প্রাণীরা কেন নিজেদের ও অন্যদের বিষ্ঠা খায়?
কিছু কিছু প্রাণী রয়েছে, যেগুলো নিজেদের কিংবা অন্য প্রাণীর বিষ্ঠা খেয়ে থাকে। এদের কাছে এটি স্বাভাবিক একটি ব্যাপার। বিজ্ঞানীরা এতে ক্ষতির চেয়ে উপকারের কথাই বেশি বলেছেন। তারা প্রাণীদের বিষ্ঠায় উপকারী ব্যাকটেরিয়ার পাশাপাশি কিছু পুষ্টিগুণও থাকার কথা জানিয়েছেন।
বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, হরিণ এশীয় হাতির গোবর, স্যালামান্ডার বা আগ্নেয়গোধা (গিরগিটিসদৃশ উভচর প্রাণী) বাদুড়ের বিষ্ঠা এবং কুকুর ও লেমুর মানুষের মল খায়। এছাড়াও স্পেনের সিয়েরা দে গোয়ারা পর্বতে স্ত্রী ছাগল এক প্রজাতির সামুদ্রিক পাখির বিষ্ঠা, ব্রাজিলের আটলান্টিক বনের ইঁদুর ও আপসাম (আমেরিকা অঞ্চলের বৃক্ষবাসী ক্ষুদ্র প্রাণী) মানুষেল মল খায়।
পূর্ব আফ্রিকার দেশ তাঞ্জানিয়ায় এক গবেষণায় বিজ্ঞানীরা দেখেন, ফণা শকুন (হুডেড ভালচার) সদ্য মারা যাওয়া কোনো পশুর মাংসের চেয়ে সিংহের মলের প্রতি বেশি আগ্রহী। গবেষণা প্রতিবেদনে বিজ্ঞানীরা বিষয়টির এভাবে বর্ণনা দিয়েছেন- সিংহ মলত্যাগ করে সেখান থেকে ১০ মিটারও দূরে যায়নি, এর মধ্যেই সেই মল খেতে বেশ কয়েকটি ফণা শকুন এসে হাজির।
বিজ্ঞানীদের ভাষায় বিষ্ঠা বা মল খাওয়াকে বলা হয় কপ্রোফেজি। অনেক প্রাণীর মধ্যেই এ অভ্যাস দেখা যায়। বিজ্ঞানীরা বলছেন, প্রাণীদের দেহ অনেক সময়ই খাবার থেকে ক্যালরি ও অন্যান্য পুষ্টি পুরোপুরি শোষণ করতে পারে না। তাই তাদের বিষ্ঠা বা মলে অনেক সময়ই কিছু ক্যালরি ও পুষ্টির উপস্থিতি দেখা যায়। আর সেই বিষ্ঠা অন্য কোনো প্রাণী খেলে তা থেকে ওই প্রাণীর দেহ অতিরিক্ত শক্তি ও পুষ্টি পেয়ে থাকে।
বিজ্ঞানীরা জানান, যখন খাবারের উৎস সীমিত হয়ে পড়ে কিংবা খাবারের সংকট দেখা দেয়, তখন কপ্রোফেজি প্রাণীগুলোর জন্য অতিরিক্ত ক্যালরি ও শক্তি পাওয়ার একটি সহজ উপায় হতে পারে। অথবা এমন পুষ্টি পেতে সহায়ক হতে পারে, যা নিয়মিত খাদ্যে পাওয়া যায় না। মল বা বিষ্ঠায় অন্ত্রের এমন ব্যাকটেরিয়া থাকতে পারে, যা হজম প্রক্রিয়ার জন্য সহায়ক।
টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিদ হেনা রেমপেল বলেন, 'বিষ্ঠা বন্যপ্রাণীর দেহের জন্য বিভিন্নভাবে উপকারী হতে পারে। আমাদের কাছে প্রাণীদের এ অভ্যাসটি অসুন্দর মনে হতে পারে ঠিকই, তবে এটি তাদের জন্য স্পষ্টতই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।'
কপ্রোফেজির আরেকটি অর্থ নিজের বিষ্ঠা খাওয়াও হতে পারে। কিছু প্রজাতির খরগোশ রয়েছে, যেগুলো তাদের খাবার একবার হজম হওয়ার পর তা থেকে আরও পুষ্টি শোষণের জন্য সেটি দ্বিতীয়বার হজম করে।
যখন খাদ্যের অভাব দেখা দেয়, তখন নরওয়ের স্যালবার্ডের বলগাহরিণের মতো কিছু প্রজাতি হাঁসের বিষ্ঠা খেয়ে থাকে। অন্যদিকে শীতকালে তিব্বতের মালভূমি পিকারা (একজাতীয় স্তন্যপায়ী প্রাণী) চমরী গাই বা গৃহপালিত ষাঁড়ের গোবর খায়।
যুক্তরাজ্যের আবারডিন বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিদ জেভিয়ার ল্যামবিন বলেছেন, সম্ভবত একই কারণে স্কটল্যান্ডের কেয়ার্নগরমস ন্যাশনাল পার্কের লাল শিয়ালরা কুকুরের বিষ্ঠা খেয়ে থাকে। শিয়ালগুলোর বিষ্ঠা পরীক্ষা করে তাতে কুকুরের ডিএনএ'র উপস্থিতি মিলেছে।
ল্যামবিন ও তার সহকর্মীরা গবেষণায় দেখেছেন, যখন এই শিয়ালদের সাধারণ খাবার ফিল্ড ভোল (এক ধরনের ছোট ইঁদুর) যখন কম থাকে, তখন এরা বিকল্প খাবার (যেমন কুকুরের বিষ্ঠা) খেতে শুরু করে।
শিয়ালগুলো যেসব কুকুরের বিষ্ঠা খায়, সেই বিষ্ঠা পরীক্ষা করে গবেষকরা দেখেছেন, রান্না করা ছোলায় যে পরিমাণ ক্যালরি থাকে, কুকুরের বিষ্ঠায়ও ঠিক সেই পরিমাণেই ক্যালরি রয়েছে।
ভিটামিনের সাগর
ক্যারিবীয় দ্বীপ বোনায়ারের কোরাল রিফে ডাইভিং করার সময় যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিদ হেনা রেমপেল লক্ষ্য করেন, সার্জনফিশ ও প্যারটফিশ (টিয়া মাছ) ব্রাউন ক্রোমিস মাছের মল খেতে হুমড়ি খেয়ে ছুটছে। ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের বেশ কয়েকটি রিফেও একই ঘটনা দেখেছেন তারা।
হেনা বলেন, 'আমি দুটি মাছকে একই মলের জন্য লড়াই করতে দেখেছি।'
বিষয়টি ভালোভাবে পর্যবেক্ষণের পর হেনা ও তার সহকর্মীরা দেখেন, ব্রাউন ক্রোমিস মাছের ত্যাগ করা প্রায় ৮৫ শতাংশ মলই অন্য মাছেরা খেয়ে ফেলেছে। আর এই অন্য মাছগুলোর বেশিরভাগই সার্জনফিশ ও প্যারটফিশ।
গবেষণায় আরও দেখা গেছে, ব্রাউন ক্রোমিস মাছ প্রধানত প্ল্যাংকটন (সাগর, নদী বা হ্রদে ভাসমান জীবাণুবিশেষ) খেয়ে থাকে। তাদের মলে প্রচুর পরিমাণে ক্ষুদ্র পুষ্টিকর পদার্থ থাকে। হেনা এটিকে মাছেদের জন্য 'ভিটামিনের সাগর' হিসেবে অভিহিত করেন।
অন্ত্রের উপকারী ব্যাকটেরিয়া পেতে সহায়ক
সাউথ অস্ট্রেলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীববিদ বারবারা ড্রিগো মনে করেন, কপ্রোফেজি অর্থাৎ বিষ্ঠা অনেক পাখিকেই তাদের শরীরের জন্য উপকারী ব্যাকটেরিয়া পেতে সহায়তা করে।
তিনি আরও মনে করেন, পরিযায়ী পাখিরা যখন নতুন কোনো এলাকায় যায়, তখন অন্ত্রের ব্যাকটেরিয়া পাওয়ার জন্য তারা স্থানীয় পাখির বিষ্ঠা খেতে পারে। এটি নতুন পরিবেশে আরও কার্যকরভাবে তাদের খাদ্য হজমে সহায়তা করে।
ইউরেশিয়া অঞ্চলের ছোট ছোট কুট পাখিকেও তাদের বাবা-মায়ের বিষ্ঠা খেতে দেখা গেছে। সম্ভবত এটিও একইভাবে তাদের খাদ্য প্রক্রিয়া করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যাকটেরিয়া সরবরাহ করতে সহায়ক।
দক্ষিণ আফ্রিকার এক গবেষণা কেন্দ্রে গবেষকরা খাঁচায় বন্দী উটপাখির ছানাদের ওপর একটি পরীক্ষা করেন। কিছু ছানাকে তাদের বাবা-মায়ের বিষ্ঠা খেতে দেওয়া হয়। গবেষকরা দেখতে পান, যেসব ছানাকে তাদের বাবা-মায়ের বিষ্ঠা খেতে দেওয়া হয়েছিল, সেগুলো দ্রুত বেড়ে উঠেছিল এবং এদের অন্ত্রের ব্যাকটেরিয়া বেশি বৈচিত্র্যময় ছিল। আর যেসব ছানাকে বিষ্ঠা খেতে দেওয়া হয়নি, তাদের তুলনায় বিষ্ঠা খাওয়া ছানাগুলো বেশি সুস্থ ছিল।
আট সপ্তাহ বয়সের সময় ওজন পরিমাপে দেখা যায়, বিষ্ঠা খাওয়া ছানাগুলোর ওজন বিষ্ঠা না খাওয়া ছানাগুলোর তুলনায় ১০ শতাংশ বেশি এবং এদের মধ্যে অন্ত্রের ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগে মারা যাওয়ার ঝুঁকিও অনেক কম।
ড্রিগো বলেন, অন্ত্রের ব্যাকটেরিয়ার বৈচিত্র্য দেহের ইমিউন সিস্টেমের জন্য উপকারী। সাধারণভাবে বলতে গেলে 'যে পাখিরা বিষ্ঠা খায়, তারা ওই পাখিদের তুলনায় অনেক বেশি সুস্থ যারা বিষ্ঠা খায় না।'
রয়েছে ঝুঁকিও
কপ্রোফেজির অবশ্য কিছু ঝুঁকিও রয়েছে। যেমন, পাখির বিষ্ঠায় পয়ঃনিষ্কাশন, কীটনাশক বা মানুষের তৈরি অন্যান্য ক্ষতিকারক যৌগ বা বিপজ্জনক রাসায়নিক থাকতে পারে। বিষ্ঠা খাওয়ার কারণে অন্ত্রের পরজীবী বা ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়াও দেহে প্রবেশ করতে পারে, যা পশু-পাখির বিভিন্ন রোগের কারণ হতে পারে।
অনুবাদ: রেদওয়ানুল হক