বিশ্ব অর্থনীতির মন্থর দশার মধ্যে সবাই মধ্যপ্রাচ্যের টাকার পেছনে ছুটছে
মার্চের শুরুতেই আবুধাবিতে অনুষ্ঠিত হয় 'ইনভেস্টোপিডিয়া এক্স সল্ট' কনফারেন্স। বিশ্বের আর্থিক খাতের শীর্ষ কর্মকর্তা ও বিনিয়োগ খাতে পরিবর্তনের অগ্রপথিকদের মিলনমেলা এ সম্মেলন। খবর সিএনবিসির
এ আয়োজন- দুবাইয়ের শাসক শেখ মোহাম্মদ বিন রশিদ আল মাখতুম এবং মার্কিন অর্থায়নকারী ও হোয়াইট হাউসের সাবেক প্রেস সচিব অ্যান্থনি স্কারামুচ্চির চিন্তার ফসল। আন্তর্জাতিক আর্থিক খাতের নেতৃত্বদানকারীরা এতে যোগ দেন। সুবৃহৎ বিনিয়োগ ব্যাংক, বড় বড় তহবিল, ঋণ-উদ্যোক্তারা এখানে যোগ দেন বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগের পুঁজি সংগ্রহে।
সম্মেলনে এক হাজার অতিথি আসবেন ধারণা করে প্রস্তুতি নেওয়া হলেও, শেষপর্যন্ত এসেছিল আড়াই হাজার। এর অন্যতম কারণ, বৈশ্বিক বিনিয়োগ তহবিলগুলো মধ্যপ্রাচ্যের অর্থকড়ির জন্য হন্যে হয়ে উঠেছে।
আর্থিক দুনিয়ার এতজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির জন্য যথাযথ ব্যবস্থা করতে হিমশিমই খেতে হয় আয়োজকদের, যেহেতু সংখ্যাটা তাদের প্রত্যাশারও বেশি ছিল।
আয়োজকদের একজন মার্কিন গণমাধ্যম সিএনবিসিকে বলেন, 'আমরা কিছুটা বিহ্বল হয়েছিলাম এটা ঠিক, তারপরও এটা বেশ ভালো লক্ষণ'।
বিরক্ত হয়েছেন অন্যরা। আয়োজনের সাথে যুক্ত দুবাই-ভিত্তিক একটি বিনিয়োগ তহবিলের ব্যবস্থাপক বলেন, 'সবাই উপসাগরীয় অঞ্চলে টাকা ভিক্ষা করতে ছুটে এসেছে, বিব্রতকর একটা অবস্থা'।
তবে পেশাজনিত বিধিনিষেধের কারণেই দুটি সূত্রই নাম না প্রকাশের শর্তে এমন মন্তব্য করেছে।
তেল ও গ্যাসের মতো জ্বালানি সম্পদে সমৃদ্ধ উপসাগরীয় দেশগুলোর যে বিপুল অর্থসম্পদ- তা নতুন কিছু নয়। এই অঞ্চলের ১০টি সার্বভৌম তহবিল প্রায় ৪ লাখ কোটি ডলারের নগদ অর্থ ও বিনিয়োগ সম্পদ ব্যবস্থাপনা করে বলে জানিয়েছে সভরেন ওয়েলথ ফান্ড ইনস্টিটিউট। এই বিপুল বিত্ত ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্যের মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির চেয়েও বেশি। মধ্যপ্রাচ্যের বিত্তশালীদের ব্যক্তিগত টাকা না ধরেই এ হিসাব। যোগ করলে কী দাঁড়াবে সেটা আর বলাই বাহুল্য।
আর্থিক শিল্পের অভ্যন্তরীণরা বলছেন, ভেঞ্চার ক্যাপিটালিস্ট (যারা নতুন উদ্যোগে বিনিয়োগকারী); নব-উদ্যোগের প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রাতিষ্ঠানিক বিদেশি বিনিয়োগকারীদের এই ঝাঁক বেঁধে আবুধাবি এসে ফিনটেক, ডিজিটাল রুপান্তর ও নবায়নযোগ্য প্রযুক্তিতে পুঁজি লগ্নী নিয়ে আলোচনা ও চুক্তির উদ্যোগ– এই খাতে উপসাগরীয় অঞ্চলের উন্নতির-ই লক্ষণ।
সিএনবিসিকে দুবাই-ভিত্তিক বিনিয়োগ ব্যাংক আওয়াদ ক্যাপিটালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও পার্টনার মার্ক নাসিম বলেন, 'আগে উপসাগরীয় অঞ্চল থেকে পুঁজি কেবল বাইরেই যেত, এখন এখানেও বিনিয়োগ আসছে। বলতে পারেন, অর্থের দ্বিমুখী প্রবাহই দেখা যাচ্ছে'।
সার্বভৌম তহবিলগুলোর মতো রাষ্ট্রায়ত্ত বিনিয়োগকারীর পাশাপাশি বিত্তবান পরিবারগুলোও এখন আগের থেকে অনেক বেশি চৌকস হয়েছে (মার্ক নাসিম- পার্টনার ও এমডি আওয়াদ ক্যাপিটাল)
ইউক্রেন যুদ্ধ ঘিরে ইউরোপ যখন উত্তাল, তারমধ্যেই মধ্যপ্রাচ্যের এ অঞ্চলের স্থিতিশীলতাও আর্থিক খাতকে আকৃষ্ট করছে। তেমন মন্তব্যই করেন স্টেফেন হেলার। তিনি জার্মানি-ভিত্তিক ভেঞ্চার ক্যাপিটাল সংস্থা আলফাকিউ এর প্রতিষ্ঠাতাকালীন পার্টনার।
সিএনবিসিকে তিনি বলেন, 'বর্তমানে ইউরোপের যে দশা তার চেয়ে মধ্যপ্রাচ্যকে বেশি স্থিতিশীল মনে হচ্ছে। ইউরোপে নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে, অর্থনৈতিক বৈষম্য দিন দিন আরো বাজে রূপ নিচ্ছে…অন্যদিকে উপসাগরীয় দেশগুলো আরো একজোট হচ্ছে'।
আলফাকিউ সুবৃহৎ একটি তহবিল, যারা জলবায়ু প্রযুক্তি, অবকাঠামো, স্বাস্থ্য, ফিনটেক (আর্থিকপ্রযুক্তি) এর মতো বড় মেগাট্রেন্ডগুলোয় বিনিয়োগ করে। সম্প্রতি মধ্যপ্রাচ্যে তাদের প্রথম অফিস খুলেছে আবুধাবিতে।
হেলার আরো বলেন, 'সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে আজ উদ্যোমী শক্তিকে অনুভব করা যায়। আমি সম্ভাবনাই দেখছি, কারণ এখানে যে পুঁজি আছে তাকে কার্যত অগাধ বলা যায়। আরো উদ্যোক্তারা যদি এখানে আসেন, তাহলে বড় ফলাফল পাবেন'।
পুঁজির পিছু ছোটা
গত দুই বছরে বিশ্ববাজারে বেড়েছে জ্বালানি তেলের দাম, এতে অগাধ অর্থ আসে উপসাগরীয় দেশগুলোর রাষ্ট্রায়ত্ত বিনিয়োগ তহবিলে। এই অর্থ তারা বিপুলভাবে ব্যয়ও করেছে। গত বছরে আবুধাবির আদিয়া, এডিকিউ, মুবাদালা; সৌদি আরবের পিআইএফ এবং কাতারের কিউআইএ ৭৩ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে বলে জানায় বৈশ্বিক রাষ্ট্রায়ত্ত তহবিল অনুসরণকারী গ্লোবাল এসডব্লিউএফ।
মধ্যপ্রাচ্যে যখন রমরমা তখন ২০২১ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে বৈশ্বিকভাবে সার্বভৌম তহবিলের সম্পদমূল্য ১১.৫ ট্রিলিয়ন থেকে কমে ১০.৬ ট্রিলিয়ন ডলারে নেমে আসে বলেও জানায় গ্লোবাল এসডব্লিউএফ। বিশ্বব্যাপী প্রধান অর্থনীতিগুলোর পুঁজিবাজার ও বন্ডবাজারের মন্দাবস্থায় সরকারি পেনসন তহবিলের অধীন সম্পদের মূল্যও কমে।
এই সুযোগে মধ্যপ্রাচ্যের বিনিয়োগকারীরা এগিয়ে আসেন গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোয় উদ্যোগ নিয়ে। গ্লোবাল এসডব্লিউএফ জানাচ্ছে, 'এসময়ে সবচেয়ে সক্রিয় বিনিয়োগ সংস্থার প্রতি পাঁচটির মধ্যে একটিই ছিল মধ্যপ্রাচ্যের (বিশেষত- উপসাগরীয় অঞ্চলের)। গ্লোবাল এসডব্লিউএফ তাদের প্রতিবেদনে আরো জানিয়েছে যে, 'বর্তমানে বৈশ্বিক হেজ ফান্ডের সর্ববৃহৎ সরবরাহকারী হলো আবুধাবির আদিয়া। করোনা মহামারির সময় জিসিসি (গালফ কো-অপারেশন কাউন্সিল)-ভুক্ত দেশগুলির সার্বভৌম তহবিল আন্তর্জাতিক বিনিয়োগে অগ্রণী ভূমিকা রাখে। ২০২২ সালে বৈশ্বিক আর্থিক খাতের অবনতির সময়েও তারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে'।
তাই বাকি বিশ্বে উপসাগরীয় পুঁজির ব্যাপক উচ্চ-চাহিদা তৈরি হয়েছে একথা বলা মোটেও অত্যুক্তি নয়।
এই চাহিদা কতোটা, পেশাগত কারণেই নাম না প্রকাশের শর্তে সে সম্পর্কে বলেন আমিরাতের একটি বিনিয়োগ তহবিলের একজন ব্যবস্থাপক। তিনি সিএনবিসিকে বলেন, 'বিশ্বের অনেক স্থানেই এখন পুঁজির স্বল্পতা দেখা দিয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিক পশ্চিমা বিনিয়োগকারীরাও রয়েছেন একপ্রকার অচলাবস্থায়। সে তুলনায় এই অঞ্চলে (উপসাগরীয় দেশগুলোয়) বিপুল পুঁজি আছে। আমাদের কাছে বিনিয়োগ চেয়ে এত ফোন আসছে যে সবাইকে সাড়া দিতেই হিমশিম অবস্থা'।
অলস টাকা আর নয়
উপসাগরীয় অঞ্চলকে বিদেশি কোম্পানিগুলো এতদিন তাদের জন্য অলস টাকার উৎস বলেই মনে করতো। তাদের এই ধারণাও ছিল, সঠিক বিচারবিবেচনা ছাড়াই অলস এই অর্থ বিনিয়োগ করা হয়। একেবারে ভুলও ছিল না সে ধারণা। কিন্তু, গত কয়েক বছরে তা পাল্টাতে শুরু করেছে।
আগে মধ্যপ্রাচ্যের শেখদের শাসিত রাষ্ট্রগুলো পশ্চিমা যে কোম্পানি এসে হাত পাততো তাকেই বিপুল অর্থ দিত। কিন্তু, এখন তারা বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত নিয়ে কৌশলী হতে শিখছে। কোম্পানির সম্ভাবনাও খতিয়ে দেখছে। সবাই যখন উপসাগরীয় অঞ্চলের পুঁজি চায়– তখন যাচাইবাছাইয়ের ক্ষেত্রেও দক্ষতা বাড়ছে তাদের। বর্তমানে তারা আগে থেকেই অনেক ধরনের সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেয় এবং আগের চেয়ে বেশি বিবেচনার পর বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নিচ্ছে।
আওয়াদ ক্যাপিটালের নাসিম বলেন, "ধরুন আপনি আগে এসে সহজেই নিজের পরিচয় দিয়ে বলতে পারতেন- 'আমি সান ফ্রান্সিসকোর একটি তহবিল ব্যবস্থাপক। অনুগ্রহ করে আমাদের কোম্পানিতে কয়েক মিলিয়ন ডলার দিন'। আর সেটা আপনি পেয়েও যেতেন। সার্বভৌম তহবিলগুলোর মতো রাষ্ট্রায়ত্ত বিনিয়োগকারীর পাশাপাশি- বিত্তবান পরিবারগুলোও এখন আগের থেকে অনেক বেশি চৌকস হয়েছে। কাউকে চেক লিখে দেওয়ার আগে তারা ভালোভাবে খোঁজখবর নিচ্ছেন। আর নেওয়ারই কথা, কারণ যুক্তরাষ্ট্র, লাতিন আমেরিকা, ইউরোপ, দক্ষিণপূর্ব এশিয়া থেকে শুরু করে- বিশ্বের তাবড় তাবড় বিনিয়োগ তহবিলগুলো পুঁজি চাইতে এখানে আসছে। আমার ধারণা, তাদের মধ্যে মুষ্টিমেয় কিছু তহবিলই এখান থেকে টাকা নিয়ে যেতে পারবে– কারণ এখানকার ধনীরা বিনিয়োগের বিষয়ে সুচিন্তিত হতে শিখেছেন।
উপসাগরীয় অঞ্চলগুলোর মধ্যে বিশেষত আমিরাত এদিক দিয়ে অগ্রণী কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। দেশটির আর্থিক খাতে ব্যাপক সংস্কার, করোনা মহামারি মোকাবিলার ক্ষেত্রে প্রশংসনীয় সাফল্য এবং রাশিয়া, ইসরায়েলসহ যেকারো সাথে ব্যবসা করার আগ্রহ– বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে আমিরাতের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছে।
সৌদি আরবেও অর্থায়নকারীরা অনেক সম্ভাবনা দেখছেন। দেশটির দিনে দিনে বিকাশমান বাজার, ৪ কোটি জনসংখ্যা যাদের ৭০ শতাংশেরই বয়স আবার ৩৪ বছরের নিচে– সম্ভাবনার আলো দেখাচ্ছে।
তবে জিসিসি-ভুক্ত দেশগুলোর সিংহভাগ তহবিল এখনও যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের মতো উন্নত অর্থনীতির বাজারগুলোয়। তহবিল ব্যবস্থাপকরা বলছেন, এসব অঞ্চলে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে প্রচলিত ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি, জলবায়ু প্রযুক্তি, জৈবপ্রযুক্তি, কৃষিপ্রযুক্তি ও ডিজিটাল রুপান্তরের মতো খাতকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়।
উপসাগরীয় অঞ্চলে অর্থের এই বিপুল উপস্থিতি যে জ্বালানি তেলের চড়া দামেরই সুবাদে- সেটাও ভুলে গেলে চলবে না। এ ধরনের পণ্য বা কাঁচামাল-ভিত্তিক অর্থনীতিতে সুবাতাস যেকোনো সময় পতনের দিকেও যেতে পারে। এজন্যই বাড়তি সম্পদের ওপর সাম্প্রতিক সময়ে উপসাগরীয় দেশগুলো নতুন কর আরোপ করেছে। পাশাপাশি সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত বিকল্প আয়ের উৎস তৈরির জন্য ব্যাপক বিনিয়োগও করছে, যার সুফল দীর্ঘমেয়াদে পাওয়ার আশা করছে।
নাসিম বলেন, 'বর্তমান অবস্থার ছন্দপতন ঘটবে যদি তেলের দাম আরও পড়ে যায়, তখন অনেক সার্বভৌম তহবিলকেই তাদের অর্থ দিয়ে সরকারের বাজেট পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সহায়তা দিতে হবে। এই অঞ্চলে কোনো যুদ্ধ বা সংঘাত অথবা বিপ্লবের ফলেও তেমন পরিস্থিতি দেখা দেওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।'
'তাছাড়া, তেলের দাম কমলে বাড়তি যে অর্থ সার্বভৌম তহবিলে জমা হয়, সেটাও আর তারা পাবে না। তখন তাদের বিনিয়োগও কমাতে হবে। একইসঙ্গে, উচ্চ মুনাফা দেয় এমন সম্পদে বিনিয়োগ করতে হবে'- যোগ করেন তিনি।
এই বাস্তবতায়, সুবাতাস থাকতে থাকতেই যেসব কোম্পানি মধ্যপ্রাচ্যের বিনিয়োগ চায়– তাদের জন্য সেটা নিয়ে নেওয়াই হবে প্রজ্ঞার পরিচয়।