সংস্কৃতির সঙ্গে লেনদেন না থাকলেও তারা ভারতীয় সাজতে চায়"।
তবে বিষয়টিকে খোঁড়া যুক্তি বলে মনে করেন 'দ্য ফ্যাব্রিক অব আওয়ার লাইভস: দ্য স্টোরি অব ফ্যাবইন্ডিয়া'-র লেখিকা রাধিকা সিং। তিনি বলেন, "এটা ঠিক যে ফ্যাবইন্ডিয়ার যাত্রা অভিজাত ব্র্যান্ড হিসেবেই শুরু হয়েছিল। ১৯৬০ সালে রপ্তানি বাণিজ্য অংশ হিসেবে ফ্যাবইন্ডিয়া যাত্রা শুরু করে। তখন রপ্তানির উদ্দেশ্যে ঐতিহ্যবাহী পাটি তৈরির জন্য গ্রামের লোকেদের সঙ্গে চুক্তি করা হয়। যেসব পণ্য বাতিল হয়ে যেত সেগুলো দিল্লির ওয়্যারহাউজ থেকে ভারতীয়দের কাছে বিক্রি করা হতো। ১৯৭৪ সালে দিল্লিতে প্রথম দোকানটি চালু হয়।"
কিন্তু ৯০ এর দশকের শেষে ফ্যাবইন্ডিয়ার নাম ঘরে ঘরে উচ্চারিত হতে থাকে। সাংবাদিক সুনীল শেঠির ভাষায় 'মধ্যবিত্ত ভারতীয়দের সাজসজ্জা' কেমন হবে তা নির্ধারণ করতে শুরু করে ফ্যাবইন্ডিয়া।
স্থানীয় কারুশিল্প এবং ঐতিহ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ফ্যাবইন্ডিয়ার জামাকাপড় নকশা করা হতো। প্রতিষ্ঠানটি ভারতজুড়ে ৫৫ হাজারের বেশি কারিগরের সাহায্যে পোশাক তৈরির দাবি করে থাকে। প্রতিষ্ঠানটি নিয়ে গবেষণা করা ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞানী জেন লিঞ্চের মতে, "কয়েক দশক ধরে ডিজাইনার, ক্রেতা ও কারিগরদের সঙ্গে সম্মিলিত আলোচনার মাধ্যমে" ফ্যাবইন্ডিয়ার ভাবমূর্তি তৈরি হয়েছিল।
সরাসরি কারিগরদের সঙ্গে কাজ করা সামাজিক উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান বিন্দাস কালেক্টিভের সহ-প্রতিষ্ঠাতা মিতা মাস্তানির মতে, "ফ্যাবইন্ডিয়ার পোশাকগুলো সুতির, পরতে সহজ ও হালকা। তারা ঐতিহ্য ধারণ করার পাশাপাশি একইসঙ্গে অনন্য ও ভিন্নধর্মী।"
সময়ের সঙ্গে জনসাধারণের মাঝে ব্র্যান্ডটি সার্বিকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। জামাকাপড় ছাড়াও তারা এখন আসবাবপত্র, গৃহসজ্জা সামগ্রীসহ অরগানিক খাবারও বিক্রি করে থাকে। ফ্যাবইন্ডিয়া নিজেদের "ভারতে ঐতিহ্যবাহী কৌশল ও দক্ষতায় হাতে তৈরি পণ্যের সর্ববৃহৎ বেসরকারি প্ল্যাটফর্ম" হিসেবে দাবি করে থাকে। ভারতীয় প্রকাশনাগুলো এখন প্রতিষ্ঠানটিকে 'লাইফস্টাইল রিটেইল ব্র্যান্ড' হিসেবে বর্ণনা করে। দ্য ইকোনমিস্ট ম্যাগাজিন একবার তাদের অভিহিত করেছিল "অভিনব পোশাক ও কারুশিল্প নির্মাতা' হিসেবে।
ফ্যাবইন্ডিয়া নিয়ে গবেষণার সময় জেন লিঞ্চ দেখতে পান "ক্রেতারা প্রায়ই নিজেদের ফ্যাবইন্ডিয়া ব্যক্তিত্ব বলে দাবি করে। এমনকি জিজ্ঞেসও করেন, আপনি ফ্যাবইন্ডিয়ার একজন কি না"। ড. লিঞ্চের ভাষাত এটি 'কসমোপলিটান মধ্যবিত্তের পরিচিতি' বহনকারী হয়ে দাঁড়ায় যা দেশীয় কারিগর ও ঐতিহ্যের সঙ্গে সম্পর্কিত।
তবে স্থানীয় পোশাকের স্বনির্ভরতা থেকে স্বদেশি আন্দোলনে যে খাদির প্রবর্তন হয়েছিল তার সঙ্গে ফ্যাবইন্ডিয়া কখনোই নিজেদের এক করেনি। অগ্নিহোত্রীর ভাষায় 'আসল' মানুষগুলো ঠিকই আজও খাদি পড়েন আর যারা 'সিউডো' তারা ফ্যাবইন্ডিয়ার পোশাক পরে ঘুরেন।
তাহলে ফ্যাবইন্ডিয়া কীভাবে ভারতীয় সুশীলদের একটি বিষয় হয়ে উঠল? এবিষয়ে প্রতিষ্ঠানটি কোনো মন্তব্য করতে চায়নি।
ভারতের অন্যতম জনপ্রিয় লেখক শোভা দে বলেন, "আসলে ডানপন্থীদের মধ্যে ক্ষোভ জাগানো মোটেও কঠিন বিষয় নয়। ফ্যাবইন্ডিয়ার সঙ্গে অভিজাত ট্যাগ থাকায় বিষয়টি একটু জটিল। তাছাড়া মালিকানার বিষয়টিও ভূমিকা রাখে। এটা এমন একটি ব্র্যান্ড যা বহিরাগতদের হাত ধরে গড়ে উঠে তাদের মাধ্যমে পরিচালিত হয়েছে। তাহলে কি এই ব্র্যান্ড সত্যিই 'আমাদের' প্রতিনিধিত্ব করে?"
শোভা দে-র মতে, "ফ্যাবইন্ডিয়া ঝোলাব্যাগ নিয়ে ঘোরা (ঝোলাওয়ালা) হিলজুতা পরা মানুষদের ব্র্যান্ড। এই মানুষরা দেশীয় পোশাক পরেই আধুনিক ও সময়োপযুগী সেজে থাকতে চায়, যেগুলো আবার দামিও হবে। (ভারতের সমাজকর্মীরা যারা সস্তা কাপড়ের ব্যাগ কাঁধে নিয়ে ঘুরে তাদের খাটো করে এই ঝোলাওয়ালা ডাকা হয় দীর্ঘদিন ধরেই)।
"ফ্যাবইন্ডিয়া উন্নাসিকতার বিরোধিতা করে। তারা সাধারণ একটা চেহারায় হাজির হতে চায়, কিন্তু স্টাইলের সঙ্গে!"-বলেন তিনি।
কলাম লেখক সন্তোষ দেশাই বলেন, "অন্যভাবে বলতে গেলে ফ্যাবইন্ডিয়ার জামাকাপড় আধুনিক পুঁজিবাদী ব্যবস্থা এবং ঝোলাওয়ালাদের মতাদর্শের মধ্যবর্তী এক সামঞ্জস্যপূর্ণ অবস্থান তৈরি করে"।
আর তাই বলা হয় "ফ্যাবইন্ডিয়ার সঙ্গে জড়িত মানুষরা এক ধরনের মিশ্রধারার অ্যাক্টিভিজমে বিশ্বাসী যারা মূল মতাদর্শের সঙ্গে যুক্ত থাকতে চাইলেও মূলত বিচ্ছিন্ন"।
লন্ডনের ইউনিভার্সিটি কলেজের সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক সঞ্জয় শ্রীবাস্তব বলেন, "ফ্যাবইন্ডিয়া একটি কারুশিল্প আন্দোলনের প্রতিনিধিত্ব করে যা কংগ্রেস পার্টির ক্ষমতার থাকাকালে পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছিল" এবং "মূলত সমাজবিজ্ঞান ও মানবিক বিষয়ে অ্যাকাডেমিকভাবে জড়িত যারা মোদির সমালোচনা করে, তারাই সাধারণত এই পোশাকগুলো পরে থাকেন।"
"সুতরাং ফ্যাবইন্ডিয়া হলো মধ্যবিত্ত বয়স্ক শ্রেণি সম্পর্কিত ব্র্যান্ড যারা সংকর ভারতীয় ধারণা পোষণ করে। কিন্তু তারা অর্থনৈতিকভাবে পুরোপুরি অভিজাত নয়। তাদের পণ্যগুলো মেট্রোপলিটান সাংস্কৃতিক আভিজাত্য ধরে রাখে। এদিকে ভারতে মেট্রোপলিটন নয় এমন শহরগুলোও দিন দিন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। সেখান থেকে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ চাকরির সন্ধানে বড় বড় শহরে আসছে। এছাড়া সম্প্রতি বিজেপির একটি বড় সমর্থক গড়ে উঠছে। সম্ভবত এ কারণেই ফ্যাবইন্ডিয়াও আক্রমণের প্রতীকী লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে," বলেন অধ্যাপক শ্রীবাস্তব।
কিন্তু তারপরও ফ্যাবইন্ডিয়ার পোশাক পরা সবাইকে মোদির দল ও আদর্শের বিরোধিতাকারী হিসেবে চিহ্নিত করার বিষয়টি পুরোপুরি পরিষ্কার হয় না। ড. লিঞ্চের মতে, "এই দোকানগুলোতে যারা কেনাকাটা করে তাদের রাজনৈতিক বা নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি একই ধরনের বা সুনির্দিষ্ট নয়। বিভিন্ন জায়গার মানুষ এখানে কেনাকাটা করতে আসে।"
অনেকে অবাক হয়ে বলেন মোদি সমর্থকরা কেন এমন একটি প্রতিষ্ঠানকে আক্রমণ করছে যারা কি না দূর-দূরান্তের বিভিন্ন গ্রামের হাজার হাজার কারিগরদের তৈরি পণ্য নিয়ে কাজ করে। অথচ মোদি নিজেই 'মেক ইন ইন্ডিয়া'-কে শিল্প পরিকল্পনার ভিত্তিমূল নির্ধারণ করেছেন।
এদিকে চলতি বছরের শেষ দিকে পুঁজি বাজারেও আত্মপ্রকাশ করতে চলেছে ফ্যাবইন্ডিয়া। তখন প্রতিষ্ঠানটি সাত লাখের বেশি শেয়ার কারিগর ও কৃষকদের উপহার দেওয়ার পরিকল্পনা করছে।
"এটি এমন একটি ব্র্যান্ড যা সবার জন্য। কিন্তু যারা সহজে আপোষ করেন না, এখানকার জামাকাপড় তাদেরই নির্ধারিত পোশাকে পরিণত হয়েছে। আর তাই তারা উদারপন্থীদের জন্য ফেলা টোপের সহজ লক্ষ্যবস্তু হয়ে উঠছে," বলেন সন্তোষ দেশাই।
- সূত্র: বিবিসি থেকে অনূদিত