পণ্য ও জাহাজ জট বাড়ায় সংকুচিত সরবরাহ চক্র, বিশ্ব অর্থনীতির সামনে অশনি সংকেত
বিশ্ব অর্থনীতির উত্তরণকালে দেখা দিচ্ছে একের পর এক জটিলতা। মহামারি কালে বিশ্বব্যাপী নৌ-বন্দরগুলোয় যে জাহাজ ও পণ্যজট দেখা দিয়েছিল, এবার তা মালামাল বোঝাই ও খালাসের সমস্যাকে আরো তীব্র করে তুলছে। ফলে ব্যাহত হচ্ছে ভোগ্যপণ্য ও কাঁচামালের স্বাভাবিক সরবরাহ। এদিকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ভোক্তা বাজারগুলোয় অচিরেই শুরু হবে বড় দিনের ছুটি উপলক্ষ্যে কেনাকাটার মৌসুম। তার আগেই পণ্যের সংকটে কমতে পারে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের মুনাফা অর্জন, মূল্যস্ফীতিতে ভোক্তারাও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
ব্লুমবার্গের বন্দরজট বিষয়ক ট্র্যাকার সূত্রে জানা যায়, এশিয়ায় টাইফুনের কারণে এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে ব্যাহত হয় শিপিং খাত। বৈশ্বিক জাহাজে পণ্য পরিবহন শিল্পকে এমনিতেই চলতি বছর অনেক সমস্যার মোকাবিলা করতে হবে, রয়েছে নির্ধারিত শিডিউল পিছিয়ে যাওয়ার চাপ। ইতঃপূর্বে, সুয়েজ খালে জাহাজ আটকে পড়া, একাধিক বড় সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড় এবং চীন ও ভিয়েতনামের মতো বৃহৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলোয় কোভিড-১৯ লকডাউনের প্রভাবে নির্ধারিত সময়ে পণ্য পৌঁছে দিতে ব্যর্থ হয় শিপিং কোম্পানিগুলো। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের মতো দেশে ট্রাকচালক ও বন্দর কর্মীর অভাবও তাতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। সঙ্গে ভোক্তাদের ক্রমবর্ধমান চাহিদা তো রয়েছেই।
গত শুক্রবার নাগাদ খারাপ আবহাওয়ার কারণে হংকং বন্দরের অদূরে প্রায় ১০৭টি কন্টেইনারবাহী জাহাজ অপেক্ষা করছিল। গেল সপ্তাহের মাঝামাঝি সময়ে ঘূর্ণিঝড় হংকংকে ছুঁয়ে যাওয়ার পর এই জাহাজজট এমন বিশাল আকার ধারণ করে। ঝড়ের সময় বন্দর ও পুঁজিবাজার বন্ধ রাখে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ।
বন্দরে জাহাজ ভেড়ার পর পণ্য খালাস বা পণ্য বোঝাই শেষ করতে যে সময় লাগে তাকে বলা হয়- 'টার্নএরাউন্ড টাইম'- বিশ্বব্যাপী ৭৭ শতাংশ বন্দরগুলো এই টার্নএরাউন্ড ট্রাফিকে অস্বাভাবিক দেরী হচ্ছে বলে জানিয়েছে আরএবিসি ক্যাপিটাল মার্কেটস।
২০২১ সালের সরবরাহ স্বল্পতাগুলো আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, বিশ্বের এক প্রান্তের সরবরাহ চক্রে সংকোচন, আরেক প্রান্তে জাহাজ জটকে ভয়াবহ রুপ দিতে পারে। যা সৃষ্টি করে চাহিদামতো পণ্যের শূন্যতা। সেকারণেই হংকং- এ খারাপ আবহাওয়ার প্রভাব জাহাজ শিল্পের জন্য নতুন দুঃসংবাদ।
এব্যাপারে হংকং ভিত্তিক অনলাইন শিপিং মার্কেটপ্লেস ফ্রেইটোস ডটকমের গবেষণা শাখার প্রধান জুডা লেভাইন বলেন, "চীনে যদি এখন জট কমেও যায়, তাহলে লস অ্যাঞ্জেলস ও লং বিচের মতো বন্দরে অপেক্ষমান জাহাজের সাড়ি দীর্ঘ হবে। নৌযান বন্দরে নির্ধারিত সময়ে পৌঁছাতে দেরী হওয়ার ফলেই এমন সমস্যা তৈরি হয়।"
এর আগে গত সপ্তাহে লস অ্যাঞ্জেলস বন্দর সাপ্তাহিক ছুটির দিনসহ দিনরাত ২৪ ঘণ্টা সচল রাখার নির্দেশ দেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন।
ইউরোপও স্বস্তিতে নেই। যুক্তরাজ্যের অন্যতম প্রধান বন্দর ফেলিক্সটোয়ি'তে ফেরত পাঠানোর জন্য রাখা খালি কন্টেইনারের স্তূপ এত বেড়েছে যে একটি কন্টেইনারবাহী জাহাজকে গতিপথ বদলে ইউরোপের মূল ভুখন্ডের বন্দরে যেতে হয়েছে।
এসব ঘটনা জাহাজ শিল্পের সঙ্গে সঙ্গে বিশ্ব অর্থনীতির জন্যও দুঃসংবাদ। বড়দিনের ছুটি উপলক্ষ্যে এতে করে ভোক্তারা প্রিয়জনদের জন্য পছন্দসই উপহার কিনতেও পারবেন না বলে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। যার চরম আঘাত আসবে খুচরা বিক্রিবাট্টায়।
চিন্তাগ্রস্ত বৃহৎ কোম্পানিগুলোর নির্বাহীরাও। টেসলা ইঙ্ক ও টার্গেট কর্প-সহ এসঅ্যান্ডপি-৫০০ ভুক্ত কোম্পানির নির্বাহীরা গত মঙ্গলবার নাগাদ রেকর্ড তিন হাজার বার 'সরবরাহ চক্র' শব্দজোড়া নিজেদের উপস্থাপনায় উল্লেখ করেন। যা ছিল তাদের উদ্বেগের স্পট বহিঃপ্রকাশ।
এব্যাপারে জেপি মরগ্যান চেজ অ্যান্ড কোং- এর জ্যেষ্ঠ বৈশ্বিক অর্থনীতিবিদ মাইকেল হ্যানসনের মন্তব্য, "সমুদ্র ও আকাশপথে পণ্য পাঠানোর খরচ বৃদ্ধি, কন্টেইনার সংকট, পরিবহন ব্যবস্থাপনা পয়েন্টগুলোর জটিল তথ্য বলছে বিশ্ব অর্থনীতি সরবরাহ স্বল্পতার মধ্যে পড়েছে।"
গত শুক্রবার হংকং ও শেনঝেন বন্দরে যে বিশাল জাহাজের সাড়ির রেকর্ড দেখা যায়, তা ছিল অভূতপূর্ব। অপেক্ষমান জাহাজের বর্তমান সংখ্যা এমনকি মে'র ঘটনাকেও ছাড়িয়ে গেছে। ওই সময় কোভিড-১৯ বিস্তার রোধে শেনঝেন ও লানতিয়ান বন্দর এলাকায় লকডাউনের প্রভাব পড়েছিল।
ঝড়ের প্রভাব এশিয়ার আরেক বন্দরনগরী সিঙ্গাপুরেও আছড়ে পড়েছে। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মধ্যে বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ পথে অবস্থিত এ বন্দর। কিন্তু, সেখানেও এখন অপেক্ষমান জাহাজের দীর্ঘ লাইন। গত ২১ জুলাইয়ের পর যা সবচেয়ে বেশি। জুলাই মাসে চীনের সাংহাইতে আঘাত হানে টাইফুন ইন-ফা। ফলে সেসময় জাহাজের ভিড় বাড়ে সিঙ্গাপুরের বহির্নোঙরে।
এসব সামুদ্রিক ঝড় বা টাইফুন এশিয়ার তীব্র চাপে থাকা বন্দরগুলোর শ্বাসরোধ করার উপক্রম করছে। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের বন্দর অবকাঠামোগুলোর সক্ষমতাও কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন। একসাথে মাত্রাতিরিক্ত পণ্য খালাস করার সময় দেখা যাচ্ছে ট্রাক চালকের অভাব, রেলে পরিবহন ও গুদামজাতকরণের সমস্যা।
মহামারি থেকে উত্তরণকে ব্যাহত করতে পারে বাণিজ্যের এই শনির দশা। তবে তার চেয়েও বড় শঙ্কা- মূল্যস্ফীতির চাপে একবার ভোক্তা ব্যয় সংকোচন শুরু হলে মার খাবে অর্থনীতির ঘুরে দাঁড়ানোর প্রক্রিয়া। আর মূল ভয়টাও সেখানেই।
- সূত্র: ব্লুমবার্গ থেকে অনূদিত