দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে বাড়ছে ইউয়ান
যুক্তরাষ্ট্রের পর বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ অর্থনীতি চীন– দিনকে দিন একটি উদীয়মান অর্থনৈতিক পরাশক্তিতে পরিণত হচ্ছে। ব্যাপক প্রভাবশালী হয়ে উঠছে বৈশ্বিক অর্থনীতি ও আর্থিক বাজারে।
নানান সময়ের প্রতিবেদনে প্রকাশ, গত দশকে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে ৩০ শতাংশের বেশি অবদানও চীন-ই রেখেছে।
চীনের অর্থনৈতিক সক্ষমতা যখন বাড়বাড়ন্ত– তখন দেশটি চাইছে, আন্তর্জাতিক লেনদেনের প্রধান মাধ্যম হিসেবে মার্কিন ডলারের স্থান দখল করুক তাদের মুদ্রা। আর এতে সায় দিয়ে, বিশ্বব্যাপী কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোও তাদের বৈদেশিক মুদ্রা মজুদে (ফরেক্স রিজার্ভে) ইউয়ানের পরিমাণ বাড়াচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকও সেই পদাঙ্ক অনুসরণ করছে।
আন্তর্জাতিক লেনদেনে ডলারের বিকল্প হিসেবে বিশ্বজুড়ে দ্রুত স্বীকৃতি পাচ্ছে ইউয়ান। আর তাই বাংলাদেশ ব্যাংকও দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে ডলারের অংশ কমিয়ে ইউয়ানের পরিমাণ বাড়াচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে ইউয়ানের পরিমাণ ২০১৭ সালের ১ শতাংশের তুলনায় চলতি বছরের আগস্টে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১.৩২ শতাংশে। অন্যদিকে, একই সময়ে রিজার্ভে আধিপত্য করা মার্কিন ডলারের পরিমাণ ৮১ শতাংশ থেকে কমে ৭৫ শতাংশে এসে ঠেকেছে।
রিজার্ভে ডলারের অংশ কমলেও, বেড়েছে অন্যান্য মুদ্রার পরিমাণ।
উদাহরণস্বরূপ, রিজার্ভে ইউরোর কথা বলা যেতে পারে। এটি বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রিজার্ভ মুদ্রা। এই মুদ্রার মজুদ ২০১৭ সালের ৩.৮৪ শতাংশ থেকে বেড়ে চলতি বছরের আগস্টে ৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। একই সময়ে ব্রিটিশ পাউন্ডের অংশ ৩.৪৩ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে ৪.৪ শতাংশ। এমন চিত্রই উঠে এসেছে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে পাওয়া তথ্যে।
২০১৬ সালে আইএমএফ (আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল) এর স্পেশাল ড্রয়িং রাইটস (এসডিআর) মুদ্রা ঝুড়িতে ইউয়ান অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর থেকেই দেশের বৈদেশিক মুদ্রার মজুদে ইউয়ানের পরিমাণ ক্রমাগত বাড়ছে।
এর কিছু কাল পর- রিজার্ভ ধরে রাখার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকও ইউয়ানকে অনুমোদিত মুদ্রা হিসেবে ঘোষণা করেছে এবং চীনের সঙ্গে ক্রমবর্ধমান ব্যবসায়িক সম্পৃক্ততার ক্ষেত্রে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সুবিধার্থে– ফরেক্স রিজার্ভে চীনা মুদ্রাটির পরিমাণ বাড়াতে শুরু করেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুসারে, আগস্ট, ২০২২ পর্যন্ত ৫২৮ মিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ ইউয়ান রিজার্ভে রাখা হয়। অথচ ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে ৩২৩ মিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ ইউয়ান ছিল রিজার্ভে।
চীন ইতোমধ্যে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে মূল্য নির্ধারণ এবং লেনদেন নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে উভয় দেশের স্থানীয় মুদ্রা, রেনমিনবি (ইউয়ানের স্থানীয় নাম) এবং টাকা বিনিময়ের প্রস্তাব দিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক এবং চীনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক পিপলস ব্যাংক অফ চায়নার মধ্যে উভয় মুদ্রা বিনিময় সংক্রান্ত চুক্তি প্রস্তাব করেছে চীন।
চলতি বছরের ১৯ আগস্ট পাঠানো এক চিঠিতে ঢাকাস্থ চীনের দূতাবাস জানায়, মুদ্রা বিনিময়ের এই চুক্তি বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় হারের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করবে। সেইসঙ্গে কমাবে বৈদেশিক মুদ্রার লেনদেন খরচও।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে– বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন জ্যেষ্ঠ নির্বাহী বলেন, তারা এ বিষয়ে ইতিবাচকভাবে কাজ করছেন।
যেহেতু চীনের মুদ্রা এখন আন্তর্জাতিকভাবে লেনদেনে বিনিময়যোগ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং বাংলাদেশও রিজার্ভে ইউয়ানের অংশ গড়ে তুলেছে, তাই এই মুদ্রায় লেনদেন সহজ হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
আমদানির ক্ষেত্রেও চীন বাংলাদেশের শীর্ষ বাণিজ্যিক অংশীদার।
২০২০-২১ অর্থবছরে চীন থেকে দেশে মোট আমদানির পরিমাণ ছিল ১ লাখ কোটি টাকা এবং রপ্তানি হয়েছিল ৪ হাজার ৮০৪ কোটি টাকা।
মার্কিন ডলার, ইউরো, জাপানিজ ইয়েন এবং ব্রিটিশ পাউন্ডের পাশাপাশি পঞ্চম মুদ্রা হিসেবে ইউয়ানকেও এসডিআর- ঝুড়িতে অন্তর্ভুক্ত করেছে আইএমএফ। এসডিআর- ঝুড়িতে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার অর্থই হচ্ছে– ইউয়ান বর্তমানে বিশ্বব্যাপী রূপান্তরযোগ্য বা লেনদেনের ক্ষেত্রে স্বীকৃত একটি মুদ্রা।
বর্তমানে এসডিআর- বাস্কেটে মূল্যের দিক থেকে মার্কিন ডলার এবং ইউরোর পরেই তৃতীয় স্থানে রয়েছে চীনের মুদ্রা ইউয়ান।
স্পেশাল ড্রয়িং রাইটস- এর সারসংক্ষেপ হলো- এসডিআর। এটি আইএমএফ সদস্য দেশগুলির অনুষ্ঠানিক রিজার্ভের পরিপূরক একটি আন্তর্জাতিক সম্পদ মজুদ। প্রয়োজনের সময় সরকারগুলোর মধ্যে এখান থেকে অবাধে ব্যবহারযোগ্য মুদ্রা সরবরাহ করা হয়ে থাকে।
বাংলাদেশের সাথে ইউয়ান-টাকায় বাণিজ্য চালুর প্রস্তাব চায়নার
এসডিআর-এ অন্তর্ভুক্তির পর পরই চীন ইউয়ানের আন্তর্জাতিকীকরণকে জোরদার করার উদ্যোগ নেয়। পাশাপাশি বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে, নিজেদের আর্থিক বাজারকে উন্মুক্ত করার মতো নানান ধরনের পদক্ষেপ নিতে থাকে।
আর্থিক সহায়তার ক্ষেত্রে ইউয়ান প্রচারের অংশ হিসেবে, চীন এখন ডলারের পরিবর্তে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ইউয়ানে বাংলাদেশকে ঋণ দিচ্ছে।
২০১৬-১৭ অর্থবছর থেকে ২০১৯-২০ অর্থবছর পর্যন্ত, চার বছরে ইউয়ানে চীনের ঋণের প্রতিশ্রুতি হয়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। আর এ সময়ের মধ্যে ইউয়ানে ঋণ ছাড়ের পরিমাণ বেড়েছে সাতগুণেরও বেশি।
বাংলাদেশের জন্য বড় তহবিল পাওয়ার অন্যতম উৎস হয়ে উঠেছে চীন। এর মাধ্যমে দেশটি আলোচিত সময়ে বাংলাদেশের শীর্ষ উন্নয়ন সহযোগীর তালিকায় জায়গা করে নেয়।
স্বাধীনতার পর চীন থেকে বাংলাদেশে সাহায্যের পরিমাণ ছিল একেবারে শূন্যের কোঠায়। সেখানে ২০২০-২১ অর্থবছরে চীন থেকে আসা বৈদেশিক সাহায্যের পরিমাণ বেড়ে প্রায় ১১.২ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এর মাধ্যমে বাংলাদেশের ষষ্ঠ বৃহৎ দ্বিপাক্ষিক উন্নয়ন অংশীদার হয়ে ওঠে চীন, তহবিল যোগানের এই প্রবৃদ্ধিকে সুবিশালই বলা যায়।
আগের অর্থবছরের তুলনায় ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ইউয়ানে চীনের ইউয়ানে সাহায্য দেওয়ার প্রতিশ্রুতি চারগুণ বাড়ে—মূলত তিনটি প্রকল্পে সহায়তার মাধ্যমে- কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণ, দাশেরকান্দি পয়ঃনিষ্কাশন পরিকল্পনা এবং ছয়টি জাহাজ সংগ্রহের ক্ষেত্রে।
২০১৮-১৯ অর্থবছরে চীন ইউয়ান ছাড়া ডলারে বা অন্য কোনো মুদ্রায় সহায়তা দেয়নি।
সংশ্লিষ্ট প্রকল্পগুলোতে চীনা সংস্থাগুলোর সরাসরি বিনিয়োগ গত বছর ১৫ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণে দাঁড়িয়েছে, যার এক-চতুর্থাংশই হয়েছে ইউয়ানে। চীন এখন নিজের বৈদেশিক বাণিজ্যের ১৫ শতাংশই নিষ্পত্তি করে নিজস্ব মুদ্রায়। ২০১৫ সালেও এই হার ছিল ১১ শতাংশ।
ইউয়ান যেভাবে বিশ্বব্যাপী রিজার্ভ মুদ্রা হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে
চলতি বছরের জুলাইয়ে প্রকাশিত ইউবিএস অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টের বার্ষিক রিজার্ভ ম্যানেজার সমীক্ষা অনুসারে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর প্রায় ৮৫ ভাগই বলেছে, তারা ইউয়ানে বিনিয়োগ করেছে, কিংবা এই মুদ্রায় বিনিয়োগের কথা বিবেচনা করছে। এক বছর আগেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই সংখ্যা ছিল ৮১ ভাগ।
ইউবিএস অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট (আমেরিকা) ইনকর্পোরেশন হলো- সম্পদ ব্যবস্থাপনার পরিষেবা দেয় এমন একটি সংস্থা। এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিনিয়োগকারী, আর্থিক উপদেষ্টা এবং প্রতিষ্ঠানকে বিনিয়োগ ও পরামর্শমূলক পরিষেবা দিয়ে থাকে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর ফরেক্স (বৈদেশিক মুদ্রা) ব্যবস্থাপকরা ১০ বছরের মধ্যে তাদের রিজার্ভে ইউয়ানের অংশ গড়ে ৫.৮ শতাংশে ধরে রাখতে চাইছেন, যা গত বছরের ৫.৭ শতাংশের চেয়ে কিছুটা বেশি। অথচ আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের প্রতিবেদনে ২.৯ শতাংশের কথা বলা হয়েছিল। নিঃসন্দেহে এটি আইএমএফের অনুমানের চেয়ে অনেক বেশি।
২০২২ সালের জুন পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর ডলার রিজার্ভ রয়েছে গড় ৬৩ শতাংশ, যা আগের বছরের ৬৯ শতাংশের তুলনায় কিছুটা কম। তবে গণমাধ্যমের প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে ইউবিএস বলেছে, এ বছর জরিপে লাতিন আমেরিকান ব্যাংকের সংখ্যা ছিল কম। এসব দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সাধারণত বেশি পরিমাণে ডলার রিজার্ভে রাখে।
ইউবিএসের সমীক্ষায় অংশ নেওয়া ৮১ শতাংশেরও বেশি উত্তরদাতা বলেছেন, 'মাল্টিপোলার' বা বহুমেরু বিশ্বব্যবস্থার দিকে স্থানান্তর হতে যাওয়ার এই সময়ে– চীনের ইউয়ান বেশ সুবিধাজনক অবস্থানে থাকবে। অন্যদিকে, ৪৬ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছেন, অর্থনৈতিক বা ভূ-রাজনৈতিক এই উত্তেজনার সময়ে নিরাপদ সম্পদের প্রতীক হিসেবে ডলারও লাভবান হবে।