একটি ‘মিলিয়ন ডলারের’ বিয়ে এবং বেতন না পাওয়া এক পোশাক কর্মীর মৃত্যু
গল্পটি দুই ধরনের বাস্তবতার। এ বাস্তবতার একদিকে রয়েছে গত বছর আলোঝলমলে প্যারিসে আয়োজিত বাংলাদেশি ব্যবসায়ী জাভেদ ওপগেনহাফেনের "মিলিয়ন-ডলারের' বিয়ের অনুষ্ঠান। অন্যদিকে রয়েছে সম্প্রতি বাংলাদেশে সহিংস শ্রমিক বিক্ষোভে তার পরিবারের মালিকানাধীন পোশাক কারখানার এক নারী শ্রমিকের ঝরে যাওয়া জীবন।
২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে প্যারিসে জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ভারতীয় বংশোদ্ভূত ফ্যাশন আইকন রোজমিন মাধবজিকে বিয়ে করেন জাভেদ। বিলাসবহুল ওই অনুষ্ঠানের ছবি ও ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়ে যায়।
সে বছর প্যারিসের সবচেয়ে ব্যয়বহুল বিয়ের তালিকাতেও ছিল জাভেদের বিয়ের অনুষ্ঠান। তাই আয়োজনটি নজর কাড়ে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমেরও। ভোগ ও ট্যাটলার ম্যাগাজিনেও জাভেদের বিয়ের অনুষ্ঠানের খবর ছাপা হয় ফলাও করে।
দেশের বাইরে অর্থবিত্তের এই জমকালো প্রদর্শনীর এক বছর পরেই দেশে দেখা গেল সম্পূর্ণ বিপরীত বাস্তবতা। দেশে জাভেদের পরিবারের মালিকানাধীন জেনারেশন নেক্সট ফ্যাশনস লিমিটেডের শ্রমিকরা মাসের পর মাস বেতন না পেয়ে জীবন চালানোর জন্য রীতিমতো ধুঁকছেন।
চলতি বছরের সেপ্টেম্বরের শুরু থেকে এই কারখানার শ্রমিকরা বকেয়া বেতনের দাবিতে বিক্ষোভ করছেন। এ বিক্ষোভ একপর্যায়ে স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে রূপ নেয়। ৯ সেপ্টেম্বর কারখানাটি সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেওয়া হলেও শ্রমিকদের বিক্ষোভ চলতে থাকে।
এরপর গতকাল কোম্পানি কর্মকর্তা, শ্রমিক নেতা, শ্রম মন্ত্রণালয় ও বিজিএমইএর এক বৈঠকে কারখানাটি স্থায়ীভাবে বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, আইন অনুযায়ী শ্রমিক ও কর্মীদের সমস্ত বকেয়া বেতন পরিশোধ করতে হবে।
২৩ অক্টোবর সংঘর্ষে আহত চম্পা খাতুন (২৫) নামে একজন শ্রমিক ২৭ অক্টোবর মারা যান। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কয়েকদিন আইসিইউতে থাকার পর মারা যান তিনি।
এ নিয়ে সাম্প্রতিক শ্রমিক অসন্তোষে চম্পাসহ তিনজন মারা গেছেন; আহত হয়েছেন কয়েক ডজন।
জেনারেশন নেক্সট পোশাক খাতে শ্রমিক অসন্তোষের একমাত্র কারণ না হলেও প্রতিষ্ঠানটি পরিস্থিতির অবনতিতে ভূমিকা রেখেছে।
বিজিএমইএ সূত্রে জানা গেছে, অক্টোবরের তৃতীয় সপ্তাহে শ্রমিক অসন্তোষ কমে আসে। এ সময় সব কারখানাই খোলা হয়, দুটি বাদে। বন্ধ থাকা দুটি কারখানার একটি হচ্ছে জেনারেশন নেক্সট। এই বন্ধ কারখানা দুটি এখনও বকেয়া বেতন পরিশোধ করেনি।
নেক্সট জেনারেশনের মালিকদের সঙ্গে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না বলে জানা গেছে। কোম্পানিটির সাবেক পরিচালক জাভেদ ও তার পিতা কোম্পানির বর্তমান চেয়ারম্যান তৌহিদুল ইসলাম চৌধুরী বর্তমানে দেশের বাইরে অবস্থান করছেন বলে গুঞ্জন রয়েছে।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, স্পন্সর পরিচালক হিসেবে তৌহিদুল ইসলাম চৌধুরীর হাতে কোম্পানিটির ৫.১৩ শতাংশ শেয়ার এবং তার পরিচালিত এজে কর্পোরেশনের হাতে রয়েছে প্রায় ৭ শতাংশ শেয়ারের মালিকানা। তার পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের হাতেও কোম্পানিটির শেয়ার রয়েছে।
বাংলাদেশের বিভিন্ন ব্যবসায়িক উদ্যোগে শেয়ারহোল্ডার ও পরিচালক হিসেবে জড়িত জাভেদ। তিনি এজে কর্পোরেশনের ভাইস চেয়ারম্যান, ফু-ওয়াং সিরামিক ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেড ও এসএস স্টিলের চেয়ারম্যান এবং জেনারেশন নেক্সট টেকনোলজিস লিমিটেডের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
পোশাক খাত, রিয়েল এস্টেট, স্টিল উৎপাদনসহ বিভিন্ন খাতে তাদের পারিরের ব্যবসা রয়েছে।
'শেখ পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক'
৫ আগস্ট শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকে জাভেদ ও তার বাবা আত্মগোপনে চলে গেছেন বলে জানা গেছে।
তৌহিদুলের স্ত্রী সাঈদা মুনা তাসনিমের মাধ্যমে শেখ হাসিনার পরিবারের সঙ্গে জাভেদের পরিবারের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে বলে জানা গেছে। বিজিএমইএর তথ্য অনুযায়ী, সাঈদা জেনারেশন নেক্সটের শেয়ারহোল্ডার এবং তৌহিদুলের দ্বিতীয় স্ত্রী।
জাভেদ তৌহিদুলের প্রথম স্ত্রীর সন্তান।
সাঈদা মুনা তাসনিম ২০১৮ সালের নভেম্বর থেকে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশের হাইকমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। আওয়ামী লীগ সরকারের নিয়োগ দেওয়া কূটনীতিকদের দেশে ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে সম্প্রতি অন্তর্বর্তী সরকার তাকে দ্রুত দেশে ফেরার নির্দেশ দেয়।
তবে বিসিএস (পররাষ্ট্র ক্যাডার) ১১তম ব্যাচের কর্মকর্তা সাঈদা মুনা তাসনিম এ নির্দেশে কোনো সাড়া দেননি। আগামী ২৬ ডিসেম্বর থেকে তার অবসরোত্তর ছুটিতে (পিআরএল) যাওয়ার কথা ছিল।
কূটনীতিকরা সাধারণত তিন বছরের জন্য একক মিশনে নিয়োগ পান। তবে শেখ পরিবারের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতার সুবাদে সাঈদা মুনা তাসনিম যুক্তরাজ্যে প্রায় ছয় বছর দায়িত্ব পালন করেছেন।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড হোয়াটসঅ্যাপে মুনা তাসনিমের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করলে তিনি এ অভিযোগের বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি। জেনারেশন নেক্সট ফ্যাশনসের বেহাল দশা নিয়েও কোনো মন্তব্য করেননি।
এদিকে শ্রমিকদের বকেয়া বেতন নিয়ে কথা বলার জন্য তৌহিদুল ইসলাম চৌধুরী ও তার ছেলে জাভেদের সঙ্গেও যোগাযোগের করে টিবিএস। কিন্তু তাদের সঙ্গেও যোগাযোগ করা যায়নি।
মজুরি বকেয়া রাখায় বিক্ষোভ
প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা জানান, জুলাই-আগস্টের রাজনৈতিক অস্থিরতার পরই জেনারেশন নেক্সট শ্রমিকদের বেতন পরিশোধে অক্ষম হয়ে পড়ে।
জুলাই মাসে শ্রমিকদের বেতন দিতে পারলেও ব্যবস্থাপনা কর্মীদের বেতন দিতে পারেনি জেনারেশন নেক্সট। আগস্টে ৪ হাজার ৭০০ জনের বেশি শ্রমিক ও কর্মচারীর বেতন বকেয়া পড়ে। এরপরই বিক্ষোভ শুরু হয়। এতে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়।
বিজিএমইএর তথ্য অনুযায়ী, জুলাইয়ে ব্যবস্থাপনা কর্মীদের বকেয়া বেতনের পরিমাণ প্রায় ৩ কোটি টাকা।
কারখানার একজন কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে টিবিএসকে জানান, সর্বপ্রথম চলতি বছরের এপ্রিল মাস থেকে কারখানাটিতে কর্মীদের বেতন-ভাতা পরিশোধে জটিলতা শুরু হয়। প্রথমদিকে এই সংকট ততটা তীব্র না হলেও ধীরে ধীরে কোম্পানির আর্থিক দুর্বলতা স্পষ্ট হতে থাকে। জুলাই থেকে কর্তৃপক্ষ কারখানার প্রয়োজনীয় কাঁচামালসহ বিভিন্ন অ্যাকসেসরিজ কেনা কমিয়ে দেয়।
ওই কর্মকর্তা বলেন, 'বর্তমানে বেতন বাবদ কোম্পানির কাছে শ্রমিকদের আনুমানিক বকেয়া ২১.৬৬ কোটি টাকা। অক্টোবর মাস শেষে বেতন হিসাবে এর সঙ্গে আরও অন্তত ৫ কোটি টাকা যুক্ত হবে।'
আগস্ট থেকে বেতন বকেয়া থাকলেও কারখানায় কাজ চালিয়ে গেছেন শ্রমিকরা। প্রথমদিকে কারখানার মধ্যেই বিক্ষোভ কিংবা বেতনের দাবিতে সোচ্চার হলেও গত সেপ্টেম্বর থেকে কাজ বন্ধ করে বিক্ষোভ শুরু করেন তারা। ৮ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হয় কর্মবিরতি। পরে আন্দোলন জোরালো হলে গত ২১ সেপ্টেম্বর সড়ক অবরোধ করেন শ্রমিকরা। এর জেরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে শ্রমিকদের সংঘর্ষ হয়।
কোম্পানি সচিব মোহাম্মদ শাহজাহান টিবিএসকে বলেন, 'শ্রমিক অসন্তোষের কারণে মূলত আমাদের সমস্যা হয়েছে। শ্রমিকরা কাজ করেনি, আমরাও কারখানা বন্ধ করে দিয়েছি।'
বকেয়া বেতনের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ব্যাংকঋণ না পাওয়ার কারণে বেতন দিতে বিলম্ব হচ্ছে।
যৌথমূলধন কোম্পানি ও ফার্মসমূহের পরিদপ্তরের (আরজেএসসি) কর্মকর্তারা টিবিএসকে জানান, জেনারেশন নেক্সট ফ্যাশনস ও এজে কর্পোরেশনের মোট ব্যাংকঋণ ৫০০ কোটি টাকারও বেশি।
গত ২৬ অক্টোরব মালিকপক্ষের সঙ্গে শ্রমিকদের বৈঠক হয়। সেখানে ধাপে ধাপে বেতন পরিশোধের সিদ্ধান্ত হয়েছে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, আগস্ট মাসের বেতন আগামী ৫ নভেম্বরের মধ্যে দেওয়ার কথা রয়েছে।
কোম্পানি সচিব শাহজাহান বলেন, 'বেতন দেওয়ার পর কারখানা খোলার চেষ্টা করব।'
তিনি আরও বলেন, 'আমাদের অর্ডার কখনও ঘাটতি ছিল না, কিন্তু শ্রমিকরা আনরেস্ট করার কারণে আমরা প্রোডাকশন করতে পারিনি। প্রোডাকশন করতে না পারায় সময়মতো রপ্তানি করাও সম্ভব হয়নি, যার কারণে অর্ডারগুলো সব হোল্ড হয়ে গেছে।'
সিকিউরিটজ আইন ভঙ্গ
পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি বন্ধ থাকলে স্টক এক্সচেঞ্জকে জানানোর বিধান থাকলেও তা করেনি জেনারেশন নেক্সট ফ্যাশনস।
৩০ এপ্রিল কোম্পানিটি তৃতীয় প্রান্তিকের হিসাব প্রকাশ করেছে। কারখানা বন্ধ থাকলেও সে বিষয়ে স্টক এক্সচেঞ্জের ওয়েবসাইটে কোনো তথ্য প্রকাশ করা হয়নি, যা লিস্টিং রুলসের লঙ্ঘন।
একসময়ের লাভজনক কোম্পানির পতন
২০০৪ সালে প্রাইভেট লিমিটেড প্রতিষ্ঠান হিসাবে যাত্রা শুরু করে জেনারেশন নেক্সট ফ্যাশনস লিমিটেড। ২০১২ সালে আইপিওর মাধ্যমে শেয়ার ইস্যু করে পুঁজিবাজার থেকে ৩০ কোটি টাকা মূলধন উত্তোলন করে প্রতিষ্ঠানটি।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, জেনারেশন নেক্সটের মোট শেয়ারের ১৬.২৬ শতাংশের মালিক জাভেদের পরিবার ও সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলো, আর ৮৩.৭৪ শতাংশ শেয়ারের মালিকানা রয়েছে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে।
মূল শেয়ারহোল্ডারদের মধ্যে জাভেদের বাবা তৌহিদুল ইসলাম চৌধুরী স্পনসর পরিচালক হিসেবে ৫.১৩ শেয়ারের শেয়ার মালিক, এজে কর্পোরেশন ৬.৯৭ শতাংশ, এজে কর্পোরেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ভারতীয় নাগরিক রাজিব সেঠি ২ শতাংশ, পরিচালক আলাভি আজফার চৌধুরী ২.১২ শতাংশ ও শাহীন আখতার চৌধুরী ০.০৪ শতাংশ শেয়ারের মালিক।
বিএসজিএমইএ সূত্র জানায়, বিগত কয়েকটি অর্থবছরে বিশ্বব্যাপী ক্রেতাদের মধ্যে জেনারেশন নেক্সটের পণ্যের ব্যাপক চাহিদা থাকায় প্রতিষ্ঠানটি ভালো করছিল।
আর্থিক প্রতিবেদন অনুসারে, ২০১৮-১৯ অর্থবছর থেকে তৈরী পোশাক রপ্তানি খাতে ভালো আয় ও মুনাফা করে আসছিল কোম্পানিটি।
২০১৮-১৯ অর্থবছরে কোম্পানিটির আয় ছিল ৫১৮ কোটি টাকা, মুনাফা ছিল ২১ কোটি টাকা। ২০২০-২১ অর্থবছরে আয় ২৯২ কোটি টাকা ও মুনাফা ০.৩৩ কোটি টাকা এবং ২০২২-২৩ অর্থবছরে আয় ৫৯৬ কোটি টাকা ও মুনাফা ৩.৪১ কোটি ছিল।
তবে ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ায় ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম তিন প্রান্তিকে (জুলাই-মার্চ) কোম্পানিটির আয় ৪১ শতাংশ কমে দাঁড়ায় ২৯১ কোটি টাকা। ওই নয় মাসে প্রতিষ্ঠানটি ১.৮৬ কোটি টাকা লোকসান দিয়েছে।
চলতি বছরের জুনে ২০২৩-২৪ অর্থবছর শেষ হলেও জেনারেশন নেক্সট এখনও তাদের বার্ষিক আর্থিক রিপোর্ট প্রকাশ ও লভ্যাংশ ঘোষণা করার জন্য বোর্ড সভার সময়সূচি নির্ধারণ করেনি।
একসময়ের ভালো কোম্পানি কেন এমন পরিস্থিতিতে পড়ল, জানতে চাইলে এজে কর্পোরেশনের প্রতিনিধি হিসেবে জেনারেশন নেক্সটের বোর্ড পরিচালকের দায়িত্ব পালন করা শাহীন আখতার চৌধুরী টিবিএসকে বলেন, 'ব্যবসা তো সবসময় ভালোই যায়, তবে খারাপও হতেই পারে। আমরা চেষ্টা করছি, যেন পরিস্থিতির দ্রুত উন্নতি করা যায়।'