ইপিজেডগুলোতে ১০০ কোটি ডলার বিনিয়োগে আগ্রহী এশিয়ার বিনিয়োগকারীরা
অবশেষে আমেরিকা-চীন বাণিজ্যযুদ্ধের সুফল পেতে শুরু করেছে বাংলাদেশ। এশিয়ান কোম্পানিগুলো এখন দেশের রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলে প্রায় ১০০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করতে চায়।
কোভিড সংকটের সময় স্থানীয় বেসরকারি বিনিয়োগ যখন স্থবির হয়ে আছে, বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেপজা) হাতে তখন অনেকগুলো বিনিয়োগপ্রস্তাব রয়েছে। বেপজার তথ্য অনুসারে, প্রস্তাবগুলোর বেশিরভাগই এসেছে চীন, জাপান, ভারত ও দক্ষিণ কোরিয়ার মতো এশিয়ার দেশগুলো থেকে।
বেপজার লক্ষ্য যেহেতু দেশকে একক খাতনির্ভরতা থেকে বের করে আনা, তাই বেশিরভাগ বিনিয়োগপ্রস্তাবই করা হয়েছে পোশাক-বহির্ভূত পণ্যের জন্য।
বর্তমানে দেশের মোট বার্ষিক রপ্তানিতে বেপজার অবদান প্রায় ২০ শতাংশ। যার মধ্যে আরএমজি-বহির্ভূত পণ্যের অবদান ৬৪ শতাংশ।
গত অর্থবছরে দেশের রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলগুলোতে বিনিয়োগ ১৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছিল। পাইপলাইনে থাকা ১০০ কোটি ডলার বিনিয়োগ হলে ২০২২-২৩ অর্থবছরের মধ্যে বেপজার প্রবৃদ্ধি ২০-২৫ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে।
এশিয়ান বিনিয়োগকারীদের বাংলাদেশে আসার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বেপজার নির্বাহী চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল মো. নজরুল ইসলাম বলেন, চীনে শ্রমের খরচ ক্রমেই বাড়তে থাকায় বিনিয়োগকারীরা দেশটি থেকে সরে আসছে।
তিনি বলেন, 'আমরা এখন চীন-আমেরিকা বাণিজ্যযুদ্ধ থেকে লাভবান হচ্ছি। কিছু বিদেশি বিনিয়োগকারী মিয়ানমার থেকেও বাংলাদেশে তাদের ব্যবসা স্থানান্তর করছে।'
বর্তমানে বাংলাদেশে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে চীন শীর্ষে রয়েছে। এছাড়াও ভারত, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার বিনিয়োগকারীরাও বাংলাদেশে আসছে বলে জানান নজরুল ইসলাম।
তিনি বলেন, 'আমরা জার্মানির সঙ্গে একটা বিনিয়োগ চুক্তি স্বাক্ষর করেছি।' উচ্চমানের চামড়াজাত পণ্য, জিপার, বোতাম, ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ পণ্য এবং আউটডোর তাঁবুর মতো নন-আরএমজি পণ্য উৎপাদনেই বেশিরভাগ বিনিয়োগ আসছে বলে জানান তিনি।
বেপজার নির্বাহী চেয়ারম্যান বলেন, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে তারা যেসব বিনিয়োগপ্রস্তাব পেয়েছেন, তার ৯০ শতাংশই এসেছে এশিয়ার দেশগুলো থেকে।
জাপানি বিনিয়োগকারীরা ৫০টি শিল্প স্থাপনের জন্য চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে অবস্থিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্প নগরে ৫০টি প্লট বরাদ্দ চেয়েছে। ফিল্ড আইটেম, গল্ফ শ্যাফট এবং অন্যান্য পণ্য উৎপাদনে বিনিয়োগ করবে তারা।
মেজর জেনারেল মো. নজরুল ইসলাম বলেন, 'আমরা তাদের প্রস্তাব পর্যালোচনার জন্য একটা কমিটি গঠন করেছি। কিন্তু বিপুলসংখ্যক বিনিয়োগপ্রস্তাব থাকায় ওদের আমরা ৫০টি প্লট বরাদ্দ দিতে পারব না।'
বেপজার তথ্যানুসারে, বর্তমানে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মধ্যে রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলগুলোতে চীনের সর্বোচ্চ সংখ্যক ১০৯টি উদ্যোগ রয়েছে। এছাড়া দক্ষিণ কোরিয়ার ৭১, জাপানের ৩১ ও ভারতের উদ্যোগ আছে ২০টি।
রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলগুলোতে এখন ৪৫৯টি উদ্যোগ চালু আছে, যার মধ্যে বিদেশি উদ্যোগ ৭০ শতাংশ। বেপজার তথ্য অনুযায়ী, এ বছরের আগস্ট পর্যন্ত দেশের আটটি রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলে মোট বিনিয়োগ দাঁড়িয়েছে ৫ দশমিক ৬৭ বিলিয়ন ডলারে।
বিদেশি বিনিয়োগ বাড়তে থাকায় পটুয়াখালী, যশোর ও গাইবান্ধায় তিনটি নতুন রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল নির্মাণ শুরু করেছে বেপজা।
স্রোতের মতো বিদেশি বিনিয়োগ আসতে থাকায় এখন দক্ষ জনশক্তি তৈরি করাই বেপজার জন্য প্রধান চ্যালেঞ্জ। কেননা বাংলাদেশি শ্রমিকরা প্রযুক্তিগত জ্ঞানে পিছিয়ে রয়েছে।
এই মহামারিকালে বহু মানুষ চাকরি হারানোর ফলে বেকারত্ব যখন একটা বড় উদ্বেগ হয়ে দেখা দিয়েছিল, তখনই আটটি রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলে বিদেশি বিনিয়োগ আসার সুবাদে ৩২ হাজার নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করেছে বেপজা।
রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলগুলোর মোট ৪ লাখ ৬৭ হাজার কর্মচারীর মধ্যে ৬৭ শতাংশ নারী কর্মচারী নিয়োগ দিয়ে এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে বেপজা।
নজরুল ইসলাম বলেন, আধুনিক যন্ত্রপাতি চালানোর জন্য দক্ষ জনবলের অভাব রয়েছে।
তিনি জানান, বেপজা, জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ এবং বাংলাদেশ হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষ এখন দক্ষ জনশক্তি তৈরিতে যৌথভাবে কাজ করছে।
কেমন চলছে বেপজার ইপিজেড নির্মাণের কাজ
বেপজার অধীনে এখন আটটি ইপিজেড রয়েছে—চট্টগ্রাম ইপিজেড, ঢাকা ইপিজেড, মংলা ইপিজেড, ঈশ্বরদী ইপিজেড, কুমিল্লা ইপিজেড, উত্তরা ইপিজেড, আদমজী ইপিজেড ও কর্ণফুলী ইপিজেড।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্প নগরে বেপজার নির্মাণাধীন অর্থনৈতিক অঞ্চল সম্পর্কে জানাতে গিয়ে নজরুল ইসলাম বলেন, 'শিল্প নগরে আমাদের ১ হাজার ১৫০ একর জমি আছে। সেখানে ৩৫০টি রপ্তানিমুখী কারখানা নির্মিত হবে।'
তিনি আরও জানান, এখন পর্যন্ত ১৪০টি তৈরি প্লটসহ ২০২৩ সালের মধ্যে শিল্প নগরের সব কাজ সম্পন্ন হবে।
তিনি বলেন, 'আমরা ইতিমধ্যে ৫৫০টি প্লটের মধ্যে ৬৬টি প্লট বিভিন্ন কোম্পানিকে বরাদ্দ দিয়েছি। এই বছরের শেষ দিকে তারা অবকাঠামো উন্নয়নের কাজ শুরু করবে।'
বঙ্গবন্ধু শিল্প নগরে কোম্পানিগুলোকে চার-পাঁচ বছর ধরে নিরবচ্ছিন্ন পানি সরবরাহের ব্যবস্থা করা হয়েছে জানিয়ে নজরুল ইসলাম আরও বলেন, শিল্প নগরীতে পানি সংকট নিরসনেও প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার।
নজরুল ইসলাম বলেন, বিশেষ করে কৃষিভিত্তিক পণ্য উৎপাদনের জন্য গাইবান্ধায় ১ হাজার ৮৩১ একর জমিতে রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল তৈরি করছে বেপজা।
অন্যদিকে পটুয়াখালীর ইপিজেডের ভিত্তি-কাজও সম্পন্ন হয়েছে। সড়কপথে পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর থেকে পটুয়াখালীর ইপিজেডে যেতে মাত্র ৩০ মিনিট লাগে।
এছাড়া যশোরের ইপিজেড ও মোংলা বন্দরের মধ্যেও সহজ যোগাযোগব্যবস্থা থাকবে বলে জানান নজরুল ইসলাম।
আদমজী ইপিজেডে এখন ৫০টি কারখানা চালু আছে। আরও দশটি কারখানা কার্যক্রম শুরু হওয়ার অপেক্ষায় আছে। ৮৩টি কারখানা স্থাপনের ক্ষমতাসম্পন্ন আদমজী ইপিজেডে ইতিমধ্যে ৬০০ মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ হয়েছে। এই ইপিজেডের বার্ষিক আয় ৫০০ কোটি টাকা।
আটটি ইপিজেডে অবস্থিত দেশের তৈরি পোশাক কারখানাগুলো প্রধানত বড় ব্র্যান্ডের পোশাক আইটেম উৎপাদন করে। কারখানাগুলো অপটিক্যাল ফাইবার কেব্ল, গল্ফ আইটেম, আসবাবপত্র, পাটজাত পণ্য ইত্যাদিসহ আরও ১৩৮টি আইটেম উৎপন্ন করে।
বেপজার নির্বাহী চেয়ারম্যান বলেন, 'আমরা নন-আরএমজি সেক্টরে পণ্য বৈচিত্র্যের উপর জোর দিচ্ছি। যেমন, সনি এরিকসন মোবাইল যন্ত্রাংশ তৈরি করছে; নিসান, মিতসুবিশি, হিনো এবং টয়োটা উৎপাদন করছে অটোমোবাইল যন্ত্রাংশ। এবিইউ গার্সিয়া উৎপাদন করছে গল্ফ শ্যাফট।'
তিনি বলেন, বেপজার অ্যাজেন্ডা তিনটি: পণ্যে বৈচিত্র্য আনা, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও নারীদের কর্মসংস্থান। তিনি জানান, পণ্যে বৈচিত্র্য আনা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ অ্যাজেন্ডা।
বেপজার তথ্যানুসারে, রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলে পরিচালিত ৪৫৯টি উদ্যোগের মধ্যে ১৭৪টি উদ্যোগ আরএমজি-বহির্ভূত পণ্য উৎপাদন করে।
যে কারণে ইপিজেডে বিনিয়োগে আগ্রহী বিদেশি বিনিয়োগকারীরা
ইপিজেডে বিনিয়োগের জন্য বিনিয়োগকারীদের বিভিন্ন প্রণোদনা দিয়ে থাকে বেপজা।
ইপিজেডে বিনিয়োগ করে বিনিয়োগকারীরা কর অবকাশ, কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতির শুল্কমুক্ত আমদানি, লভ্যাংশ কর থেকে ছাড়, জিএসপি সুবিধা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও অন্যান্য দেশে শুল্ক ও কোটামুক্ত প্রবেশাধিকার পেতে পারে।
ইপিজেডে শতভাগ বিদেশি মালিকানা অনুমোদিত—বিদেশি বিনিয়োগ এবং মূলধন ও লভ্যাংশের সম্পূর্ণ ফিরিয়ে নেওয়ার ওপর কোনো ধরনের বিধিনিষেধ নেই।
চট্টগ্রাম, ঢাকা, কুমিল্লা, আদমজী ও কর্ণফুলী ইপিজেডে বছরে আড়াই ডলার প্লট ভাড়া নেয়। মোংলা, ঈশ্বরদী ও উত্তরা ইপিজেডে বার্ষিক প্লট ভাড়া নেয় ১ দশমিক ৪০ ডলার।
বেপজার কর্মচারীসংখ্যা প্রায় ২ হাজার। প্রতিষ্ঠানটি গ্যাস, পানি ও বিদ্যুৎ সরবরাহের মতো সেবাগুলো নিশ্চিত করার কাজ করে।