রাশিয়া থেকে সার আমদানির প্রক্রিয়া শুরু
হাইলাইটস:
• গত বছর ১ লাখ ৮০ হাজার টন এমওপি আমদানির জন্য রাশিয়ার সঙ্গে চুক্তি হয়
• ৬০ হাজার টন আমদানির পরই যুদ্ধ শুরু হয়
• অবশিষ্ট ১ লাখ ২০ হাজার টন সার আমদানির প্রক্রিয়া ফের শুরু হয়েছে
• বুধবারের রুশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে সভায় পেমেন্ট পদ্ধতি নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে
• বছরে এমওপির চাহিদা প্রায় ৮ লাখ টন
রাশিয়া থেকে সার আমদানির প্রক্রিয়া শুরু করেছে সরকার। তৃতীয় কোনো দেশের সমুদ্রবন্দর থেকে বাংলাদেশকে ১ লাখ ২০ হাজার টন মিউরেট অভ পটাশ (এমওপি) সরবরাহ করতে সম্মতি দিয়েছে মস্কো।
এই পরিমাণ সার আমদানি করতে পারলে আগামী মৌসুমে দেশে এমওপি সারের চাহিদা পুরোপুরি মেটানো সম্ভব হবে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের সূত্র দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানিয়েছে, সারের দাম পেমেন্ট পদ্ধতি এবং সারবাহী জাহাজের ইনস্যুরেন্স কাভারেজের বিষয় চূড়ান্ত করতে বুধবার রুশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করবে মস্কোর বাংলাদেশ দূতাবাস।
গত বছর ১ লাখ ৮০ হাজার টন এমওপি আমদানির জন্য রাশিয়ার সঙ্গে চুক্তি করেছিল সরকার। তার মধ্যে ৬০ হাজার টন আমদানির পরই প্রতিবেশী ইউক্রেনের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে যায় দেশটি।
তা সত্ত্বেও গত মার্চে রাশিয়া থেকে তৃতীয় লটে ৩০ হাজার টন এমওপি সার আমদানির প্রস্তাব অনুমোদন করেছিল সরকারি ক্রয়-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কারণে সে সার আমদানি করতে পারেনি বাংলাদেশ।
কৃষিমন্ত্রী ড. মোহাম্মদ আব্দুর রাজ্জাক টিবিএসকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার সার আমদানির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার ঘোষণা দেওয়ায় চুক্তির বাকি এমওপি সার এখন আমদানির প্রক্রিয়া চলছে।
তিনি বলেন, 'পেমেন্ট পদ্ধতি ও জাহাজের ইনস্যুরেন্স বিষয়ে কিছু জটিলতা আছে, যা সমাধানে বুধবার মস্কোতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত রাশিয়ার কর্মকর্তানের সঙ্গে বৈঠক করবেন।'
মন্ত্রী আরও জানান, এমওপি আমদানির জন্য রাশিয়ার সঙ্গে যে চুক্তি আছে, সেই চুক্তির সব শর্ত অপরিবর্তিত রেখে তৃতীয় কোনো দেশের বন্দর থেকে সার সরবরাহ করবে মস্কো। তবে সারের দাম আন্তর্জাতিক বাজারদর অনুযায়ী নির্ধারণ করা হতে পারে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, বাংলাদেশে প্রতি বছর এমওপি সারের চাহিদা প্রায় ৮ লাখ টন। যার প্রায় ৬০ শতাংশ আমদানি হতো রাশিয়া ও বেলারুশ থেকে। ইউক্রেন যুদ্ধের জেরে এ দুটি দেশের ওপর যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার পর কানাডাসহ অন্যান্য দেশ থেকে প্রয়োজনীয় সার আমদানিতে তৎপর হয়ে উঠে বাংলাদেশ। এতে সারে সরকারের ভর্তুকিও বাড়ার আশঙ্কা দেখা দেয়।
কানাডার সারের দাম তুলনামুলকভাবে বেশি। এছাড়া দেশটি থেকে সার আমদানিতে জাহাজ ভাড়াও অনেক বেশি। তা সত্ত্বেও সারের চাহিদা মেটাতে কানাডা থেকে সাড়ে ৫ লাখ টন এমওপি আমদানির চুক্তি করেছে কৃষি মন্ত্রণালয়।
কিন্তু চলমান ডলার সংকট পরিস্থিতি মোকাবিলায় তুলনামূলক কম খরচে রাশিয়া থেকে সার, জ্বালানি তেল ও গম আমদানির উপায় বের করতে মন্ত্রণালয়গুলোকে নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
তার পরিপ্রেক্ষিতেই আগের চুক্তির অবশিষ্ট ১ লাখ ২০ হাজার টন এমওপি আমদানির উদ্যোগ নিয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়।
যুক্তরাষ্ট্রও এখন রাশিয়া থেকে সার আমদানি করছে। রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাশিয়া থেকে ৩৯ হাজার টন ইউরিয়া অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট সলিউশন নিয়ে একটি জাহাজ গত জুনে রাশিয়ার সেইন্ট পিটার্সবার্গ বন্দর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের পথে ছেড়ে গেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও কম দামে রাশিয়া থেকে বিপুল পরিমাণ জ্বালানি তেল আমদানি করছে প্রতিবেশী দেশ ভারত ও চীন। এমনকি যুদ্ধে ইউক্রেনের পক্ষে শক্ত অবস্থান নেওয়া ইইউও রাশিয়া থেকে তেল ও গ্যাস আমদানি অব্যাহত রেখেছে।
এদিকে রাশিয়ান ভারী ক্রুড তেল পরিশোধন করার ব্যবস্থা বাংলাদেশে না থাকায় বাংলাদেশকে কম দামে পরিশোধিত জ্বালানি তেল সরবরাহ করার প্রস্তাব দিয়েছে মস্কো। সে প্রস্তাব যাচাই-বাছাই করতে সরকারের একটি কমিটি কাজ করছে।
রাশিয়া থেকে জ্বালানি তেল আমদানি করা সম্ভব হলে সেচের খরচ কমবে। সেইসঙ্গে কৃষি খাতে সরকারের সামগ্রিক ভর্তুকির পরিমাণও কমে যাবে বলে মনে করছেন কৃষি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, ধান উৎপাদনে এমওপি সারের ব্যবহার কম হলেও আলুসহ বিভিন্ন সবজি উৎপাদনে এর ব্যবহার বেশি। বিশেষ করে আগাম আলু উৎপাদনে এই সার বেশি ব্যবহৃত হয়। সাধারণত, অক্টোবর থেকে এমওপি সারের চাহিদা বেড়ে যায়। তার আগেই রাশিয়া থেকে সার আমদানি করা সম্ভব হবে।
সার আমদানি-সংক্রান্ত সমস্যার কথা জানাতে গিয়ে কৃষিমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশের কোনো ব্যাংক আমদানি ঋণপত্র (এলসি) খোলার পর আন্তর্জাতিক পরিচিতি আছে এমন কোনো ব্যাংকের মাধ্যমে ওই এলসি কনফার্মেশন করতে হয়। কিন্তু রাশিয়ার ব্যাংকগুলোর সঙ্গে লেনদেনের ক্ষেত্রে স্ট্যান্ডার্ড চাটার্ড, এইচএসবিসিসহ বৈশ্বিক ব্যাংকগুলো কনফার্মেশনে রাজি নয়।
এছাড়া সমুদ্রগামী জাহাজগুলো কৃষ্ণ সাগরের রাশিয়ান বন্দরে প্রবেশ করতে আগ্রহী নয়। কারণ, বৈশ্বিক ইনস্যুরেন্স কোম্পানিগুলো কৃষ্ণ সাগরে গমনকারী কোনো জাহাজকে ইনস্যুরেন্স কাভারেজ করছে না।
রাশিয়া থেকে সার আমদানির সর্বশেষ তথ্য জানতে এ প্রতিবেদকের সামনেই মস্কোতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতকে ফোন করেন কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক।
কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক এই প্রতিবেদকের উপস্থিতিতেই রাশিয়া থেকে সার আমদানির বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য জানতে মস্কোতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতকে ফোন করেন।
পরে টিবিএসকে মন্ত্রী বলেন, 'রাশিয়া থেকে সার আমদানিতে শিপিং সমস্যার সমাধান হয়ে যাচ্ছে। রাশিয়া তৃতীয় কোনো বন্দর থেকে বাংলাদেশে এমওপি সার সরবরাহ করবে।'
এছাড়া, রাশিয়া থেকে সাড়ে ৩ লাখ টন গম আমদানির প্রক্রিয়া প্রায় চূড়ান্ত বলে কৃষিমন্ত্রীকে জানিয়েছেন রাষ্ট্রদূত।
রাশিয়া থেকে সার আমদানির পথ খুলে যাওয়া বাংলাদেশের জন্য সুখবর বলে মনে করেন পরিকল্পনা কমিশনের সাবেক সদস্য ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আব্দুস সাত্তার মণ্ডল।
টিবিএসকে তিনি বলেন, বাংলাদেশের নন-ইউরিয়া সারের বড় জোগানদার রাশিয়া; পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কারণে সেখান থেকে আমদানি ব্যাহত হওয়ায় সার সরবরাহ নিয়ে সরকারও দুশ্চিন্তায় ছিল।
'আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ যদি নিজের সুবিধাজনক দামে রাশিয়া থেকে সার আমদানি করতে পারে, তা অবশ্যই আমাদের জন্য ভালো ফলাফল দেবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে সরকার-নির্ধারিত দামে কৃষক যাতে সময়মতো সার পায়, তা নিশ্চিত করতে হবে,' জানান তিনি।
কৃষি মন্ত্রণালয় এমওপি ছাড়াও টিএসপি ও ডিএপি সার আমদানি ও সরবরাহ করে থাকে। আগামী মৌসুমে চাহিদা মেটানোর মতো টিএসপি ও ডিএপি সারের মজুদ রয়েছে বলে জানান মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।
আগামী মৌসুমে মোট ৭.৫ লাখ টন ডিএপি সারের চাহিদার বিপরীতে মজুদ আছে ৮ লাখ টন। এছাড়া টিএসপির ৪ লাখ টন চাহিদা মেটানোর মতো মজুদও আছে সরকারের কাছে।
ইউরিয়া সার উৎপাদন ও আমদানির বিষয়টি দেখভাল করে শিল্প মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন বাংলাদেশ কেমিকেল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন। বাংলাদেশ যেহেতু অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের মাধ্যমে সম্পূর্ণ চাহিদা মেটাতে পারে না, তাই অবশিষ্ট চাহিদা মেটাতে মধ্যপ্রাচ্য থেকে আমদানি করে ইউরিয়ার চাহিদা মেটানো হয়।
চাহিদা অনুযায়ী সারের জোগান নিশ্চিত করতে পারলেও চলতি আমন মৌসুমে অনাবৃষ্টির কারণে উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন কৃষিমন্ত্রী।
এছাড়া বিদ্যুৎ রেশনিংয়ের কারণে গ্রামে বিদ্যুৎ কম থাকায় সেচকাজ বাধাগ্রস্ত হওয়া এবং ডিজেলের দাম বাড়ানোর প্রভাব ইতোমধ্যে পড়তে শুরু করেছে বলে জানান তিনি।
সেচকাজে ব্যবহৃত ডিজেলে ভর্তুকি দেওয়া কিংবা ১০ টাকার অ্যাকাউন্টধারী কৃষকদের সেচের জন্য প্রণোদনা দেওয়ার কথা ভাবছিল সরকার। এ বিষয়ে অগ্রগতি জানতে চাইলে কৃষিমন্ত্রী বলেন, এমনিতেই কৃষিতে ভর্তুকি অনেক বেড়ে গেছে। আগে যে সার ২৫০ টাকায় আমদানি করতে হতো, এখন তা ১ হাজার ১০০ টাকায় আমদানি করতে হচ্ছে। কৃষি খাতে প্রায় ২৮ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি প্রয়োজন হচ্ছে।
'সেচের জন্য প্রণোদনা কিংবা ডিজেলে ভর্তুকি দেওয়া খুবই জটিল প্রক্রিয়া। এ ধরনের সুবিধার অপব্যবহারও হয়। অন্যদিকে, এমনিতেই বিপুল ভর্তুকির চাপ রয়েছে। তাই আপাতত সেচকাজে ব্যবহৃত ডিজেলের দাম কমানো কিংবা সেচের জন্য পৃথক প্রণোদনা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না,' জানান মন্ত্রী।