বাইকে বিপুল ছাড়, গ্রাহকের উন্মত্ত অর্ডারই ইভ্যালির পতনকে ত্বরান্বিত করেছে
বাজারের অন্যান্য কোম্পানির সাথে ক্ষতিকর প্রতিযোগিতা করে কমদামে পণ্য, বিশেষত বিশাল ছাড়ে মোটরবাইক বিক্রির অফার দেওয়াই শেষপর্যন্ত ইভ্যালির জন্য কাল হয়েছে, যা কোম্পানির ব্যবসাকে পথে বসায় বলে পুলিশকে জানিয়েছেন ইভ্যালির প্রধান নির্বাহী (সিইও) মোহাম্মদ রাসেল।
রাসেলকে জিজ্ঞাসাবাদকারী কর্মকর্তারা বলেছেন, মোটরসাইকেল কিনতে অগ্রিম টাকা খরচ করা এসব গ্রাহকদের একটা বড় অংশের লোকজনই সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, বিশেষ করে দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণির।
গত তিন বছরে আর্থিক কেলেঙ্কারিতে যুক্ত প্রতিষ্ঠানটিতে গ্রাহকরা প্রায় দুই লাখ মোটরসাইকেল অর্ডার করেন, যার বেশিরভাগই প্রতিষ্ঠানটি ডেলিভারি দিতে পারেনি।
জিজ্ঞাসাবাদে জড়িত ধানমন্ডি থানার এক পুলিশ কর্মকর্তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "আমরা এমনও গ্রাহক পেয়েছি যিনি মোটরসাইেকলই চালান না, অথচ প্রায় ১৬-১৭টি মোটরসাইকেল একজনের অ্যাকাউন্ট থেকেই অর্ডার করা হয়েছে। নিঃসন্দেহে তিনি এগুলো ব্যবহার করতে অর্ডার করেননি, আমরা পরে খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছি এসব মোটরসাইকেলের বেশিরভাগই আবার শোরুমে কম দামে বিক্রি হয়ে যেত।"
তদন্তকারীরা বলেন, দেশে বিআরটিএ নিবন্ধিত মোটরসাইকেলের সংখ্যা প্রায় ছয় লাখের মতো। তবে, মাত্র তিন বছরে আরো প্রায় দুই লাখ মোটরসাইকেল শুধু ইভ্যালিতেই অর্ডার পড়েছে, যা দেশের মোটরবাইকের বাজারে বিরূপ প্রভাব তৈরি করে।
রাসেলের উদ্ধৃতি দিয়ে পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, "আমরা ধীরে ধীরে ব্যবসায় লাভ করতে ছাড়ের (ডিসকাউন্ট) পরিমাণ কমিয়ে আনছিলাম, তবে ধামাকা, ই-অরেঞ্জের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো রাতারাতি অস্থির পরিবেশ তৈরি করে, যার কারণে আমাদের ক্ষতিগ্রস্ত হতে হয়েছে।"
পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, রিমান্ড চলাকালে রাসেলের দেওয়া এসব তথ্য তারা ইভ্যালির সার্ভার থেকে পাওয়া তথ্যের সাথে যাচাই-বাছাই করে মিলিয়ে দেখছেন।
#১,০০০ কোটি টাকা দেনা, অর্থপাচার সম্পর্কিত প্রশ্নের জবাব দেননি রাসেল
এদিকে, গত তিন বছরে প্রায় সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকার পণ্য বা সেবা নিতে গ্রাহকরা ইভ্যালিতে অর্ডার-বুক করেছেন, যার প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকার পণ্য সরবরাহ করতে পেরেছেন বলে পুলিশের কাছে দাবি করেছেন ইভ্যালি সিইও।
কিন্তু, এতে ১ হাজার কোটি টাকার ঘাটতি তৈরি হওয়ায় কোম্পানির আর্থিক দশা শোচনীয় হয়ে পরে। এরমধ্যে গ্রাহকদের প্রায় ৭০০ কোটি টাকা ও মার্চেন্টদের কাছে দেনা রয়েছে ২৫০ কোটি টাকা। এর বাইরে বিজ্ঞাপন ও প্রচারণা বাবদ আরো ৫০ কোটি টাকার মতো দেনা আছে বলেও পুলিশের কাছে স্বীকার করেছেন রাসেল।
রাসেল আরও দাবি করেন, সাভারে গুদামের জন্য কয়েক শতাংশ জমি ছাড়া তার ঢাকা ও ঢাকার বাইরে কোন সম্পদ নেই।
এমনকি তিনি মোহাম্মদপুরে ভাড়া অ্যাপার্টমেন্টে থাকতেন বলেও পুলিশের কাছে বলেছেন। বরবারই তিনি দেশের বাইরে টাকা পাচারের বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন।
# দোষ চাপিয়েছেন গণমাধ্যমের ওপর
গণমাধ্যমের নেতিবাচক খবর প্রকাশের কারণেই তাঁকে শেষপর্যন্ত গ্রেপ্তার হতে হয়েছে বলে জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন ইভ্যালি সিইও।
একইসাথে বাজারে তার মডেল অনুকরণ করে ধামাকা, ই-অরেঞ্জসহ আরো বেশ কয়েকটি ই-কমার্স কোম্পানি হুট করে বাজারে চলে আসায় ইভ্যালিকে বেশি ছাড়ে পণ্য দিয়ে মার্কেটে টিকে থাকতে বাধ্য করা হয় বলেও পুলিশকে জানান রাসেল।
এদিকে, ধানমন্ডি থানার আরেক মামলায় ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ইভ্যালি ডটকম লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মো. রাসেলকে জেলগেটে জিজ্ঞাসাবাদ করার নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। ধানমন্ডি থানা-পুলিশের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালত বৃহস্পতিবার এ আদেশ দেন।
ডিএমপির ধানমন্ডি জোনের সহকারী কমিশনার আবদুল্লাহ আল মাসুম টিবিএস'কে বলেন, "এখন পর্যন্ত রাসেলের বিরুদ্ধে রাজধানীর গুলশান থানায় একটি এবং ধানমন্ডি থানায় দুটি মামলা হয়েছে। এর বাইরে বুধবার ঢাকার সিএমএম আদালতেও একজন গ্রাহক মামলা করেছেন বলে জানতে পেরেছি। ধানমন্ডি থানার দ্বিতীয় মামলাটি হয় ২১ সেপ্টেম্বর। আবদুর রহমান নামের এক গ্রাহক মামলাটি করেন। তাঁর অভিযোগ, দুটি মোটরসাইকেল কেনার জন্য ইভ্যালিকে টাকা দিয়েও তিনি নির্দিষ্ট সময়ে পণ্য বা টাকা ফেরত কোনোটিই পাননি।"
ধানমন্ডি থানায় ১৯ সেপ্টেম্বর করা মামলায় এক দিনের রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে রাসেলকে বৃহস্পতিবার দুপুরে আদালতে হাজির করা হয়।
এরপর তাঁকে ধানমন্ডির অপর মামলায় আরও পাঁচ দিন রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন করে পুলিশ। আদালত উভয় পক্ষের শুনানি নিয়ে রাসেলকে রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন নাকচ করেন। তবে রাসেলকে তিন কার্যদিবসের মধ্যে জেলগেটে জিজ্ঞাসাবাদ করার নির্দেশ দেন আদালত।