আড়াই হাজার বার ধুয়ে, ১১ হাজার বার মুছে জীবাণুমুক্ত হলো মহাকাশযান
আমরা যখন পৃথিবীতে পরিচ্ছন্নতা ও সূক্ষ্ম ভাইরাস নির্মূলে ব্যতিব্যস্ত, এব্যাপারে কার্যকরী উপদেশের জন্য আমাদের সম্ভবত মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার দ্বারস্থ হওয়া উচিত।
চলমান বিশ্ব মহামারির মধ্যেই মহাকাশ গবেষণা সংস্থাটি ২.৪ বিলিয়ন ডলার সমমূল্যের পারসিভারেন্স নামের রোভার পাঠাতে যাচ্ছে মঙ্গল গ্রহে। ভবিষ্যৎ গবেষণার জন্য রোভারটি মঙ্গলে আণুবীক্ষণিক প্রাণের সন্ধান করবে এবং গ্রহটির মাটি ও পাথরের নমুনা সংগ্রহ করবে।
তবে, রোভারটি যেন পৃথিবীর কোনো আণুবীক্ষণিক প্রাণ বা জীবাণু মঙ্গলে নিয়ে না যায় তারজন্য যথাযথ সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিয়েছে সংস্থাটি। নাসার নিজস্ব পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম, জীবানNuমুক্তকরণ পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে।
নাসার জেট প্রোপালশন ল্যাবরেটরির প্ল্যানেটারি প্রোটেকশন ইঞ্জিনিয়ার মুজিগা স্ট্রিকার বলেন, 'আমাদের ত্বকে বসবাসরত বিভিন্ন ভাইরাস ও অন্যান্য আণুবীক্ষণিক জীব অত্যন্ত দুর্বল প্রকৃতির। ৭ বছর আগে শুরু হওয়া এই কার্যক্রমে এই মহাকাশযানটিকে সকল উপায়ে পরিচ্ছন্ন রাখার ব্যবস্থা করেছি আমরা। মহাকাশে মানুষের পদযাত্রা শুরু হবার পর থেকেই মহাকাশকে জীবানু মুক্ত রাখার চেষ্টা করেছি। আমরা অসংখ্য ব্যাকটেরিয়ার আবাসস্থল, মঙ্গলকে এরথেকে রক্ষা করা আমাদেরই দায়িত্ব। '
পরিচ্ছন্নতা কক্ষের উৎপত্তি
পৃথিবী ও মহাজাগতিক প্রতিবেশী গ্রহগুলোর মধ্যে পারস্পরিক জৈবিক নিরাপত্তা বজায় রাখার ধারণাই হলো প্ল্যানেটারি প্রোটেকশন।
নীল আমস্ট্রং চাঁদে পা রাখার ২ বছর আগে ১৯৬৭ সালে যুক্তরাষ্ট্র, তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুক্তরাজ্য 'আউটার স্পেস ট্রিটি' নামের চুক্তি স্বাক্ষর করে, তারপর আরও ১০০টিব্দেশ এপর্যন্ত চুক্তিটি স্বাক্ষর করেছে। এর পেছনে কাজ করছে দুটি কারণ- বৈজ্ঞানিক ও নৈতিক । পৃথিবীর বাস্তুসংস্থান অত্যন্ত সংবেদনশীল এবং পরিবর্তনে সক্ষম। বিশাল জীবাণু জগতের কোনটি একটি নতুন পরিবেশে গিয়ে ক্ষতির কারণ হতে পারে তা আগে থেকে আঁচ করা সম্ভব নয়।
১৯৬০ এর দশকে নাসা তাদের একটি রেঞ্জার প্রোগ্রামের জন্য জীবাণু মুক্ত করার জন্য তাপের ব্যবহার করে। এই পদ্ধতিতে জীবণু মুক্ত হলেও যন্ত্রপাতিতে সমস্যা দেখা যায়।
৭০ এর দশকে পুনরায় মহাকাশযান পরিচ্ছন্নতা অভিযান শুরু হয়। এবার তারা একাজে অস্ত্রশিল্পের পরিচ্ছন্নতা পদ্ধতি অনুসরণ করে।
১৯৬১ সালে ক্যালিফোর্নিয়ার পাসাডিনায় এই ল্যাবরেটরির যাত্রা শুরু হয়। অত্যন্ত সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ, জীবাণুনাশক দ্বারা ক্রমাগত পরিষ্কার করা, হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড ও এলকোহল ইত্যাদির ব্যবহারে ক্রমাগত পরিচ্ছন্নতা পদ্ধতির মাধ্যমে এই পরিচ্ছন্নতা কক্ষ গড়ে তোলে নাসা। এখানে কর্মরত সকলকেই মেনে চলতে হয় কঠোর সরক্ষা ব্যবস্থা। এমনকি তাদের এখানে আসার পূর্বে শ্যাম্পু, লোশন, পারফিউম এসব ব্যবহার করাও নিষেধ। নতুন এই রোভার ছাড়াও ভয়েজার ১, ভয়েজার ২, গ্যালিলিও অরবিটার সবগুলো নভোযানকেই 'High bay 1' ও 'High bay 2' নামক পরিচ্ছন্নতা কক্ষের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে।
মুজিগা স্ট্রিকার নতুন এই প্রোগ্রামের জন্য গতবছর ল্যাবরেটরিতে প্রচুর সময় ব্যয় করেন। মে মাসের মধ্যেই ৯৫% কাজ শেষ হয়ে গিয়েছিল। বাকি ৫% কাজের মধ্যে ছিল বিভিন্ন অংশের নমুনায়ন ও পরীক্ষণ, যার দ্বারা বোঝা যাবে রোভারটি সম্পূর্ণ ভাবে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন আছে। স্ট্রিকার এব্যাপারে বলেন, একাজের জন্য তারা মহাকাশযানটি ১১,৬০১ বার মোছা হয়েছে ও ধোয়া হয়েছে ২,৫৪৩ বার।
মহামারির ফলে স্ট্রিকারের কাজ আরও বেড়ে যায়। দলের প্রধান হিসেবে সদস্যদের নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে কাজ করার ব্যাপারটি তিনি সর্বক্ষণ দেখাশোনা করেন।
এসব জীবণু সম্পূর্ণভাবে বিনষ্ট করা সম্ভব নয় বলে স্ট্রিকার বলেন, যা বাকি আছে সব মিলিয়ে মোবাইলের ক্যামেরার লেন্সেই জায়গা হয়ে যাবে। একাজে তারা খুবই সাধারণ পদ্ধতি আইসোপ্রোপাইল এলকোহলও ব্যবহার করেছেন। তবে তারা সাধারণ পর্যায়ের জীবানু নিয়ে চিন্তিত নন, খাদ্যে বিষক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে এমন কোনো জীবাণু যদি সুপ্ত অবস্থায় থেকে যায় তবে তা ১০ মিলিয়ন বছরের বেশি সময় পরেও জেগে উঠতে পারে। এগুলোই বেশি চিন্তার কারণ।
তবে স্ট্রিকার এব্যাপারে সবচেয়ে বেশি চিন্তিত মহাকাশে মানব অভিযানের ব্যাপারে। আর যাইহোক, মানুষকে তো যন্ত্রপাতির মতো পরিষ্কার রাখা সম্ভব নয়, মানবদেহই হাজার হাজার জীবাণুর আবাসস্থল।
একারণেই মঙ্গলে যাত্রার থেকে মঙ্গলকে নিরাপদ রাখাই তুলনামূলক কঠিন ব্যাপার বিজ্ঞানীদের কাছে।