ছবির গল্প: বরফের চাদরে সময় যেখানে থমকে আছে!
পৃথিবীর সবচেয়ে বৈরি জলবায়ুর একটি আছে উত্তর মেরুতে। আর্কটিক অঞ্চলের এই স্মৃতি তবু মোহাচ্ছন্নের মতো ডাকে কাউকে। বিশেষ করে, যার রক্তে এই মেরুর হিমশীতলতার মধ্য দিয়ে সৌন্দর্য অনুভবের ক্ষমতা আছে, তাকে কে রুখতে পারে।
লোকে বলে, একবার এই পরিবেশের মোহে যে পড়েছে তাকে মেরু ডাকে হাতছানি দিয়ে। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের আলোকচিত্রী এভগিনা আরবুগেভাও জন্মেছিলেন এমন পরিবেশে। সুদূর মার্কিন মুল্লুকে বসেও তিনি যেন অনুভব করতেন রাশিয়ার দূর পূর্বাঞ্চলে আপন জন্মভূমির টান। ফেলে আসা সেই বৈরি হিমের রাজ্য আর তার অনাবিল জমাট সৌন্দর্য।
এভগিনা বলেন, তুন্দ্রার প্রান্তরে ছুটে বেড়িয়ে কেটেছে আমার শৈশব। মেরুজ্যোতির বিচ্ছুরণের আলোয় হেঁটে হেঁটে স্কুলে যেতাম। সেখানে সুর্যের দেখা মেলে না বছরের দুটি মাস। অন্ধকারে ঢাকা সেই সময় শুধু কোনো কাব্যিক অনুভূতির নাম নয়, তা জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ দর্শন।
''আমার জন্ম হয়েছিল রাশিয়ার ল্যাপটেভ সাগর তীরবর্তী এক অখ্যাত বন্দর নগরী টিক্সিতে। বহু বছর আগেই শৈশবের স্মৃতি ঘেরা সেই অঞ্চল ছেড়ে জীবন কাটিয়েছি নানা দেশের বড় বড় সব শহরে। কিন্তু, তবুও মেরু আমাকে সবসময় হাতছানি দিয়ে ডেকেছে। এর বিচ্ছিন্নতা আর গতিহীন জীবন আজো আমাকে মন্ত্রমুগ্ধের মতো টানে।''
তার ভাষায়, উত্তরের সেই জমাট ভূপ্রকৃতির মধ্যে আমার কল্পনা যেন পাখির মতো ডানা মেলে মুক্ত স্বাধীনভাবে উড়ে বেড়ায়। জীবনের বাকি সব কিছু মনে হয় প্রতীকী, আর আনুষ্ঠানিকতার উপলক্ষ মাত্র। তুষারের রাজ্যে প্রতিটি রঙের আছে গভীর আর ছন্দময় মর্মার্থ। তাই শুধুমাত্র এখানে ফিরে এসেই আমি নিজ সত্ত্বাকে খুঁজে পাই।
আলোকচিত্রী হিসেবে ছবির মধ্যেও একই সুর খুঁজে পাই আমি। মাঝে মাঝে ছবিদের মনে করি একটি উপন্যাসের একেক অধ্যায়ের মতো। প্রত্যেক পর্বে আছে ভিন্ন ভিন্ন স্বপ্ন, কিন্তু তারা সকলে এই ভূমির ভালোবাসায় একাকার হয়ে গেছে।
মনে করুন কোনো সন্যাসীর কথা- যে সাগরের মধ্যে এক জাহাজে একাই বসবাসের কল্পনা করে। বা কোনো নারী যে তার আরাধ্য পুরুষটির সঙ্গে পৃথিবীর দূরতম প্রান্তে একাকী জীবন কাটাতে চায়। এই ভিন্ন ভিন্ন স্বপ্ন, তবু একই ভালোবাসার সুর।
আরও গল্প আছে এখানে। এই ভূমির আদি- বাসিন্দাদের ভালোবাসার গল্প। যারা তাদের পূর্বপুরুষদের সঙ্গে জন্মভূমির কিংবদন্তির কথা বলে। অতীত আর ভবিষ্যতের মধ্যে সেতু গড়ে তারা ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখছে। আছে আধুনিক মানুষের বিচরণের ইতিহাসও। সোভিয়েত আমলে আর্কটিক জয়ের চেষ্টাও ছিল এক স্বপ্নের মতো।
প্রতিটি স্বপ্নের আছে নিজ রঙ আর পরিবেশ। যারা সেখানে থাকেন তাদের সকলেরই কোনো না কোনো দর্শণ আছে।
প্রথমে বলা সন্যাসীর মতোই স্বপ্ন জগতে বসবাস করেন ভিয়াচেসলাভ ক্রোতোকি। তিনি ব্যারেন্টস সাগর তীরবর্তী বিচ্ছিন্ন এক উপদ্বীপে অবস্থিত খোদোভারিকা আবহাওয়া কেন্দ্রের প্রধান।
ক্রোতোকি বলেন, 'এই এক চিলতে রুক্ষ, অনুর্বর জমিই আমার জাহাজ।'
তার সঙ্গে যখন আমার প্রথম দেখা হয়, তখন তার গায়ে ছিল সেই সোভিয়েত আমলে তৈরি তারপুলিনের একটি জ্যাকেট। শৈশবের স্মৃতি থেকে আমি দেখা মাত্রই পোশাকটি চিনতে পেরেছিলাম। আমার নিজ শহরেও সব পুরুষেরা হিমঠান্ডার কামড় থেকে বাঁচতে সরকারি এ পোশাক পরতো।
ক্রোতোকি একজন পোলিয়ারনিক বা উত্তর মেরু বিশেষজ্ঞ। জীবনের সিংহভাগ সময়য় তিনি ব্যয় করেছেন রুক্ষ মেরু নিয়ে গবেষণা করে। আর দৈনন্দিন কাজের মধ্যে আছে দৈনিক আবহাওয়ার প্রতিবেদন।
আবহাওয়া স্টেশনের বাইরে আমি বরফ সরে যাওয়ার, বরফে বরফ পেষার আসুরিক শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম। আর ঝোড়ো বাতাসের ধাক্কায় হুইসেলের মতো বাজছিল স্টেশনের রেডিওর তারগুলো। অথচ ভিতরে এসে দেখলাম জমাট বাধা মৌনতা। ক্রোতকির পায়ের শব্দ আর দরজার হালকা ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দ ছাড়া কোথাও কোনো আলোড়ন নেই।
প্রতিদিন তিন ঘন্টা পরপর স্টেশনে ফিরে এসে হাওয়ার গতি মাপেন তিনি। পুরোনো রেডিওর নব ঘুরিয়ে বিড়বিড় করে বলেন, দক্ষিণ-পশ্চিমের বাতাস, গতি ১২ মিটার প্রতি সেকেন্ড, ঊর্ধগতি ১৮ মিটার, তুষার ঝড় আসছে… ইত্যাদি।''
তার রিপোর্ট পান এমন কেউ যাকে কোনোদিন ক্রোতকি নিজ চোখে দেখেননি। এ সন্যাসই বটে।