অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিয়ে আওয়ামী লীগের অলীক কাহিনি: এখন মাথাপিছু আয় কমতে পারে ৫০০ ডলার
বিগত আওয়ামী লীগ সরকার 'উন্নয়নের' যেসব চটকদার কাহিনি সৃষ্টি করেছিল, এবার তার গোমর ফাঁস হতে চলেছে। কারণ, অর্থনীতির নানান সূচকের তথ্য-উপাত্ত নিয়ে যেসব কারসাজি করেছে তারা – এবার তার সেগুলোর সন্ধান পাচ্ছে অর্থনীতির শ্বেতপত্র প্রণয়নে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত কমিটি।
দেশের অর্থনীতির সার্বিক অবস্থা তুলে ধরার দায়িত্ব পাওয়া এই কমিটি যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে এখনো কোনো তথ্য প্রকাশ করেনি, তবে কমিটির একজন সদস্য তাঁদের প্রাথমিক অনুসন্ধানের বরাত দিয়ে বলেছেন, গত অর্থবছরের প্রকৃত মাথাপিছু আয়– আগের সরকার যা দাবি করেছিল, তার চেয়ে ৫০০ ডলার কম হবে। অর্থাৎ, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে মাথাপিছু আয় হবে ২,২০০ ডলার, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সাময়িক হিসাবে যা ২,৭৮৪ ডলার দেখানো হয়েছিল।
কোভিড সংক্রমণের সময় ২০১৯-২০ অর্থবছরে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির হার আগের বছরের চেয়ে অর্ধেকরও কম হয়ে ৩.৪৫ শতাংশে নামে, কিন্তু তখনও মাথাপিছু আয় দেখানো হয়েছে ২,৩২৬ ডলার, অর্থাৎ বছরের চেয়ে তা ১০০ ডলার বাড়ার কথা জানানো হয়। এই তথ্যে বিস্মিত হন অনেকেই, কারণ মহামারির সময় দফায় দফায় লকডাউনে অনেকেই আয়-উপার্জন হারান, বন্ধ হয় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান।
পরের অর্থবছরে এমনটা আবারো করা হয়— যখন করোনা মহামারি অব্যাহত থাকা, বিশ্ব অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির গতিমন্থরতা ও উচ্চ মূল্যস্ফীতির প্রভাবে দেশের অর্থনীতিও পুনরুদ্ধারে পৌঁছাতে ধুঁকছিল। এমন প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেই সরকারি তথ্যে অর্থনীতি ৬.৯৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে বলা হয়। আর মাথাপিছু আয় বাড়ে ২৬৫ ডলার। এধরনের তথ্যে প্রকাশের ঘটনায় দেশের অর্থনীতিবিদদের মধ্যে তথ্য কারসাজি নিয়ে সন্দেহ আরও ঘনীভূত হয়।
'সরকার অনেক বেশি বাড়িয়ে দেখিয়েছে' অর্থনীতিবিদদের এমন অভিযোগ সম্পূর্ণ অস্বীকার করেন তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। বরং আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম, রাজস্ব আহরণ ও দেশে আসা রেমিট্যান্স বাড়ার সুবাদে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও মাথাপিছু আয় বেড়েছে বলে দাবি করেন।
মহামারি চলাকালীন হুন্ডিতে লেনদেন কমা ও নগদ প্রণোদনার কারণে এ দুই অর্থবছরে আনুষ্ঠানিক চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়েছিল, যা রিজার্ভ বাড়াতে অনেকটা ভূমিকা রাখে। কিন্তু, মহামারির সময়ে যখন মানুষ চাকরি হারাচ্ছিল আর আয়ের উৎস বন্ধ হচ্ছিল — তখন কী শুধু এ ঘটনাই মাথাপিছু আয় এতটা বাড়ার জন্য যথেষ্ট?
এমনকী ২০২০ সালে যখন বাংলাদেশের মাথপিছু জিডিপি প্রতিবেশী ভারতের চেয়ে সামান্য বেড়েছিল, তখনও বিশ্লেষকরা বলেছেন যে, ক্রয়ক্ষমতার সমতা (পারচেজিং পাওয়ার প্যারিটি বা পিপিপি)-র ভিত্তিতে হিসাব করলে – ভারতের মাথাপিছু আয় অনেক বেশি হবে। অর্থাৎ, কোনো পরিমাণ পণ্য বা সেবা ক্রয়ে বাংলাদেশিদের যে অর্থ ব্যয় করতে হয় – একই পরিমাণ অর্থ দিয়ে তার চেয়ে বেশি কিনতে পারেন ভারতীয়রা।
জাতীয় শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি এখন বলছে, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) প্রকাশিত প্রবৃদ্ধির তথ্যে ব্যাপক কারসাজি করা হয়েছে।
শাসকগোষ্ঠীর বাস্তবতার চেয়ে ভালো পারফরম্যান্স উপস্থাপনের কৌশলগুলোর মধ্যে ছিল অনুকূল বিনিময় হারের ব্যবহার, যেখানে জাতীয় মুদ্রার অতিমূল্যায়ন এবং রপ্তানিকে স্ফীত করে দেখানো হয়। আরেকটি পদ্ধতি ছিল কৃত্রিমভাবে অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের (জিডিপি) পরিসংখ্যান বাড়িয়ে দেখানোর জন্য অতিরিক্ত সরকারি ব্যয়ের মতো অ-উৎপাদনশীল খাতগুলোকেও অন্তর্ভুক্ত করা।
নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে অর্থনীতির শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির একজন সদস্য বলেন, শক্তিশালী জিএনআই (মোট জাতীয় আয়) বাংলাদেশের অর্থনীতিকে স্থিতিশীল ও সম্ভাবনাময় হিসেবে তুলে ধরে। বিদেশী বিনিয়োগ ও তহবিল আকৃষ্ট করতে যা অন্তর্নিহিত দুর্বলতাগুলো আড়াল করে– প্রবৃদ্ধি ও অগ্রগতির একটি মিথ্যা ধারণা দিতে রাজনৈতিক নেতৃত্বকে সহায়তা করেছে।
করোনা মহামারির প্রভাবে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ব্যাপকভাবে ব্যাহত হওয়া সত্ত্বেও ২০২০-২১ অর্থবছরে উচ্চ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনের তথ্য প্রকাশ করে বাংলাদেশ। 'তবে জিডিপির প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলন করার ক্ষেত্রে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ বাড়িয়ে দেখানো হয়েছে' বলে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান তিনি।
তবে অর্থনৈতিক তথ্য-উপাত্তে হেরফের বা কারসাজির অভিযোগ অস্বীকার করেন বিবিএসের সাবেক এক কর্মকর্তা। কিন্তু, তিনি এও জানান যে, তাঁদেরকে সেকেন্ডারি তথ্যউপাত্ত নিয়ে কাজ করতে হতো, যার ওপর তাঁদের কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না।
ওই কর্মকর্তা বলেন, কৃষি মন্ত্রণালয় ধান-চালের উৎপাদনের একটি লক্ষ্যমাত্রা ঘোষণা করতো। প্রকৃত উৎপাদন যাই হোক না কেন – জিডিপির হিসাবের সময়, কৃষি মন্ত্রণালয় ওই লক্ষ্যমাত্রার মতো করেই উৎপাদনের হিসাব বিবিএসে জমা দিত।
এছাড়া, বিদেশিরা তাঁদের যাওয়া-আসার বিমানভাড়া, হোটেল বিলসহ বাংলাদেশে ঘোরাফেরা করতে যে অর্থ ব্যয় করতো, তাও সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগের (এফডিআই) হিসাবে যুক্ত করা হতো বলে জানান তিনি।
বিবিএসে তথ্যের কারসাজি
২০০৯ সালে যখন আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে, তখন বিবিএসের তথ্যানুযায়ী, মাথাপিছু জাতীয় আয় ২০০৮-০৯ অর্থবছরে ছিল ৮৪২ ডলার, পরের বছরেই তা বেড়ে দাঁড়ায় ৯৪৬ ডলারে।
২০১২-১৩ অর্থবছরে জাতীয় মাথাপিছু আয় ১২৭ ডলার বেড়ে ১,২৭৪ ডলারে উন্নীত হয়। এরপর প্রতিবছর মাথাপিছু আয় লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তেই থাকে। এমনকী করোনাভাইরাস সংক্রমণের সময় দফায় দফায় লকডাউনে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড যখন বন্ধ ছিল, তখনও জাতীয় মাথাপিঁছু আয় আগের চেয়ে অনেক বেশি বাড়ার কথা জানানো হয়েছে।
কোভিডের আগের অর্থবছর, ২০১৯-২০ সময়ে জাতীয় মাথাপিছু আয় ছিল ২,৩২৬ ডলার। পরের অর্থবছর কোভিডের প্রথম ও দ্বিতীয় ঢেউয়ে— দেশজুড়ে লকডাউন হলেও ওই সময়ে মাথাপিছু আয় ২৬৫ ডলার বেড়ে ২,৫৯১ ডলার হয়।
সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন টিবিএসকে বলেন, ইকোনমিস্ট সেন্স থেকেই বোঝা যায় যে, জিডিপির আকার ও প্রবৃদ্ধির রেট বাড়ানো হয়েছে। ফলে মাথাপিছু আয়ও বেড়ে গেছে। মাথাপিছু আয় হিসাব করার ক্ষেত্রে এমনকী জনসংখ্যার হিসাবও কম দেখানো হতো। যার উদ্দেশ্যই ছিল উন্নয়নের বয়ান প্রতিষ্ঠা করতে সবকিছু বাড়িয়ে দেখানো।
তিনি বলেন, "এক্ষেত্রে ম্যাথডোলজির মাধ্যমে যেমন বাড়ানো হতো, তেমনি ইচ্ছা করেও বাড়ানো হতো। রাজনৈতিক সুবিধা হাসিলে অর্থনৈতিক তথ্য-উপাত্তকে ব্যবহার করা হয়েছে।"
ভবিষ্যতে এভাবে তথ্যে কারসাজি বন্ধে, শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি বিবিএসকে একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার সুপারিশ করব বলে আশা করা হচ্ছে। বিবিএসের কোন তথ্য প্রকাশ করতে যাতে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর, বা পরিকল্পনামন্ত্রী কিংবা অন্য কোন সংস্থার অনুমোদন নিতে না হয়, সেজন্য এ সুপারিশ করবে কমিটি। এমনটাই জানান কমিটির একজন সদস্য।
এছাড়া, প্রয়োজনীয় জনবলসহ নির্বাহী ক্ষমতাসম্পন্ন একটি শক্তিশালী কমিশন গঠন করে— বিবিএসের তথ্য সংগ্রহের পদ্ধতি তথা ম্যাথডোলজি সংশোধনের সুপারিশ করবে শ্বেতপত্র কমিটি। কর্মী সংখ্যা বাড়ানোর সুপারিশও থাকবে।
বিবিএসের সাবেক পরিচালক আবুল কালাম আজাদ জিডিপির তথ্য সংকলনের দায়িত্বে ছিলেন, এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে জিডিপির তথ্যসহ বিবিএসের বিভিন্ন তথ্য 'টেম্পারিং' করার অভিযোগ উঠেছে। তবে তথ্যে কারসাজির অভিযোগ অস্বীকার করে এই কর্মকর্তা বলেন, শ্বেতপত্র কমিটি ডাকলে তিনি তার ভাষ্য কমিটির সামনে তুলে ধরবেন।
আবুল কালাম আজাদ বলেন, আমি জিডিপি কম্পাইল করতাম। সব ডেটা সেকেন্ডারি সোর্স থেকে আসতো। তাই এসব সূত্র থেকে সঠিক তথ্য না এলেও আমার কিছু করার থাকতো না। মাথাপিছু আয়ের হিসাব বাংলাদেশ ব্যাংকের বিনিময় হারের ওপর নির্ভর করতো। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিনিময় হার কম দিলে, সেটাই জিডিপির হিসাবে ব্যবহার করতো হতো।
কৃষি উৎপাদনের তথ্য সম্পর্কে তিনি বলেন, বোরো ও আমন মওসুমের শুরুতেই কৃষি মন্ত্রণালয় ধান-চাল উৎপাদনের একটি লক্ষ্যমাত্রা ঘোষণা করতো। জিডিপির হিসাবের সময় কৃষি মন্ত্রণালয় ওই লক্ষ্যমাত্রার মতো করেই প্রকৃত উৎপাদনের হিসাব বিবিএসে জমা দিত। "দুই লাখ টন ধানের উৎপাদনও যদি বেশি দেখানো হয়– তাহলে জিডিপির আকার ও মাথাপিছু আয়ে বড় ধরণের হেরফের হয়ে যায়।"
প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) এর হিসাব সম্পর্কে আজাদ বলেন, বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা)-তে যে পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগের জন্য রেজিস্ট্রেশন হতো, সেটিই দেখানোর কথা। "কিন্তু এফডিআই বাড়িয়ে দেখানোর জন্য তারা বিদেশিদের আসা-যাওয়ার বিমান ভাড়া, হোটেল খরচ, থাকা-খাওয়াসহ বাংলাদেশে বিদেশিদের সব খরচ এফডিআই হিসাবে যোগ করে বিবিএসে পাঠাত। বিবিএসের পক্ষে সেটা পরিবর্তন করা সম্ভব ছিল না"- বলেন তিনি।
আবুল কালাম আজাদ বলেন, মাথাপিছু আয় হিসাব করতে মোট জাতীয় আয়কে মোট জনসংখ্যা দিয়ে ভাগ করতে হয়। "বিবিএস প্রতিবছর জনশুমারী ও গৃহগণনা প্রজেক্টের আওতায় জুনে ওই বছরের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার প্রাক্কলন করে মোট জনসংখ্যা নির্ধারণ করে। । কিন্তু জিডিপির হিসাব করতে মোট জনসংখ্যা কতো, তার তথ্য প্রয়োজন হয় জানুয়ারি মাসে। সেখানে জনসংখ্যা কয়েক লাখ কম দেখানো হলেই মাথাপিছু আয় বেড়ে যায়।"
আদমশুমারীতে প্রাপ্ত মোট জনসংখ্যা এবং ওই বছরে জনশুমারী ও গৃহণণনা থেকে প্রাপ্ত জনসংখ্যার হিসাবের মধ্যে বড় ধরণের পার্থক্য দেখা যায় বলেও জানান তিনি।