চার রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের ৫টি শাখাতেই সিংহভাগ ‘ফোর্সড লোন’
রাষ্ট্রায়ত্ত চার ব্যাংকের স্বল্পসংখ্যক শাখায় পুঞ্জিভূত হচ্ছে ব্যাংকের সিংহভাগ ঋণ। এর সঙ্গে বাড়ছে এ প্রতিষ্ঠানগুলোর খেলাপি ঋণ ও ফোর্সড লোনের পরিমাণ।
তথ্য অনুযায়ী, সরকারি খাতের চারটি বাণিজ্যিক ব্যাংকে জুন পর্যন্ত ফোর্সড লোনের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯ হাজার ২২২ কোটি টাকা।
এর মধ্যে জানুয়ারি থেকে জুন- এ ৬ মাসে সোনালী, জনতা ও অগ্রণী ব্যাংকে ফোর্সড লোন বেড়েছে ৩০৯ কোটি। তবে রূপালী ব্যাংকে কমেছে ৭৫ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, সোনালী ব্যাংকের ফোর্সড লোনের পরিমাণ ২ হাজার ৭২৮ কোটি টাকা। যা ডিসেম্বরে ছিল ২ হাজার ৭২২ কোটি টাকা। সে হিসাবে ৬ মাসের ব্যবধানে ব্যাংকটির ফোর্সড লোন বেড়েছে ৬ কোটি টাকা।
একইসময়ে অগ্রণী ব্যাংকের ফোর্সড লোন বেড়েছে ২৬৭ কোটি ও জনতা ব্যাংকের ৩৬ কোটি টাকা।
এদিকে সরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে জানুয়ারি থেকে জুন এ ৬ মাসে একমাত্র রূপালী ব্যাংকেরই ফোর্সড লোনের পরিমাণ কমেছে। তারা ফোর্সড লোন থেকে আদায়ের পরিমাণ বাড়ানোর কারণে সার্বিকভাবে এ খাতে ঋণের পরিমাণ কমে গেছে।
বর্তমানে রূপালী ব্যাংকের ফোর্সড লোন রয়েছে ৯১৫ কোটি টাকা। যা ডিসেম্বরে ছিল ৯৯০ কোটি টাকা। সে হিসাবে ৬ মাসে ব্যাংকটির ফোর্সড লোন কমেছে ৭৫ কোটি টাকা।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, কোন প্রতিষ্ঠানের এলসি গ্যারান্টি নেয়ার সময় অধিকাংশ ব্যাংক সঠিকভাবে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের যাচাই-বাছাই করে না। এর কারণে 'ফোর্সড লোন' বাড়ছে। ব্যাংকের দিক থেকে মূল্যায়ন (এসেসমেন্ট) সঠিক না হলে এ ঋণ দিনদিন বাড়বেই।
উল্লেখ্য, পণ্য আমদানির (এলসি) বিপরীতে বিদেশি ব্যাংককে গ্যারান্টি দিয়ে থাকে দেশি ব্যাংক। দেশে আমদানি পণ্য আসার পর শর্ত অনুযায়ী গ্রাহক ব্যাংকে টাকা পরিশোধ করলে ওই অর্থ বিদেশি ব্যাংককে দেশি ব্যাংক পরিশোধ করে দেয়। এক্ষেত্রে গ্রাহক কোনো কারণে অর্থ পরিশোধ না করলে আন্তর্জাতিক রীতি অনুযায়ী গ্রাহকের নামে ব্যাংক ফোর্সড বা বাধ্যতামূলকভাবে সমপরিমাণ ঋণ সৃষ্টি করে। ওই অর্থে ব্যাংক বিদেশি ব্যাংকের দেনা শোধ করে। এভাবে ব্যাংক গ্রাহকের নামে ফোর্সড লোন সৃষ্টি করে। মূলত আমদানির বিপরীতেই এসব ফোর্সড লোন সৃষ্টি হয়েছে।
এদিকে গত ১০ বছরে ব্যাংকিং খাত বেশকিছু বড় ধরনের ঋণ জালিয়াতি প্রত্যক্ষ করেছে। এসব ঘটনার অধিকাংশই হয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে। আর রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের যেসব শাখার মাধ্যমে এ সব ঋণ জালিয়াতি হয়েছে, সেসব শাখার মাধ্যমেই সিংহভাগ ঋণ বিতরণ হয়েছে বলে প্রতীয়মান।
বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, চলতি বছরের জুন শেষে মোট ৬৩ হাজার ৪৩৫ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করেছে জনতা ব্যাংক। এর মধ্যে ৪৫ হাজার ৬৬২ কোটি টাকা ছাড় করা হয়েছে মাত্র পাঁচটি শাখা থেকে, যা বিতরণকৃত মোট ঋণের ৭২ শতাংশ। শুধু জনতাই নয়, পাঁচ শাখার মাধ্যমে অধিকাংশ ঋণ বিতরণ করা ব্যাংকের তালিকায় রয়েছে আরও তিনটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক।
তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, চলতি বছরের জুন শেষে ৩৫ হাজার ৬৯১ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করেছে রূপালী ব্যাংক। এর মধ্যে মাত্র পাঁচ শাখার মাধ্যমে বিতরণ হয়েছে ২১ হাজার ৬১০ কোটি টাকা। অর্থাৎ বিতরণকৃত ঋণের ৬১ শতাংশই বিতরণ হয়েছে মাত্র পাঁচটি শাখার মাধ্যমে। এছাড়া পাঁচ শাখার মাধ্যমেই ৪৭ শতাংশ ঋণ ছাড় করা হয়েছে অগ্রণী ব্যাংকেও। মোট ৫৪ হাজার ৩৮৫ কোটি টাকা ঋণের বিপরীতে পাঁচ শাখার মাধ্যমে বিতরণ করা হয়েছে ২৫ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা।
এদিকে জুন পর্যন্ত ৬০ হাজার ৯৮৮ কোটি টাকা বিতরণ করেছে সোনালী ব্যাংক, যা সোনালী ব্যাংকের বিতরণকৃত ঋণের ৩১ শতাংশ। ওই পাঁচ শাখার মাধ্যমে ব্যাংকটির বিতরণ হয়েছে ১৮ হাজার ৭৩৭ কোটি টাকা। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমানে এ ব্যাংকের মোট শাখা সংখ্যা এক হাজার ২২৮টি।
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর ঋণ গুটিকয়েক শাখায় পুঞ্জিভূত হয়ে যাওয়াটা ব্যাংকিং খাতের জন্য দুঃখজনক হিসেবে দেখেছেন সাবেক গভর্নর সালেহ উদ্দিন আহমেদ।
তিনি বলেন, "একই ঝুঁড়িতে ডিমের পরিমাণ বেশি হলে যেকোন সময় একাধিক ডিম ভেঙে যেতে পারে। তাই ভিন্ন ভিন্ন ঝুঁড়িতে ডিম রাখাটা নিরাপদ। এখন ব্যাংকগুলোর ঋণের পরিমাণ গুটিকয়েক শাখায় পুঞ্জিভূত হচ্ছে। এর কারণে ব্যাংকগুলো ভবিষ্যতে দুর্ভোগ পোহাতে হবে। এছাড়া নতুন করে ঋণ দেয়ার আগে নানা পর্যালোচনা করতে হবে"।