স্মরণ: সৈয়দ মুজতবা আলীর আফগানিস্তান সফর
গাজী আমানুল্লাহ খান ১৯১৯ থেকে ১৯২৯ পর্যন্ত সার্বভৌম আফগানিস্তানের আমির ও বাদশাহ ছিলেন। ১৯২৯ সালের ১৪ জানুয়ারি হাবিবুল্লাহ খানখানি ওরফে বাচ্চা সাকাও নামের এক দুধর্ষ ডাকাতের অভ্যুত্থানে ক্ষমতা ত্যাগ করে দেশ ছাড়তে বাধ্য হন। পুনরায় সসৈন্যে আফগানিস্তানে প্রবেশ করলেও সিংহাসন পুনরুদ্ধার করতে পারেননি। ২৩ মে ১৯২৯ তিনি চিরদিনের মতো আফগানিস্তান ত্যাগ করেন এবং ইতালিতে রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়ে বাকি জীবন কাটিয়ে দেন। ১ জুন ১৮৯২ তাঁর জন্ম কাবুলের কাছে পাগামানে, মৃত্যু ২৫ এপ্রিল ১৯৬০ ইতালিতে (কারও মতে সুইজারল্যান্ডের জুরিখে) রাষ্ট্রহীন শরণার্থী হিসেবে।
সৈয়দ মুজতবা আলীর 'দেশে বিদেশে'তে আমানুল্লাহ ও বাচ্চা সাকাওর কালের জীবন্ত বর্ণনা রয়েছে। পরবর্তীকালে আনিস সিদ্দিকী আমানুল্লাহর জীবনভিত্তিক 'হতভাগ্য বাদশাহ আমানুল্লাহ' নামের একটি গ্রন্থ রচনা করেছেন। এই দুটি গ্রন্থ, মাই লাইফ: ফ্রম ব্রিগ্যান্ড টু কিং: অটোবায়োগ্রাফি অব আমির হাবিবুল্লাহ এবং আফগানিস্তান বিষয়ক বিভিন্ন রচনা অবলম্বনে ১৯২৯-এর আফগানিস্তান এবং সৈয়দ মুজতবা আলী যখন আফগানিস্তানে ছিলেন সেসব নিয়েই এই লেখা। এতে সে সময়কার কিছু ঘটনার সঙ্গে আসবেন একদা আফগানিস্তানের জনপ্রিয় বাদশাহ আমানুল্লাহও।
সৈয়দ মুজতবা আলী বাদশাহ আমানুল্লাহর আধুনিক আফগানিস্তান নির্মাণে সহযোগিতার আহ্বানে সাড়া দিয়ে ইংরেজি এবং ফার্সি ভাষার শিক্ষক হিসেবে আফগানিস্তানে আসেন। থাকার বাসা পেলেন কাবুলের দূরে খাজামুল্লাহ গ্রামে। সে গ্রাম আর তার চারপাশের প্রকৃতির বৈভব সৈয়দ মুজতবা আলী তুলে ধরেছেন, নবম ও দশম শ্রেণিতে আমরা যারা দেশে বিদেশের অংশবিশেষ পড়েছি সেখানে, সেই তখন থেকে আফগানিস্তান স্থায়ী স্থান নিয়ে আমাদের মনে অবস্থান করছে। এই দেশ যে বহু সাম্রাজ্যের সমাধিস্থল, তা কল্পনায় আসে না- যদিও তিন দশকে পৃথিবীর দুই পরাশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই দেশ দখল করতে গিয়ে নিদারুণভাবে পরাজয় মেনে লোটা-কম্বল নিয়ে বিদায় নিতে হয়েছে।
আফগানিস্তান বরফ সেভ ইন পানশির
সৈয়দ মুজতবা আলীর আফগান পরিচালক হবফুন মৌলা আবদুর রহমান সকল কাজের কাজি। তার বর্ণনা অনুসরণ করে সব ধরনের তুষারপাত তিনি দেখলেন- কখনো পেঁজা পেঁজা তুলোর মতো কখনো গাদা গাদা, কখনো ঘূর্ণিবায়ুর চক্কর খেয়ে দশদিক অন্ধকার করে নেমে আসে- কিন্তু তারপরও এ বরফ সে বরফ নয়, আবদুর রহমানের আর্তস্বর : 'না হুজুর, কাবুলের এ বরফ ঠিক বরফ নয়। এ শহুরে বরফ বাবুয়ানি বরফ। সত্যিকার খাটি বরফ পড়ে পানশিরে। চেয়ে দেখুন বরফের চাপে এখনো গেট বন্ধ হয়নি। মানুষ এখনো দিব্যি চলাফেরা করছে, ফেঁসে যাচ্ছে না।'
সৈয়দ মুজতবা আলীকে বোকা পেয়ে কোনো আফগান না আবার তাঁকে ভেজাল বরফের গছিয়ে দেয়, এ আশঙ্কা তাঁর- 'নিতান্তই যদি কিনতে হয় তবে যেন আমি কিনি আসল, খাটি মাল, মেড ইন পানশির। ২০২১-এর তালেবানরা গোটা আফগানিস্তান মুঠোর মধ্যে নিয়ে এলেও আবদুর রহমানের সুপারিশ করা পানশিশের পতন হল সবে। তালেবানরা মাত্র কদিন আগে পানশির তাদের দখলে নিতে পারল। কুড়ি বছর আগেও পানসির ছিল অজেয়।
বাদশাহ আমানুল্লাহ ইউরোপ সফর শেষে ফেরার সময় নিয়ে এলেন দামি আসবাব, অগুনিত মোটর গাড়ি আর বক্তৃতা দেওয়ার বদঅভ্যাস, তাও আবার 'শির পীড়াদায়ক' রাজনৈতিক বিষয় তার সব বক্তৃতার বিষয়। এরকম জনশ্রুতি আছে পরপর তিন দিনে নাকি তিনি একত্রে ত্রিশ ঘণ্টা বক্তৃতা দিয়েছিলেন।
কিন্তু তত দিনে ধর্মীয় উগ্রবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। তাঁর নামের সঙ্গে অর্থাৎ বায়োডাটায় কাফের সংযুক্ত করে দিয়েছে তারা- কাফের আমানুল্লাহ। তারা তাকে উন্মাদ অ্যাখ্যা দিল, তাঁর স্ত্রী সুরাইয়াকে বলল, বেকারিয়তি নারী- একালের ভাষায় যৌনকর্মী। কিন্তু তিনি জানেন, সংস্কার করতে গেলে অনেক প্রতিকূলতার মুখোমুখি হতে হবে। তিনি তাঁর বক্তৃতায় বললেন, 'ধর্ম ঠুনকো জিনিস নয়। অন্ধবিশ্বাস আর গোড়ামির স্থান ইসলামে নেই। রোগে উপযুক্ত চিকিৎসা করাতে ইসলাম নিষেধ করেনি। বরং সুযোগ থাকতে রোগভোগে পাপ আছে। খোদার সৃষ্টির আধুনিক সুযোগ গ্রহণ না করা অন্যায়। ধর্মকে জানুন। ধর্মের অনুশাসন মেনে চলুন। আধুনিক পদ্ধতির চিকিৎসা গ্রহণ করুন। লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে আমি দাতব্য চিকিৎসালয় ও স্বাস্থ্যকেন্দ্র গড়ে তুলেছি। সেখানে শরিয়তবিরুদ্ধ কিছু করা হয় না। মহিলা রোগীদের জন্য বর্তমানে কিছুসংখ্যক পুরুষ ডাক্তার নিয়োগ করা হলেও অদূর ভবিষ্যতে এ নিয়মের অবসান হবে। আমি যে ৫০টি মেয়েকে ডাক্তারি পড়ার জন্য তুরস্কে পাঠিয়েছি, তারা দেশে ফিরে মায়ের জাতিকে সেবা করার দায়িত্ব নেবে। আপনাদের ধৈর্য ধরতে হবে। আমি অনৈসলামিক কাজ করছি বলে নাকি আমার বিরুদ্ধে মসজিদে মসজিদে প্রচার করা হচ্ছে। সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা চলছে। এসব শুনে মনে বড় ব্যথা পেয়েছি। কারণ, এশিয়া-আফ্রিকার সব জায়গায় সভ্যতার আলো প্রবেশ করেছে। বর্বর যুগের অবসান ঘটেছে। চারিদিকে মানুষ জেগে উঠেছে। আফগানিস্তানও পিছিয়ে থাকতে পারে না। আমি চাই, আপনারাও জেগে উঠুন।' (হতভাগ্য বাদশাহ আমানুল্লাহ আনিস সিদ্দিকী)।
তাঁর সংস্কার চিন্তা ও উদ্যোগের সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে। পশ্চিমের পত্র-পত্রিকা তাঁর প্রশংসায় পঞ্চমুখ। ১৯২৭-এর ডিসেম্বরে তিনি যখন ভারত সফরে এলেন, বোম্বে শহরে তাঁকে সংবর্ধিত করতে সমবেত হলো কস্তরী বাই গান্ধী, সরোজিনী নাইডু, অ্যানি বেসান্ত, আলী ভ্রাতৃদ্বয়, হাকিম আজমল- সাথে ভারত সরকার তো আছেই।
যখন বিশ্ব তাঁকে আফগানদের মুক্তিদাতা হিসেবে চিহ্নিত করেছে, তখন তাঁরই ধর্মান্ধ স্বদেশি নেতৃবৃন্দ তাঁর বিরুদ্ধে ধর্মদ্রোহিতা ও বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগ ছড়িয়ে দিচ্ছেন।
আমানুল্লাহ বড্ড তাড়াহুড়ো করে ফেলেছিলেন। কামাল আতাতুর্ককেও এরকম অবস্থা মোকাবিলা করতে হয়েছে, কিন্তু তাঁর হাতে ছিল তরুণ তুর্কি, তাঁর ছিল শক্তিশালী রাজনৈতিক সংগঠন। কিন্তু আমানুল্লাহ সেরকম যথেষ্ট সমর্থন আদায় করতে পারেননি। মোল্লারা যখন আমানুল্লাহর বিরুদ্ধে সংগঠিত হলো, কার্যত তাঁর নিজস্ব সেনাবাহিনীও ভড়কে গেল।
সৈয়দ মুজতবা আলী ১৯২৭ থেকে ১৯২৯ আমানুল্লাহর পতন পর্যন্ত আফগানিস্তানে ছিলেন। বছরের শেষ দিকে তিনি হামবোল্ডট বৃত্তি নিয়ে বার্লিন ও বন বিশ^বিদ্যালয়ে পড়াশোনার উদ্দেশ্যে আফগানিস্তান ছাড়লেন। ১৯৩২ বন বিশ^বিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট করলেন। লক্ষণীয় জার্মানির সে সময়টা ছিল হিটলারের উত্থান পর্ব। মুজতবা আলী তাঁকে নিয়েও একটি গ্রন্থ রচনা করেছেন।
ধর্মীয় গোড়াবাদী গোষ্ঠীগুলো আমানুল্লাহকে উৎখাতের প্রশ্নে ঐক্যবদ্ধ হলো। নেতৃত্বে থাকলেন করন আলী শাহ। বাদশাহর পরিবার থেকেও উসকানি দেওয়া হলো। শোর বাজারের বীর কুহিস্তান পার্বত্য এলাকার ভয়ংকর ডাকাত বাচ্চা সাকাওর সাহায্য কামনা করলেন। এই ডাকাতের বিরুদ্ধে একাধিকবার সরকারি বাহিনীর অভিযান পরিচালিত হলেও তাঁকে কেউ স্পর্শও করতে পারেনি। আমানুল্লাহর মস্তকের ঘোষণা করলেন এক হাজার টাকা। আমানুল্লাহ ইউরোপ বিজয় করে গণতন্ত্র ও আধুনিকতার আরও মূলমন্ত্র ও সংস্কারের ধারণা নিয়ে যখন ফিরলেন, শোর বাজারের পীর তাঁকে কাফের ফতোয়া দিয়ে তাঁকে উৎখাত করার জন্য 'কথিত' ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের আহ্বান জানালেন এবং জানিয়ে দিলেন- এটাই হবে সওয়াবের কাজ।
মোল্লাদের বাহিনী চারদিক থেকে কাবুল ঘিরে ফেলেছে। বিচলিত বাদশাহ শান্তি প্রস্তাব দিয়ে মিশন পাঠালেন। বিদ্রোহীরা জানাল, তাদের ১৮ দফা বাস্তবায়ন করলে তারা শান্তি ও সমঝোতা প্রস্তাবে রাজি। এগুলোর মধ্যে ছিল : অধিকাংশ আলেম প্রতিনিধি নিয়ে বাদশাহের পরিষদ গঠন করতে হবে; ধর্মীয়, রাষ্ট্রীয় ও সামরিক বিষয়ে বাদশাহ তাদের মতামত শুনতে বাধ্য থাকবেন; বেপর্দা করে যে মেয়েদের ডাক্তারি পড়তে তুরস্ক পাঠানো হয়েছে, তাঁদের ফিরিয়ে আনতে হবে; আফগানদের অবশ্যই আফগানি পোশাক পরতে হবে; পর্দার নতুন আইন বাতিল করে নারীর জন্য পর্দা পুনর্বহাল করতে হবে; গার্লস স্কুল বন্ধ করে দিতে হবে; পীররা অবাধে ধর্ম প্রচার করবে; শুক্রবার সাপ্তাহিক ছুটি ঘোষিত হতে হবে।
বিপন্ন আমানুল্লাহ দেখলেন তাঁর পেছনের সমর্থন ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে। তিনি দাবি মেনে নিলেন। তারপর তাঁকে বলা হলো স্ত্রী সুরাইয়াকে তালাক দিতে হবে। তিনি সম্মত হলেন না। এর মধ্যে বিদ্রোহীরা আক্রমণ চালিয়ে আফগান সরকারি বাহিনীকে কোণঠাসা করল। আমানুল্লাহ ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। বাচ্চা সাকাও তাঁর বাহিনী নিয়ে ঢোল বাজিয়ে ঘোষণা দিলেন দাড়ির বদলে যিনি গোঁফ রেখেছেন, তাঁর সাথে সন্ধি হতে পারে না। ধর্মীয় নেতারা বিব্রতকর অবস্থায় পড়লেন। বাচ্চা সাকাও ঘোষণা করলেন, তাঁর দাড়ি আছে, তাঁর মাথায় পাগড়ি আছে। তিনি নামাজ পড়েন, স্কুল-কলেজ সব বন্ধ করে দেবেন, মেয়েদের বোরকা পরতে বাধ্য করবেন। সুতরাং তাঁকেই বাদশাহ স্বীকার করতে হবে।
বৈমাত্রেয় ভাই ইনায়েতুল্লাহর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে আমানুল্লাহ দেশ ছাড়লেন। এবার ডাকাতের সামনে অসহায় হয়ে পড়লেন ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ। তাঁর বিরুদ্ধাচারী বহু মানুষকে হত্যা করে ক্ষমতা সংহত করলেন বাচ্চায়ে সকান্ত। তাঁর ৯ মাসের শাসনে ১৭ জানুয়ারি থেকে ১৩ অক্টোবর ১৯২৯ একটি দেশও বাচ্চায়ে সকান্তর সরকারকে স্বীকৃতি দেয়নি।
বাচ্চায়ে সকাওর বাহিনী যখন কাবুলে ঢুকছে, সৈয়দ মুজতবা আলী তখন সেখানেই-'এমন করে গুড়ুম করে রাইফেলের শব্দ হলো। লক্ষ করলেন শব্দটা শহরের উত্তর দিক থেকে এল। সঙ্গে সঙ্গে দিগ্বিদিকজ্ঞানশূন্য জনতা যেন বদ্ধ উন্মাদ হয়ে গেল। আমি কোনো গতিকে রাস্তা থেকে নেমে নয়ানজুলি পেরিয়ে এক দোকানের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালুম। স্থির করলুম, বিদ্রোহ বিপ্লবের সময় পাগলা ঘোড়ার চোট খেয়ে অথবা ভিড়ের চাপে দম বন্ধ হয়ে মরব না; মরতে হয় মরব আমার হিস্যার গুলি খেয়ে।'
আমানুল্লাহ তাঁর বাহিনীর জন্য কামান-বন্দুক কত কিছু এনেছিলেন, এসব যন্ত্র চালাবার যাঁরা কারিগর তাঁদের বাদশাহের জন্য কী এমন ঠেকা? কেন তাঁরা মোল্লাদের বিরাগভাজন হবেন, কেনই বা ডাকাতের গুলি খেতে যাবেন।
২০২১-এর আগস্টে আফগান সৈন্যরা একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি করল। মুজতবা আলী লিখেছেন যে বাদশাহের বিস্তর মোটরগাড়ি বাচ্চার সঙ্গী-সাথিরা চড়ে তিন দিনের মধ্যে শহরের সব পেট্রল পুড়িয়ে ফেলল। শহরের সর্বত্র এখন দামি দামি মোটর পড়ে আছে, যেখানে যে গাড়ির পেট্রল শেষ হয়েছে বাচ্চারা, ইয়াররা সেখানেই সে গাড়ি ফেলে চলে গিয়েছে। জানালার কাচ পর্যন্ত তুলে যায়নি বলে গাড়িতে বৃষ্টি, বরফ ঢুকছে। পাড়ার ছেলেপিলেরা গাড়ি নিয়ে ধাক্কাধাক্কি করাতে দু-একটা নর্দমায় কাত হয়ে পড়ে আছে। আমানুউল্লাহ নেইÑতবু ফী আমানিল্লা।'
এত দিন যাঁরা ফতোয়া দিয়ে আমানুল্লাহকে খারিজ দিয়েছিলেন, ডাকাত শাসকের অত্যাচারে তাঁরাই কামনা করলেন আমানুল্লাহ নেতৃত্ব দিয়ে যেন ডাকাত নিধন করেন। কিন্তু বিতাড়িত আমানুল্লাহ সাড়া দিলেন না। সাড়া দিলেন আমানুল্লাহর প্রধান সেনাপতি নাদির খান। ১৫ অক্টোবর ১৯২৯ থেকে ৮ নভেম্বর ১৯৩৩ আফগানিস্তান রাজত্ব করেছেন। তারপর ১৭ জুলাই ১৯৭৩ পর্যন্ত ৩০ বছর শাসন করছেন তাঁর পুত্র জহির শাহ। তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করেন দাউদ খান। ১৯৭৮ সালে এক অভ্যুত্থানে তিনিও সপরিবার নিহত হন। তারপর আফগানিস্তানে আর স্থিতিশীলতা আসেনি।
বাচ্চা সাকাও মানে ভিস্তিওয়ালার পুত্র। তাঁর পুরো নাম হাবিবুল্লাহ কালাকালি (১৮৯০/৯১-১ নভেম্বর ১৯২৯)। তাজিক বংশোদ্ভূত, কাবুলের উত্তরে কালকানে জন্ম। আমানুল্লাহকে হটিয়ে ১৭ জানুয়ারি তিনি আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখল করে ৯ মাস ক্ষমতা আকড়ে থাকার পর নাদির শাহর বাহিনীর হাতে পরাস্ত ও ধৃত হন। নাদির শাহ তাঁকে ক্ষমা করে দিতে চেয়েছিলেন কিন্তু তাঁর অনুগত গোত্রপতিদের চাপে ১ নভেম্বর ১৯২৯ সালে তাঁকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করেন। বাচ্চা সাকাও মৃত্যুর পূর্বক্ষণে বলেছেন, আল্লাহর কাছে চাওয়ার মতো আমার কিছু নেই। আমি যা চেয়েছি, তিনি আমাকে সব দিয়েছেন। তিনি আমাকে বাদশাহ বানিয়েছেন। '৮৭ বছর অজ্ঞাত স্থানে সমাহিত থাকার পর ২০১৬ সালে তাঁকে ধর্মপ্রাণ মুসলমান আখ্যা নিয়ে প্রবল বিতর্কের মুখে সাহারা হিলের পাদদেশে পুনরায় সমাহিত করা হয়।
আমানুল্লাহ বাচ্চা সাকাওর মাথার দাম ধরেছিলেন ৫০০ রুপি আর বাচ্চা আমানুল্লাহর শিরের দাম ঠিক করেছিলেন এক হাজার রুপি। মুজতবা আলীর আবদুর রহমান যদি বাদশাহর মাথার আর তার ভাই যদি ডাকাত বাচ্চা সাকাওর মাথা কেটে আনতে পারে তাহলে মোট কত পাবে, জানতে চাইলেন আবদুর রহমান- জবাবে সৈয়দ সাহেব বললেন, দেড় হাজার রুপি হওয়ার কথা।
কিন্তু আবদুর রহমান বলল, এক কর্নেলের ছেলে বলেছে, এক রুপিও পাব না।
সৈয়দ সাহেব বললেন, 'তা-ও ঠিক। দুই মস্তক ঝরে পড়লে কে কার টাকা দেবে!' আমানুল্লাহ খলিফা হারুন-উর রশিদের মতো দেশের ও দেশের মানুষের অবস্থা দেখতে ছদ্মবেশে বেরোতেন। তিনি একবার শহরের এক দোকানে গিয়ে একটার পর একটা জিনিসের দাম জিজ্ঞেস করতে থাকলেন, কোনো কোনোটা দেখতেও চাইলেন, দোকানদার ক্ষেপে গিয়ে জানতে চাইলেন, কিনতে এসেছেন না দেখতে? ছদ্মবেশী ক্রেতা বললেন, জিনিস দেখানো এবং দাম বলা আপনার কর্তব্য। ক্রেতা দশটা দেখে একটা কিনতে পারেন।
দোকানদার আরও ক্ষিপ্ত হয়ে বললেন, আপনি কিসের এমন বাদশাহ আমানুল্লাহ যে আপনাকে একটার পর একটা দেখাতে হবে আর দাম বলতে হবে? ক্রেতাও চমকে উঠে বললেন, বাদশাহ আমানুল্লাহও এ রকম দরাদরি করেন নাকি?
আমানুল্লাহ আরেক দোকানে ঢুকে দেখলেন, সেখানে মালামাল খুবই কম। কারণ জিজ্ঞেস করায় দোকানদার বললেন, আগে বেশি মালই থাকত, কিন্তু পৌষ্য বেড়ে যাওয়ায় খরচ বেড়ে গেছে, আগের মতো আর মাল তুলতে পারছেন না।
ছদ্মবেশী ক্রেতা জিজ্ঞেস করলেন, কত পুঁজি হলে দোকানটা ভালোভাবে চালু করতে পারবেন?
দোকানির সাফ জবাব, ঋণও নেবেন না, সুদও দেবেন না। ঋণ শোধ না করতে পারলে সবই যাবে।
তিনি তাঁকে একটি কাগজ দিয়ে বললেন, এটি নিয়ে বাদশাহর প্রাসাদে যাবেন, টাকার ব্যবস্থা হয়ে যাবে।
দোকানি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, বাদশাহর সাথে হুজুরের দোস্তি আছে নাকি? কাগজ দিলেই বাদশাহ টাকা দিয়ে দেবেন?
তিনি যখন দোকান থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন, দোকানদার আবার প্রশ্ন করলেন, হুজুরের পরিচয়টা?
এবার তিনি বলেই ফেললেন, আমিই আমানুল্লাহ।
শহরের বাইরে থেকে রোলস রয়েসে প্রাসাদের দিকে ফিরছিলেন আমানুল্লাহ। পথের মধ্যে চাকা বসে যাওয়ায় বিপদে পড়লেন। সে পথে তেমন গাড়িঘোড়া ছিল না। একটি প্রাইভেট গাড়ি দেখে থামাতে চেষ্টা করলেন, ভেতরে নারী যাত্রী থাকায় ড্রাইভার দ্রুত তাঁর পাশ কাটিয়ে চলে গেলেন। অনেকক্ষণ পর এক টাঙ্গাওয়ালাকে পেলেন। তাকে অনুরোধ করলেও রাজি করানো যাচ্ছিল না। দিনের খাটাখাটনির পর বাড়ি ফিরছিলেন। তা ছাড়া এখান থেকে গেলে ফেরার সময় সওয়ারি মিলবে না। বাদশাহ বললেন, সব ক্ষতি পুষিয়ে দেবেন। শেষ পর্যন্ত রাজি হলেন। টাঙ্গায় উঠে এই আরোহী জিজ্ঞেস করলেন, যা কামাই করো, তাতে কি সংসার চলে?
আগে চলত। তখন মহাজনের টাঙ্গা ভাড়া নিয়ে দুই বন্ধু ভাগাভাগি করে চালাতেন। আরও লাভের জন্য দুজন মিলে যখন একটা টাঙ্গা কিনলেন, বাদশাহও বিদেশ থেকে বাস আর ট্যাক্সি এনে রাস্তায় নামালেন। এখন আর কেউ টাঙ্গায় চড়তে চায় না। যেসব গরির মানুষ ওঠে, তারাও পুরো ভাড়া দিতে পারে না। টাঙ্গার আরোহী জানলেন, টাঙ্গাওয়ালারা বাদশাহকে অভিশাপ দেয়।
টাঙ্গাওয়ালা অবাক হয়ে দেখল, তার আরোহী প্রাসাদের সামনে নেমে তাঁর ড্রাইভারকে দিয়ে একটি ব্যবহৃত ডজ গাড়ি বের করালেন। টাঙ্গাওয়ালা ভাবল, এই গাড়িটা নিয়েই নষ্ট গাড়িটা টেনে আনতে যাবেন।
একটু দেরি হয়ে যাওয়ায় বিরক্ত হয়ে বলল, হুজুর তাড়াতাড়ি ভাড়া আর বকশিশটা দিন।
আরোহী গাড়িটা তাকে দিয়ে বললেন, এটাই বকশিশ। টাঙ্গার দিন শেষ, এখন থেকে এটা চালাবে। এখানে তোমার বন্ধুর ভাগও আছে। তাকে ঠকাবে না।
এই কাহিনিগুলো আনিস সিদ্দিকীর বই থেকে তুলে আনা হয়েছে। তিনি লিখেছেন, 'নির্বাসিত হয়ে ইতালিতে যাওয়ার মাত্র কয়েক মাস আগে তিনি যখন সে দেশের মেহমান হয়ে গিয়েছিলেন, তখন তাঁর চলার পথে শুধু গোলাপ আর গোলাপ ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। আর সিংহাসনচ্যুত হয়ে রাজনৈতিক আশ্রয় লাভের উদ্দেশ্যে আমানুল্লাহকে যখন দীনহীন বেশে ইতালির শহরে সেই একই পথ অতিক্রম করতে হয়েছিল তখন আর পথে গোলাপ বিছানো ছিল না, অতি সাধারণ গাড়িতে অতি সাধারণ মানুষ হিসেবে তিনি গেলেন।'