পদ্মা সেতুর সুবাদে দক্ষিণাঞ্চলের অর্থনীতিতে নতুন প্রাণের জোয়ার
নতুন নতুন কারখানা, মুনাফা বৃদ্ধি আর পর্যটকের সংখ্যা বাড়ায় নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ—ইতোমধ্যেই দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের দৃশ্যপট বদলাতে শুরু করেছে পদ্মা সেতুর সুবাদে, কর্মচাঞ্চল্য বেড়েছে মোংলা বন্দরেও।
প্রথম গার্মেন্টস কারখানা, বোতলজাত পানি পরিশোধনের কারখানা- বরিশালেও প্রথমবারের মতো এসব শিল্প গড়ে উঠছে।
সামনের ডিসেম্বরে বরিশালের বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনে (বিসিক) প্রাথমিকভাবে গার্মেন্টস কারখানার কার্যক্রম শুরু হবে। এখানে প্রায় দুইশ মানুষের কর্মসংস্থান হবে।
নিরমাক ডিজাইন গার্মেন্টসের স্বত্বাধিকারী তৌহিদুল ইসলাম বলেন, বারোটি লাইনে এক হাজার মানুষ নিয়োগ দেওয়ার পরিকল্পনা আছে।
প্রাথমিক বিনিয়োগ হবে ৬০ কোটি টাকা, তবে এতে ঝুঁকিও আছে।
"বরিশালে গার্মেন্টসের কোনো কাঁচামাল নেই। ঢাকা থেকে কাঁচামাল আনতে আমাকে অতিরিক্ত পরিবহন খরচ বহন করতে হবে, একারণে উৎপাদন খরচও বেড়ে যাবে", বলেন তিনি।
এছাড়া, বিশেষায়িত দক্ষতার কর্মীরও অভাব আছে, তবে তৌহিদুল আশাবাদী, ঝুঁকি নেওয়ার সুফল পাবেন তিনি।
বরিশালে গ্যাসের লাইন পেলে, কাঁচামালের কারখানাও তৈরি করতে পারেন তিনি। জানিয়েছেন, অনেকেই ইতোমধ্যে এতে আগ্রহ দেখিয়েছে।
বোতলজাত পানি পরিশোধনের কারখানাও হচ্ছে বরিশালে, সামনের নভেম্বরের মধ্যে দক্ষিণাঞ্চলের বাজারে ছাড়ার আগেই এখন পরীক্ষা-নীরিক্ষা পর্যায়ে আছে মোহিনী মিনারেল ওয়াটার।
মোহিনী মিনারেল ওয়াটারের স্বত্বাধিকারী জামাল হোসেন বলেন, "এ এলাকায় ভালোই চাহিদা আছে, তাই কারখানা নির্মাণ করেছি। এখানে আগে এমন কারখানা ছিল না। এক অঞ্চলে থেকে একটি ব্র্যান্ড গড়ে তোলা খুবই কঠিন। যাতায়াত সহজ হওয়ায় এখন আমি আমার পণ্য ঢাকায়ও পাঠাতে চাই"।
বরিশালে অনেক কারখানা গড়ে উঠতে শুরু করায়, জেলায় জমির চাহিদাও বাড়ছে।
বরিশালের ধানসিঁড়ি ডেভেলপারের স্বত্বাধিকারী সাজু বলেন, "ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের নদীর পাড়ে পাঁচ একর জমি বিক্রি করেছি। এই জমিতে একটি সিমেন্ট কারখানা বানানো হবে"।
বরিশালের ডেপুটি কমিশনার জসিম উদ্দিন হায়দার বলেন, "বরিশালের বিএসসিআইসি-তে ১৪৯টি প্লট প্রস্তুত করেছি, মাঝারি শিল্প কারখানাকে এই প্লটগুলো বরাদ্দ দেওয়া হবে। প্লটগুলোর বেশ ভালো চাহিদা আছে এখন, তাই মাঝারি শিল্পের খোঁজ করছি"।
যদিও, কোম্পানিগুলো জমি কেনা শুরু করেছে, গ্যাসের অভাব আছেই, অর্থাৎ উৎপাদন এখনো শুরু হয়নি। অনেকেই ভোলা থেকে প্রাকৃতিক গ্যাস পাওয়ার আশায় আছে।
তাল মিলিয়ে এগোচ্ছে খুলনাও
পদ্মা সেতুর সুবাদে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের সাথে রাজধানী ঢাকার যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হওয়ায় আর খরচ কমে আসায়, খুলনা অঞ্চলেও ব্যবসা বাণিজ্যের বিস্তার ঘটছে, আমদানি-রপ্তানি বেড়েছে মোংলা বন্দর দিয়ে।
মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের (এমপিএ) ট্রাফিক বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ২৫ জুন পদ্মা সেতু চালুর পর জুলাই ও আগস্ট মাসে মোট ১২ লাখ ৬৯ হাজার ৯২১ টন পণ্য আমদানি হয়েছে। যার মধ্যে রিকন্ডিশন গাড়ি, গ্যাস, সার, ক্লিংকার, কয়লা, মেশিনারিজ, তেলসহ অন্যান্য পণ্যও ছিল।
অন্যান্য বছরগুলোতে এই সময়ে গড়ে মাসে ৫ লাখ টন পণ্য আমদানি হত। তবে গত দুই মাসে গড়ে ৬ লাখ টনের বেশি পন্য আমদানি হয়েছে।
অপরদিকে, খরচ ও সময় সাশ্রয় হওয়ায় সেতু ব্যবহার করে ঢাকার নতুন নতুন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রপ্তানি শুরু করেছে।
এমপিএ'র বোর্ড ও জনসংযোগ বিভাগের উপ সচিব মো. মকরুজ্জামান বলেন, 'গত ২৮ জুলাই থেকে ঢাকার ২৭টি গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির বাচ্চাদের পোশাক, জার্সি-কার্ডিগান, টি-শার্ট, ট্রাউজারসহ বিভিন্ন পণ্য এ বন্দর ব্যবহার করে পোল্যান্ডে রপ্তানি করেছে। এর আগে গার্মেন্টস পণ্য মোংলা বন্দর দিয়ে তেমন রপ্তানি হত না।'
তিনি জানান, পদ্মা সেতু চালুর পর ঢাকা থেকে মোংলা বন্দরের দূরত্ব হয়েছে ১৭০ কিলোমিটার। অপরদিকে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম বন্দরের দূরত্ব ২৬০ কিলোমিটার।
এমপিএ'র চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল মোহাম্মদ মুসা বলেন, 'দেশের একের পর এক বৃহৎ মেগা প্রকল্পের মালামাল মোংলা বন্দর দিয়ে আমদানি হচ্ছে। বর্তমান সরকারের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় মোংলা বন্দর এখন বিশ্ব মানের বন্দরে রূপান্তরিত হয়েছে। বন্দরের সক্ষমতা বেড়েছে কয়েকগুণ। পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় ঢাকার গার্মেন্টস পণ্যসহ অন্যান্য সকল ব্যবসায়ীদের মোংলা বন্দর ব্যবহারের প্রতি আগ্রহ বেড়েছে।'
একই সাথে এ বন্দর ব্যবহার করে গাড়ি আমদানিতে সুবিধা বেড়েছে।
বাংলাদেশ রিকন্ডিশন্ড ভেহিক্যালস ইমপোর্টার্স অ্যান্ড ডিলারস অ্যাসোসিয়েশনের (বারভিডা) মোংলা বন্দর স্ট্যান্ডিং কমিটির চেয়ারম্যান আহসানুর রহমান আরজু বলেন, 'এর আগে জাপান থেকে আমদানিকৃত গাড়ি চট্টগ্রাম বন্দরে কিছু খালাস করে মোংলা বন্দরে আসতো। সে সময় ৫০০ থেকে সর্বোচ্চ ৭০০ গাড়ি একসাথে মোংলা বন্দরে আনা হয়েছে। কিন্তু পদ্মা সেতুর কারণে ঢাকা সাথে যোগাযোগ একন সহজ হয়েছে। তাই আমরা চট্টগ্রাম বন্দরে এখন গাড়ি নামাচ্ছি না।'
তিনি বলেন, 'এখন মোংলা বন্দর থেকে একটি গাড়ি ঢাকাতে নিতে ৩ থেকে ৪ ঘণ্টা সময় লাগে। আগে ৬ থেকে ৭ ঘণ্টা সময় লাগতো। এছাড়া চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ঢাকাতে গাড়ি নিতেও ৬ থেকে ৭ ঘণ্টা সময় লাগে। যে কারণে গাড়ি আমদানির জন্য আমরা মোংলা বন্দর ব্যবহারে বেশি আগ্রহী হচ্ছি।'
কর্মচাঞ্চল্য বেড়েছে সাতক্ষীরার ভোমরা বন্দরেও
ভোমরা বন্দর সিএন্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মাকসুদ আলম খান জানান, পদ্মাসেতু উদ্বোধনের পর ভোমরা বন্দরে আমদানি-রপ্তানি বেড়েছে। আগে দৈনিক ৫০-৭০ ট্রাক পণ্য রপ্তানি হতো। বর্তমানে হচ্ছে ১২০-১৫০ ট্রাক। এছাড়া আমদানি হতো ৩০০-৩৫০ ট্রাক। বর্তমানে হচ্ছে ৪০০-৪২০ ট্রাক।
খুলনার সোনাডাঙ্গার ট্রাক স্ট্যান্ড সংলগ্ন পাইকারী কাঁচা বাজারের ব্যবসায়ী মোতালেব আলী বলেন, 'এখন তিন ঘণ্টার মধ্যে খুলনা থেকে ট্রাক গিয়ে পদ্মা নদী পাড়ি দিচ্ছে। সেখান থেকে আরও ২ ঘণ্টা লেগেছে ঢাকার মোকামে পৌঁছাতে। ফলে খুলনা থেকে এখন এক ট্রাক পণ্য ঢাকাতে পাঠাতে মাত্র ৫ ঘণ্টা সময় লাগছে। আগে লাগতো ১২ ঘণ্টার বেশি।'
তিনি বলেন, 'আগে আমরা একটি ট্রাক খুলনা থেকে ঢাকার কাওরান বাজারে পাঠাতে ভাড়া দিতাম ১৫ হাজার টাকা। পদ্মা সেতু চালু পর ট্রাক ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা হয়েছিল। তবে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় এখন ট্রাক ভাড়া বেড়েছে। তবে পদ্মা সেতু না থাকলে এই সময়ে আরও বেশি ট্রাক ভাড়া গুণতে হত।'
ট্রাক চালক আমজেদ হাওলাদার বলেন, 'খুলনা-ঢাকা রূটে প্রতিদিন কম করে হলেও ১০ হাজার ট্রাক পন্য পরিবহন করে। মোংলা বন্দর, বেনাপোল-ভোমরা স্থল বন্দর, খুলনা শিল্প এলাকা, ও নৌ বন্দররের মামামাল এসব ট্রাক পরিবহন করে। পদ্মা সেতু চালুর পর এসব পণ্য পরিবহনে সময় অনেক কম লাগছে।'
মৎস অধিদপ্তরের খুলনা বিভাগীয় কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, প্রতিদিন খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট জেলা থেকে রাজধানী ঢাকাতে প্রায় ১৪৫ মেট্রিকটন থেকে ১৬০ টন বিভিন্ন প্রজাতির মাছ নেওয়া হয়।
খুলনা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা জয়দেব পাল বলেন, 'পদ্মা সেতু চালুতে মাছের বিপণন ও বাজারজাতর করণ সহজ হয়েছে।'
এছাড়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট থেকে প্রতিদিন প্রায় ৬০০ টন কৃষি পণ্য রাজধানীতে নেওয়া হয়।
সহজ হয়েছে গণপরিবহনে যাতায়াত, কমেছে ডোমেস্টিক ফ্লাইট
সড়কপথে যাত্রী বেড়ে যাওয়ায় যশোর বিমান পথে দিয়ে ঢাকাগামী যাত্রী কমেছে অনেকাংশে। ফলে ডোমেস্টিক ফ্লাইটের সংখ্যাও কমিয়ে দিয়েছে এয়ারলাইনসগুলো।
সোহাগ পরিবহনের খুলনার রয়্যাল মোড় কাউন্টারের সহকারি ম্যানেজার মো. বুলবুল বলেন, 'পদ্মা সেতুর চালুর পর খুলনা থেকে ঢাকাতে পৌঁছাতে ৩ থেকে ৪ ঘণ্টা সময় লাগছে। তাই এখন গাড়িতে আগের তুলনায় যাত্রী অনেকগুণ বেড়েছে।'
বাস কাউন্টারে যাত্রী বাড়ায় ক্ষতির মুখে পড়েছে এয়ারলাইনসগুলো।
ইউএস বাংলার খুলনা স্টেশন ম্যানেজার সাব্বির হোসাইন বলেন, 'মূলত পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের পর খুলনা-যশোর থেকে ঢাকার যাত্রী কমেছে। এখন পূর্বের থেকে ফ্লাইটের সংখ্যা অর্ধেকে নেমেছে।'
শরীয়তপুরেও পদ্মা সেতুর প্রভাবে শুরু হয়েছে পরিবর্তনের ছোঁয়া। ঢাকা-শরীয়পুর রুটে নতুন করে ২০০টি বাস চালু হয়েছে।