জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির ভার বিদেশি ক্রেতাদের ওপর চাপাতে পারছেন না রপ্তানিকারকেরা
জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধিতে উৎপাদন ব্যয় আরেকদফা বেড়েছে। ব্যবসার ওপর বাড়তি এই চাপ কাটিয়ে ওঠার উপায় এবং বিশ্ববাজারে প্রতিযোগী সক্ষমতা ধরে রাখা নিয়ে এখন দুর্ভাবনায় পড়েছেন রপ্তানিকারকরা।
পণ্য সরবরাহক থেকে শুরু করে পরিষেবা দাতা জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির ফলে সৃষ্ট বাড়তি মূল্যের বোঝা সকলেই একে-অন্যের ঘাড়ে পার করছেন। অথচ বিশ্ববাজারে প্রতিযোগী সক্ষমতা ধরে রাখতে রপ্তানিকারকদের এই চাপ সহ্য করতে হচ্ছে।
বিভিন্ন খাত এই খরচ ৩০ সর্বোচ্চ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ালেও, আপাতদৃষ্টিতে তা নিয়ন্ত্রণের কোনো চেষ্টা দেখা যাচ্ছে না। ফলে পোশাক রপ্তানিকারকদের শঙ্কা, এতে তাদের সার্বিক উৎপাদন ব্যয় ন্যূনতম ৫ শতাংশ বাড়বে, যা শেষপর্যন্ত ভাগ বসাবে তাদের মুনাফা মার্জিনে। ইতোমধ্যেই লাভের সূচক অনেক রপ্তানিকারকের ক্ষেত্রে খুবই নিম্ন অবস্থানে বা কারো কারো ক্ষেত্রে শূন্যেও রয়েছে।
তারা বলছেন, মহামারি সৃষ্ট জটিলতায় এমনিতেই সংকটের মুখে বৈশ্বিক সরবরাহ চক্র। বেড়েছে জাহাজ ও কন্টেইনার ভাড়া। দেশের রপ্তানিকারকদের এখন ১০-৩০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে যাওয়া কন্টেইনার হ্যান্ডলিং চার্জ, পরিবহন খরচ ও জেট ফুয়েলের মূল্যের আঘাত সইতে হবে। তার সাথে নিত্যপণ্যের ১০ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধিও তাদের জন্য বড় আঘাত, কারণ মূল্যস্ফীতির চাপে পিষ্ট শ্রমিকেরাও এখন মজুরি বৃদ্ধির দাবি তুলবে।
দেশের নিট পোশাক পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিকেএমইএর সহ-সভাপতি ফজলে শামীম এহসান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, ক্রেতাদের দেওয়া পূর্ব প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী, তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকদের এখন আর দাম সমন্বয়ের সুযোগ নেই।
"কিছু ক্ষেত্রে আমরা ৩-৬ মাস আগেও কার্যাদেশ পেয়েছি। কারখানাগুলো আগামী ৪-৬ মাসের অর্ডার বুক করেছে। বিদ্যমান চুক্তির ফলে আমরা অন্তত ১০ মাস বাড়তি মূল্য সমন্বয়ের দাবি তুলতে পারব না।"
তিনি বলেন, বিদেশি বায়ারদের দেওয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষার কারণে বাংলাদেশ আজ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রপ্তানিকারকে পরিণত হয়েছে। পেট্রোলিয়ামের দাম বৃদ্ধির প্রভাব সুতা, কাপড়, ডাই-কেমিক্যাল থেকে শুরু করে সকল কাঁচামালের ক্রমবর্ধমান মূল্যের ওপর পড়েছে বলে উল্লেখ করেন বিকেএমইএ সহ-সভাপতি।
টিবিএসকে একই কথা বলেছেন বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিজিএমইএ) সহ-সভাপতি মোঃ শহীদুল্লাহ আজিম। তিনি বলেছেন, "ডিজেল ও কেরোসিনের মূল্যবৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে সবাই মূল্য বা ভাড়া বাড়ানোর প্রতিযোগীতায় নেমেছে, কেউ কেউ এমনকি অযৌক্তিকভাবে ২৩-৩০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধির পথ বেছে নিয়েছে।"
অথচ ইতোমধ্যেই সুতা ও জাহাজীকরণ ব্যয় বৃদ্ধির চাপে থাকা পোশাক রপ্তানিকারকেরা গত ছয় দিনে কাভার্ড ভ্যান ও ট্রাক ধর্মঘটের কারণে ৭৫ কোটি ডলারের পণ্য জাহাজীকরণ করতে পারেননি, বলেও জানান তিনি।
শহীদুল্লাহ আজিমের মতে, মাত্র এক বছরে প্রতিকেজি ২.৪ ডলারের সুতার দাম বেড়ে ৪.৮ ডলার হয়েছে। একইসময়ে জাহাজীকরণ ব্যয় বেড়েছে ৩০০ শতাংশ।
কন্টেইনার হ্যান্ডলিং ব্যয় ২৩ শতাংশ বাড়িয়েছে বেসরকারি আইসিডি:
বাংলাদেশ ইনল্যান্ড কন্টেইনার ডিপো অ্যাসোসিয়েশন (বিকডা) কন্টেইনার পরিবহন ও হ্যান্ডলিং খরচ ২০৮৯- ২৬০৫ টাকা বাড়িয়েছে। সাম্প্রতিক জ্বালানির দাম বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে পণ্যবাহী গাড়ি ও আইসিডির বিভিন্ন ইকুইপমেন্টসহ নিজস্ব অন্যান্য আমদানি-রপ্তানি ব্যয় বৃদ্ধির কথা কারণ হিসেবে উল্লেখ করে সমিতিটি।
আগের নিয়মে ২০ ফুট লম্বা সাইজের কন্টেইনার পরিবহন মাশুল ছিলো ১ হাজার ১৫০ টাকা। ২৬৫ টাকা বাড়িয়ে সেটি করা হয়েছে ১৪১৫ টাকা। ৪০ ফুট লম্বা কন্টেইনারের পরিবহন মাশুল ২ হাজার ৩০০ টাকার জায়গায় ২ হাজার ৮৩০ টাকা করা হয়েছে।
গত মঙ্গলবার (৯ নভেম্বর) এক ভার্চুয়াল সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে বিকডার একটি সূত্র জানিয়েছে।
মঙ্গলবারের ভার্চুয়াল সভায় চট্টগ্রামের ১৯টি বেসরকারি আইসিডি মালিকদের সমিতি তাদের প্রদত্ত পাঁচ ধরনের সেবার নতুন মূল্যহার ঘোষণা করে, যা গত ৪ নভেম্বর থেকে কার্যকর করা হয়েছে। অর্থাৎ, ঘোষণার আগেই যেসব ব্যবসায়ীর কন্টেইনার এসব ডিপোতে রয়েছে, তাদের বাড়তি মাশুল গুণতে হবে।
বুধবার বিকডার সভাপতি নুরুল কাইয়ূম খান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "ডিজেল ও কেরোসিনের দাম বাড়ার কারণে পণ্যবাহী গাড়ি ও বেসরকারি আইসিডির বিভিন্ন যন্ত্রপাতির ব্যবস্থাপনা ব্যয় বেড়েছে। মূলত সেগুলো সমন্বয় করতে জ্বালানি সারচার্জ আরোপ করা হয়। যে মাশুল বাড়ানো হয়েছে তা অতিরিক্ত জ্বালানি খরচ সমন্বয়ে ব্যয় হবে।"
রপ্তানি পণ্য বিদেশি ক্রেতার কাছে পৌঁছানোর দায়িত্বে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার অ্যাসোসিয়েশন (বাফা) ও বিজিএমইএ এই সিদ্ধান্তকে 'অযৌক্তিক' বলে উল্লেখ করে জানিয়েছে, এর ফলে আমদানি-রপ্তানি ব্যয় উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বাড়বে।
শীর্ষস্থানীয় জ্যাকেট প্রস্তুতকারক স্নোটেক্স গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এস এম খালেদ বলেন, "কাঁচামাল আমদানির ওপর নির্ভরশীলতা থাকায় আমাদের মুনাফার মার্জিন এমনিতেই কম। তাই হ্যান্ডলিং চার্জ বৃদ্ধি আমাদের ওপর আরেকটি বড় বোঝা।"
আকস্মিক এই সিদ্ধান্তে হতাশা ব্যক্ত করে চট্টগ্রামভিত্তিক ক্লিফটন গ্রুপের সিইও ও পরিচালক এম ডি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী বলেন, "লাগামহীন ভাবে ব্যয় বাড়ছে। পরিস্থিতি বেশ জটিল আকার নিয়েছে। এই সিদ্ধান্ত (মাশুল বৃদ্ধি) আমাদের ব্যবসার ওপর চূড়ান্ত আঘাত।"
"এই প্রবণতা সবখানে দেখা যাচ্ছে। ফলে ব্যবসা পরিচালনার খরচ ক্রমে বাড়ছে। কে এসব নিয়ন্ত্রণ করবে? এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার কোনো আশা দেখছি না"- যোগ করেন তিনি।
এব্যাপারে জানতে চাইলে ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার অ্যাসোসিয়েশনের (বাফা) সহ-সভাপতি খাইরুল আলম সুজন বলেন, "কারো সাথে পরামর্শ না করেই বিকডা মাশুল বাড়িয়েছে। এর ফলে রপ্তানিকারকদের দুর্ভোগ পোহাতে হবে।"
বিজিএমইএর সহ-সভাপতি রকিবুল আলম চৌধুরী বলেন, "এই পদক্ষেপ দেশের আরএমজি খাতকে নতুন সংকটের দিকে ঠেলে দিয়েছে। এই কঠিন সময়ে চার্জ বাড়ানো অযৌক্তিক। আমরা অবিলম্বে বর্ধিত পরিষেবা চার্জ প্রত্যাহারের দাবি করছি।"
৩০ শতাংশ ভাড়া বৃদ্ধির দাবি ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান মালিকদের:
বাংলাদেশ ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান, ট্যাঙ্ক লরি, প্রাইম মুভার মালিক ও শ্রমিক সমন্বয় পরিষদের আহবায়ক রুস্তম আলী খান বলেন টিবিএসকে বলেন, "অন্যরা সবাই তাদের মূল্য ও ভাড়া বাড়িয়েছে, তাই আমরা অন্তত ৩০ শতাংশ ভাড়া বৃদ্ধি চাই।"
তিনি বলেন, আগামী সোমবারের মধ্যে ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান মালিকরা বিজিএমইএ ও বিকেএমইএর সঙ্গে বৈঠক করবেন।
এদিকে, বাংলাদেশ কার্গো ভ্যাসেল অ্যাসোসিয়েশন এবং ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেল (ডব্লিউটিসি) লাইটার জাহাজের ভাড়া বৃদ্ধির ব্যাপারে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে।
এব্যাপারে কার্গো ভ্যাসেল মালিক সমিতির মহাসচিব নুরুল হক জানান, লাইটার জাহাজ শিল্পের কাঁচামাল ও পণ্যদ্রব্য পরিবহন করায় জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির সাথে সামঞ্জস্য রেখেই তারা নতুন ভাড়া নির্ধারণ করবেন।
স্থানীয় পণ্যদ্রব্য পরিবহন ব্যয় ১০ শতাংশের বেশি বেড়েছে:
জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির যুক্তিতে ইতোমধ্যেই দেশের বিভিন্ন রুটে স্থানীয় পণ্য পরিবহনের খরচ ১০ শতাংশের বেশি বাড়িয়েছেন ট্রাক মালিকেরা।
এনিয়ে চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ আড়তদার সাধারণ ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সভাপতি জাহাঙ্গীর আলম বলেন, বেনাপোল স্থলবন্দর থেকে খাতুনগঞ্জ পর্যন্ত ১৩ টন পণ্যবাহী একটি সাধারণ ট্রাকের ভাড়া ২৪ হাজার থেকে বেড়ে ২৬ হাজার টাকা হয়েছে।
ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়বে ১০ শতাংশ:
জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধিতে তাদের ব্যয় ২৫ শতাংশ বৃদ্ধির দাবি করে ভোক্তাপণ্য ও হোম অ্যাপ্লায়েন্স ব্যবসায়ীরা বলছেন, এর ফলে পণ্যের দামও ১০ শতাংশ চড়বে।
প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের মার্কেটিং ডিরেক্টর কামরুজ্জামান কামাল বলেন, "জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধিতে আমাদের ব্যবসা পরিচালনা আরও ব্যয়বহুল হবে, এই বৃদ্ধি কাঁচামালসহ পণ্য উৎপাদনের খরচও বাড়াবে। তার সাথে পরিবহন ব্যয়ও ৩০ শতাংশ বাড়বে।"
এ বাস্তবতায় বাণিজ্যিক গ্রুপটি ১০ শতাংশ পণ্যমূল্য বাড়াবে, যা খুবই সামান্য বলে উল্লেখ করেন তিনি।
দেশের অন্যতম বৃহৎ ভোক্তাপণ্য ব্যবসা- সিটি গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহা জানান, অস্তিত্ব টিকিয়ে থাকার স্বার্থেই তাদের খুচরা মূল্য বাড়াতে হবে।
এক বছরে ৫৭ শতাংশ বেড়েছে উড়োজাহাজের জ্বালানির দর:
নভো এয়ার লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মফিজুর রহমান জানান, উড়োজাহাজের জ্বালানির দাম গত আড়াই মাসে প্রতিলিটারে ১৮ টাকা বেড়েছে। এই বৃদ্ধিকে ভাড়ার সাথে সমন্বয় করতে হবে, কারণ এভিয়েশন পরিচালনা ব্যয়ের ৪০ শতাংশই হয় জ্বালানি ক্রয়ে।
ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনস লিমিটেডের মার্কেটিং সাপোর্ট ও জনসংযোগ বিভাগের মহাব্যবস্থাপক কামরুল ইসলাম বলেন, গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে চলতি নভেম্বর নাগাদ ৯ দফায় জেট ফুয়েলের দাম ৫৭ শতাংশ বেড়েছে। বাড়তি এই ব্যয় সমন্বয় করা ছাড়া এয়ারলাইনগুলোর সামনে কোনো উপায় নেই।
"গত ৫ নভেম্বর নাগাদ প্রতিলিটার জেট ফুয়েলের দাম বেড়ে ৭৭ টাকা হয়েছে। তবে আমরা এখনও এই মূল্য সমন্বয় করিনি"- যোগ করেন তিনি।