জ্বালানি মজুদ সন্তোষজনক, ভবিষ্যৎ সরবরাহ নিয়েও উদ্বেগ নেই: বলছেন কর্মকর্তারা
জ্বালানি তেলের আগামী ছয় মাসের সরবরাহ দেশে আনার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। মাসিক চালান আসার সময়ও নির্ধারিত, আর তার সাথে আমদানি বিল মেটাতে অতিরিক্ত সহায়তার প্রতিশ্রুতি মেলায়–বাংলাদেশের জ্বালানি মজুদের পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো কিছু নেই। জ্বালানি সাশ্রয়ে সরকারি পদক্ষেপ ঘোষণার এক সপ্তাহ পর, এমনটাই জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি) জানিয়েছে, তাদের কাছে ডিজেল ও ফার্নেস অয়েলের ৩২ দিনের মজুদ রয়েছে। আগামী এক-দুই দিনের মধ্যে আরও ৫০ হাজার টন পরিশোধিত তেল আসবে। বৈশ্বিক একটি দাতা সংস্থার কাছ থেকেও অতিরিক্ত ৫০ কোটি ডলার ঋণ পাচ্ছে বিপিসি, যা জ্বালানি আমদানির বিল মেটাতে কিছুটা স্বস্তির সুযোগ দেবে।
জ্বালানি মন্ত্রণালয় দাবি করেছে, আগামী ছয় মাসের চাহিদা মেটানোর মতো তেল আমদানি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
বুধবার (২৭ জুলাই) এক ঘোষণায় বিপিসি জানায়, দেশে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত জ্বালানি পণ্য- ডিজেল ও ফার্নেস অয়েলের ৩২ দিনের মজুদ রয়েছে। অকটেন, পেট্রল ও জেট ফুয়েলের মজুদ রয়েছে যথাক্রমে- ৯, ১৫ ও ৪৪ দিনের।
বিপিসি চেয়ারম্যান এবিএম আজাদ গণমাধ্যমকে বলেছেন, আগামী দুই-এক দিনের মধ্যে আরও ৫০ হাজার টন পরিশোধিত তেল দেশে আসবে। আগামী ছয় মাসের তেল আমদানির পরিকল্পনাও জানান তিনি, যা চক্রকারে চলতে থাকে।
তিনি বলেন, জ্বালানি মজুদ আজ কম মনে হতে পারে, কিন্তু তিনদিন পর তা অনেক বাড়বে। এটা চক্রাকারে পূরণের বিষয়। প্রতিদিনের মজুদই ওঠানামা করে'।
এদিকে গতকাল মন্ত্রিসভার ক্রয়-সংক্রান্ত কমিটি স্থানীয় গ্যাসক্ষেত্রের উৎপাদন বাড়ানোর জন্য দুটি গ্যাস অনুসন্ধান এবং উৎপাদন প্রকল্পের অনুমতি দেয়। এসব প্রকল্পের কাজ শেষ হলে আগামী বছরে জাতীয় গ্রিডে গ্যাস সরবরাহের উন্নতি ঘটবে।
৪৫ দিনের সরবরাহ মজুদ রাখে বিপিসি
বিপিসির সূত্র জানায়, দেশে প্রতি মাসে প্রায় ৫ লাখ থেকে ৫.২০ লাখ টন বিভিন্ন ধরনের জ্বালানি ব্যবহৃত হয়- যার ৭৬ শতাংশ পূরণ হয় আমদানির মাধ্যমে।
এর ৫০ শতাংশ ক্রয় করা হয় সরকার-থেকে-সরকার (জিটুজি) চুক্তির মাধ্যমে এবং বাকি ৫০ শতাংশ উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে।
চুক্তির আওতায় বিপিসি প্রতি মাসে প্রায় ১৬-১৭টি জ্বালানি বোঝাই ট্যাঙ্কার গ্রহন করে।
দৈনিক চাহিদা ও সরবরাহ মেটানোর পাশাপাশি বিপিসি সাধারণত ৪৫ দিনের মজুদ রক্ষা করে।
দেশে জ্বালানির মজুদ নিয়ে কিছু গুজব ছড়িয়ে পড়ায়, বিপিসি গতকাল আশ্বাস দিয়েছে যে তাদের কাছে যথেষ্ট মজুদ আছে। আগামী আগস্ট মাসে ১৫-১৬টি জ্বালানি বোঝাই কার্গো আমদানির পরিকল্পনা রয়েছে, যার প্রতিটিতে ২৫-৩০ হাজার টন জ্বালানি বহনের সক্ষমতা রয়েছে।
বিপিসির চেয়ারম্যান এবিএম আজাদ সংবাদ সম্মেলনে বলেন, জ্বালানি মজুদ নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কোনো কারণ নেই।
'আজ (বুধবার) আমাদের ৩২ দিনের ডিজেল চাহিদা পূরণ করার মতো মজুদ রয়েছে। এই সময়ের পরে দেখবেন যে অতিরিক্ত ৪ লাখ টন ডিজেল মজুদ করা হবে। প্রতি মাসে আমাদের ৬ লাখ টন সব ধরনের জ্বালানি মজুদ রাখতে হয়'- বলেন তিনি।
রিফিলিং পাম্পে জ্বালানি বিক্রিতে সীমা আরোপ করা হয়েছে এমন অভিযোগের জবাবে তিনি বলেন, জ্বালানি তেল বিক্রিতে কোনো সীমা আরোপের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি।
আমদানি বিলের চাপ নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ডলার সংকটের কারণে তারা এলসি খুলতে কিছুটা সমস্যায় পড়েছেন।
'তবে, এই সমস্যাটিও সমাধান হতে চলেছে কারণ আমরা ঋণদাতাদের কাছ থেকে অর্থায়ন পাওয়ার চেষ্টা করছি।'
দীর্ঘমেয়াদী ঋণদানকারী অংশীদার ছাড়াও, বিপিসি এখন স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক থেকে অর্থ নিতে চায় এবং সেলক্ষ্যে একটি আলোচনাও চলছে, বলে তিনি জানান।
কোনো সংকট নেই, বলছে মন্ত্রণালয়
বুধবার পৃথক এক বিবৃতিতে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, দেশের আগামী ছয় মাসের চাহিদা পূরণের জন্য যথেষ্ট পরিমাণ জ্বালানি তেল আমদানি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
এতে বলা হয়, 'দেশে জ্বালানি তেলের মজুদ নিয়ে একটি স্বার্থান্বেষী মহল অসত্য ও মনগড়া তথ্যপ্রচার করছে, যা সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করছে'।
জ্বালানির মজুদ নিয়ে গুজবকে নাকচ করে মন্ত্রণালয় বলেছে, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের আওতাধীন কোম্পানিগুলোর ডিপোতে পর্যাপ্ত পরিমাণ জ্বালানি তেল মজুদ রয়েছে। আরও আমদানির উদ্যোগ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
বিবৃতিতে আশ্বস্ত করে বলা হয়, বর্তমানে দেশে জ্বালানি তেলের কোনো ঘাটতি বা সংকট নেই। আমদানি পরিকল্পনা অনুসারে, আগামী ছয় মাস দেশে জ্বালানি তেলের চালান আসবে।
তাই সংকটের কোনো আশঙ্কাও নেই উল্লেখ করেছে মন্ত্রণালয়। একইসঙ্গে, সকলের প্রতি ভর্তুকি মূল্যে সরবরাহ করা জ্বালানি তেল ব্যবহারে আরও সাশ্রয়ী হওয়ার আহ্বান জানিয়েছে।
আইআইটিএফসি বিপিসিকে আরও তহবিল দেবে
ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (আইডিবি) গ্রুপের সদস্য ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ট্রেড ফাইন্যান্স কর্পোরেশন (আইআইটিএফসি)-র মাধ্যমে অপরিশোধিত তেলের (ক্রুড) আমদানি বিল মেটায় বিপিসি।
সাধারণত প্রতি অর্থবছরে বিপিসি সংস্থাটি থেকে ৮০ কোটি ডলার সহায়তা নেয়। তবে চলতি অর্থবছরে সংস্থাটি ১৪০ কোটি ডলার সহায়তার অনুমোদন দিয়েছে বলে জানিয়েছে বিপিসির সূত্র।
সূত্রগুলি জানিয়েছে, সাধারণ অর্থায়ন সুবিধার সঙ্গে বিপিসি চলতি অর্থবছরের জন্য অতিরিক্ত ১০০ কোটি ডলার সহায়তা চায়, এরমধ্যে ৫০ কোটি ডলার দিতে সম্মত হয়েছে আইআইটিএফসি।
এই অর্থায়নের সুবাদে এখন কোনো সমস্যা ছাড়াই আমদানির এলসি খুলতে পারবে বিপিসি।
গ্যাস উৎপাদনের উদ্যোগে গতি আনছে সরকার
তরল জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করার সাথে সাথে, সরকার স্থানীয় ক্ষেত্রে গ্যাস উৎপাদন বৃদ্ধির উদ্যোগের পরিধিও বাড়িয়েছে বুধবার। এদিন সিলেট গ্যাস ফিল্ড এবং বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ডস কোম্পানি লিমিটেডের প্রস্তাবিত দুটি গ্যাস অনুসন্ধান ও উৎপাদন প্রকল্পের অনুমোদন দিয়েছে।
মন্ত্রিসভা বিভাগ সিলেট-১০ অনুসন্ধানী কূপ খনন প্রকল্পের অধীনে খননকাজ চালানোর উপকরণ, তৃতীয় পক্ষের প্রকৌশল সেবা ক্রয় এবং অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণের অনুমোদন দিয়েছে, যা ২০২৩ সালের ডিসেম্বর নাগাদ শেষ হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
সিলেট গ্যাস ফিল্ডসের ব্যবস্থা
সিলেট গ্যাস ফিল্ডসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মিজানুর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন যে, এসব প্রকল্পের পাশাপাশি ২০২৫ সাল নাগাদ জাতীয় গ্রিডে তারা অতিরিক্ত ২৭০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহের পরিকল্পনা নিয়েছেন। এরমধ্যে ৫০ মিলিয়ন ঘনফুট আগামী বছরের মধ্যেই যুক্ত হবে।
বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ডস কোম্পানি লিমিটেডের (বিজিএফসিএল) এর তিতাস গ্যাসক্ষেত্রের 'ই' ও 'জি' লোকেশনে ওয়েলহেড কম্প্রেসার স্থাপনের জন্য যন্ত্রাংশ কেনার আরেকটি প্রস্তাব অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা বিভাগ।
এই প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে বিজিএফসিএল পাইপলাইনে দরকারি গ্যাসের চাপ রক্ষা করতে পারবে।
বিশ্ববাজারে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি)-র মূল্যে অস্থিতিশীলতা বাংলাদেশের গ্যাস সরবরাহকেও আঘাত করেছে, কারণ খরচ কমাতে সরকার আন্তর্জাতিক খোলা বাজার থেকে এই জ্বালানিটির আমদানি কমিয়েছে। এই বাস্তবতায়, বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজ সম্পদ কর্পোরেশন (পেট্রোবাংলা) ২০২৫ সাল নাগাদ অতিরিক্ত ৬০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদনে একটি পরিকল্পনা নিয়েছে।
পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান নাজমূল আহসান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, বিদ্যমান ক্ষেত্রগুলোতে ওয়ার্কওভার কর্মসূচির মাধ্যমে তারা স্থানীয় গ্যাসক্ষেত্রের উৎপাদন বাড়াতে চান।
বর্তমানে, বাংলাদেশের স্থানীয় ক্ষেত্রগুলি থেকে প্রায় ২৩৩৪ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন করা হয়। তবে বর্তমানে দেশে মোট সরবরাহ ২৮৩৭ মিলিয়ন ঘনফুট, যার মধ্যে দীর্ঘমেয়াদী এলএনজি খাত থেকে ৫০২ মিলিয়ন ঘনফুট যোগ হয়।