বাড়ির স্বপ্ন অধরা থেকে যাচ্ছে সাধারণ মানুষের: দুই দশকে ঢাকায় জমির দাম বেড়েছে ২৭০০%
বিয়ের পর থেকেই নিজেদের একটি ফ্ল্যাটের স্বপ্ন দেখতেন ঢাকার মিরপুরের স্কুলশিক্ষক হাবিবা আক্তার ও বেসরকারি চাকরিজীবী আতিকুর রহমান দম্পতি। এক যুগ পার হলেও সে স্বপ্ন অধরাই রয়ে গেছে এই দম্পতির।
হাবিবা আক্তার দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "দুজনের আয়ের বড় অংশ চলে যায় বাড়িভাড়ায়। ধীরে ধীরে টাকা কিছু টাকা সেভিংস হলেও তা ফ্ল্যাটের দামের তুলনায় খুব কম।"
"আবার মনে করেন, একটা দাম টার্গেট করে পয়সা জমাই, মোটামুটি একটা পর্যায়ে এসে দেখি সেটার দামও তখন আরো অনেক বেড়ে গেছে," বলেন হাবিবা।
হাবিবা আক্তারের মতোই নিজ বাড়ির স্বপ্ন অধরা থাকছে ঢাকা শহরের স্বল্প ও মধ্য আয়ের সাধারণ মানুষের। ঢাকার ১ কোটি ৮০ লাখ মানুষের মধ্যে অন্তত ৮০ শতাংশ মানুষই ভাড়া পরিশোধ করতে গিয়ে আর ফ্ল্যাটের মালিক হতে পারছেন না বলে মনে করছেন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি গোলাম রহমান।
তিনি বলেন, সরকারি উদ্যোগের স্বল্পতা, জমি ও ফ্ল্যাটের উচ্চ দাম, নির্মাণ ব্যয় এবং নিয়ন্ত্রণহীন বাড়িভাড়ার কারণেই ঢাকায় নিজ বাড়ি অধরা থাকছে সাধারণ মানুষের।
"গত ২০ বছরে ঢাকা শহরে বাড়ি ভাড়া বেড়েছে প্রায় পাঁচগুণ। নগরীতে বসবাসকারী শতকরা ৮০ ভাগ মানুষের আয়ের ৬০ শতাংশের বেশি ব্যয় করতে হয়েছে বাড়ি ভাড়া বাবদ। অন্যদিকে জমি ও ফ্ল্যাটের দাম বেড়েছে কয়েকগুণ। এ কারণেই সঞ্চয় করে ফ্ল্যাট কিনতে পারছেন না অধিকাংশ মানুষ", যোগ করেন গোলাম রহমান।
বিশ্ব বসতি দিবস উপলক্ষে রাজধানী ঢাকার জমি ও ফ্ল্যাটের দাম নিয়ে একটি গবেষণা করেছে ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইপিডি)।
প্রতিষ্ঠানটির গবেষণায় দেখা গেছে, গত ২১ বছরে ঢাকায় জমির দাম ২৭৪০% পর্যন্ত বেড়েছে, যা ২৭ গুণেরও বেশি। একই সময়ে ফ্ল্যাটের দাম বেড়েছে ৭১৬% বা সাতগুণের ওপরে।
আইপিডি গবেষণা বলছে, ২০০০ সালে গুলশান এলাকায় প্রতি কাঠা জমির গড় মূল্য ছিল ২২ লাখ টাকা। ২০২১ সালে এই জমির দাম বেড়ে দাঁড়িয়েছে কাঠাপ্রতি ৬ কোটি ২৫ লাখ টাকা পর্যন্ত। জমির দামের সঙ্গে একই সময়ে গুলশান এলাকায় প্রতি বর্গফুট ফ্ল্যাটের গড় মূল্য ২৪৫০ টাকা থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত।
আইপিডির নির্বাহী পরিচালক পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "নগর উন্নয়নের জন্য সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা না থাকা, রেগুলেটরি বডিগুলোর যথাযথ ভূমিকা পালন না করা এবং সাধারণ মানুষের আবাসনের জন্য যথাযথ সরকারি উদ্যোগ না থাকায় জমি ও ফ্ল্যাটের দাম এভাবে বেড়েছে।"
বাংলাদেশ ব্যাংকের মনিটরি পলিসি রিভিউ রিপোর্ট ২০২০ অনুযায়ী, ১৯৭৫ সালে গুলশান এলাকার এক কাঠা জমির দাম ছিল ২৫ হাজার টাকা। ১৯৯০ সালে এই দাম লাখের ঘরে চলে যায়। আর এর ৩০ বছর পর অর্থাৎ ২০২০ সাল নাগাদ এই এলাকার জমির দাম কাঠা প্রতি এসে দাঁড়িয়েছে পাঁচ কোটি টাকায়। যা বর্তমানে প্রায় ৬.২৫ কোটি টাকা।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যোগাযোগ ব্যবস্থা, পরিকল্পিত নগর, নিরাপত্তা ও আধুনিক নাগরিক সুবিধার কারণে কিছু জায়গায় অ্যাপার্টমেন্টের দাম অনেক বেড়েছে। আবার কিছু জায়গায় চাহিদার তুলনায় নতুন ভবন নির্মাণের জায়গা না থাকায় বেড়েছে অ্যাপার্টমেন্টের দাম।
আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিহ্যাবের সভাপতি আলমগীর শামসুল আলামিন দ্য বিজনেস স্টান্ডার্ডকে বলেন, "নির্মাণ সামগ্রীর দাম বৃদ্ধির কারণে ফ্ল্যাটের দাম বেড়েছে।"
রিয়েল এস্টেট ডেভেলপাররা ফ্ল্যাট এবং জমির দাম বৃদ্ধির জন্য উচ্চ নিবন্ধন ফি এবং হোম লোনের সুদের হারকেও দায়ী করেছে।
ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার বিপরীতে জমির স্বল্পতা
জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের তথ্যমতে, মেগাসিটি ঢাকাতে ৩.২ লাখ হোল্ডিংয়ে প্রায় ১.২ কোটি লোকের বাস।
তন্মধ্যে মাত্র ২০% নিজস্ব বাড়িতে বাস করে এবং বাকি ৮০% ভাড়া বাসায় থাকে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য বলছে, ঢাকার জনসংখ্যা প্রতি বছর গড়ে ৫ লাখ বৃদ্ধি পায়। আর রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) প্রতি বছর প্রায় ২,৫০০টি নতুন ভবনের নকশা অনুমোদন করে।
প্রতিটি ভবনে গড়ে ছয় তলা এবং ফ্লোরপ্রতি দুটি ইউনিট বিবেচনা করলে রাজধানীতে প্রতি বছর প্রায় ৩০,০০০ নতুন ফ্ল্যাট তৈরি হচ্ছে। এসব ভবনের প্রতি ফ্ল্যাটে যদি গড়ে পাঁচজন করে থাকেন, তাহলে প্রতি বছর প্রায় দেড় লাখ মানুষের ফ্ল্যাটগুলোতে আবাসন হচ্ছে বলে ব্যুরো কর্মকর্তাদের অনুমান।
এই খাতে সরবরাহ ও চাহিদার মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য বিদ্যমান, যা স্বভাবতই প্লট ও ফ্ল্যাটের আকাশছোঁয়া দাম বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে।