আজিজ পাইপস: এককালে স্বর্ণপদক পাওয়া কোম্পানিটি এখন কোনমতে টিকে আছে
ভঙ্গুর, সামনে আরো অবনতি হতে পারে- আজিজ পাইপসের সর্বশেষ আর্থিক প্রতিবেদনে এটিই বলা হয়েছে।
২০২০ সালের পরে, কাঁচামাল এবং কার্যকরী মূলধন সংকটের কারণে দুবার উত্পাদন স্থগিত করার ঘোষণা দেয় কোম্পানিটি। সম্প্রতি একজন অভিজ্ঞ ব্যাংকারকে কোম্পানির প্রধান হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে আজিজ পাইপস।
দায়িত্ব নেওয়ার পরই অর্থ মন্ত্রণালয়ে একটি সংকটাপন্ন সংকেত পাঠান নতুন ব্যবস্থাপনা পরিচালক। কোম্পানির ঋণ পুনর্নির্ধারণের আবেদন ব্যাংকগুলো প্রত্যাখ্যান করায় এ পদক্ষেপ নেন তিনি।
কিন্তু ২৫ বছর আগেই আজিজ পাইপসের পরিস্থিতি ছিল পুরোই উল্টো। জনপ্রিয় টেলিভিশন বিজ্ঞাপন, রপ্তানিতে জাতীয় পদক এবং পুঁজিবাজারের শীর্ষ দশটি কোম্পানির একটি হিসেবে প্লাস্টিক পাইপের বাজারে আধিপত্য ছিল আজিজ পাইপসের।
কিন্তু ব্যবসার সম্প্রসারণ এবং পণ্যে বৈচিত্র্য নিয়ে ভুল পদক্ষেপে নেওয়ায় কোম্পানিটি তার খ্যাতি এবং সম্ভাবনা হারিয়েছে। এছাড়া নেতৃত্বের অভাব, অদক্ষ ব্যবস্থাপনা এবং ব্যাংকের সঙ্গে বিরোধে ক্রমশ পতনের দিকেই গেছে কোম্পানিটি।
বর্তমানে টিকে থাকার জন্য আজিজ পাইপসের যেসব বিষয় বিবেচনায় রাখতে হচ্ছে তা হলো- স্থানীয় বাজার থেকে উচ্চ হারে কাঁচামাল ক্রয়, উৎপাদন লাইনের ন্যূনতম ব্যবহার এবং অবশিষ্ট ২০০ জন কর্মচারী ও কর্মকর্তাদের অর্থ প্রদান।
কোম্পানির চেয়ারপারসন হাসিনা আক্তার ২০২০-২১ অর্থবছরের জন্য আজিজ পাইপস লিমিটেডের আর্থিক প্রতিবেদনে লিখেছেন, "কোম্পানি খেলাপি ঋণ এবং কার্যকরী মূলধনের অভাবসহ বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে।" তিনি আশঙ্কা করেছিলেন, ভবিষ্যতে কোম্পানি চালানো কঠিন হয়ে উঠতে পারে।
এদিকে কোম্পানির অডিটর রহমান মোস্তফা আলম অ্যান্ড কো বার্ষিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছেন, ঋণ সেবা ও সুদের সেবার অনুপাত কম হওয়ায় আজিজ পাইপসের ইক্যুইটি বরাবরই কমেছে।
"তারল্য এবং কাঁচামাল সংকটের কারণে কোম্পানিটি ২০২০-২১ আর্থিক বছরে তার উৎপাদন ক্ষমতার মাত্র ১১.২১ শতাংশ ব্যবহার করতে পেরেছে," অডিট রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে।
গত বছরের ডিসেম্বরে পাইপ প্রস্তুতকারকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে ব্যাংকিং সেক্টরে ৪০ বছরের অভিজ্ঞ এসএম হেমায়েত উদ্দিনকে গত বছরের ডিসেম্বরে ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেয় কোম্পানির বোর্ড।
দায়িত্ব নেওয়ার পর হেমায়েত উদ্দিন কোম্পানির আর্থিক সমস্যা সমাধানের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের দ্বারস্থ হন। মন্ত্রণালয়ে লেখা চিঠিতে তিনি ব্যাংক ঋণ নিয়মিত বা পুনঃনির্ধারণে সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।
মন্তব্যের জন্য কোম্পানির একাধিক শীর্ষ কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ করে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড। কিন্তু তাদের কেউই প্রকাশ্যে কথা বলতে রাজি হয়নি।
আজিজ পাইপসের উত্থান
আশির দশকের শেষদিকে দেশের অবকাঠামো খাতে বড় বড় বিনিয়োগ আসতে শুরু করলে সারা দেশে সুপেয় পানির জন্য নলকূপ স্থাপনের কাজ বড় পরিসরে শুরু হয়। আর এই কাজগুলোর জন্য প্রয়োজন পড়ে প্লাস্টিকের পাইপ।
এই ব্যবসা ধরার জন্যই আজিজ পাইপস ১৯৮১ সালে যাত্রা শুরু করে।
১৯৮৫ সালে বার্ষিক ১২০০ টন ইনস্টল ক্ষমতা নিয়ে বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু করে তারা। ১৯৮৫ থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত ১২ বছরে কোম্পানিটি প্রতি বছর ৭৫০০ টন উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি করেছে।
মতিঝিলের আজিজ ভবনে কোম্পানিটির হেড অফিস এবং ফরিদপুরে কারখানা। আবদুল হালিম, আহসান উল্লাহ ও আসাদ উল্লাহর হাত ধরেই কোম্পানিটি যাত্রা শুরু করে।
উদ্যোক্তা পরিচালক হিসেবে তারা এখনও কোম্পানিটির বোর্ডে রয়েছেন।
তখনকার দিনে আজিজ পাইপসের বার্ষিক টার্নওভার ছিল প্রায় ৬০ কোটি টাকা, যা এখন কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ১ কোটি টাকায়।
কোম্পানিটি ১৯৮৬ সালে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ এবং ১৯৯৫ সালে চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত হয়।
পণ্য রপ্তানিকারক হিসেবে ফার্মটি ১৯৯৭-৯৮ অর্থবছরে জাতীয় পদক পায়। নব্বইয়ের দশকে কোম্পানিটি ঢাকার বাজারের শীর্ষ দশ কোম্পানির তালিকায় ছিল।
বর্তমানে, ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি) এবং আইসিবি ইউনিট ফান্ড এর এই কোম্পানিতে ১২.৭৭ শতাংশ শেয়ার রয়েছে।
কোম্পানির এক কর্মকর্তা বলেন, এখনও প্রচুর অর্ডার আসে, কিন্তু উৎপাদন সমস্যার কারণে সরবরাহ করা যাচ্ছে না।
যেভাবে পতন
পাইপের ব্যবসা প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাওয়ার পর কোম্পানিটি ১৯৯৮ সালে ব্যবসা ডাইভারসিফাই করার সিদ্ধান্ত নেয়।
এরই প্রেক্ষিতে কোম্পানিটি কাঠের বিকল্প হিসেবে প্লাইউড এর ব্যবসায় বিনিয়োগ করে। পাইপের সুনাম ব্যবহার করে প্রতিষ্ঠানটি এই ব্যবসাটি ধরতে চেষ্টা করেছিল।
তবে এই সময়ে পাইপের ব্যবসায় প্রতিযোগীতা বেড়ে যাওয়ায় কোম্পানিটি বাজার ধরে রাখতে বাকিতে বিক্রি বাড়িয়ে দেয়।
এদিকে কোম্পানির ব্যবস্থাপনা দূর্বলতার কারণে বাকিতে বিক্রির টাকা উদ্ধার করতে পারেনি তারা। তাই সেখানে প্রচুর টাকা আটকে যাওয়ায় ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল শর্টেজে
পড়ে আজিজ পাইপস।
এসব সমস্যার মধ্যে প্লাইউডের ব্যবসা সেভাবে করতে পারেনি তারা।
অথচ কোম্পানিটির অনেক পরে ব্যবসা শুরু করে প্রাণ-আরএফএল, ন্যাশনাল পলিমার, বিআরবি এর মতো কোম্পানিগুলো ভাল ব্যবসা করছে। আর প্লাইউডের ব্যবসায়ও অন্য কোম্পানিগুলো ভাল করছিল।
এমন পরিস্থিতিতে আজিজ পাইপস ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করতে পারেনি।
সাউথইস্ট ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, উত্তরা ব্যাংক এবং ডাচ বাংলা ব্যাংকের কাছে কোম্পানিটির ঋণ ছিল।
উৎপাদন কমে আসায় বর্তমানে কোম্পানিটি তার ২০০ কর্মকর্তা ও কর্মচারীর বেতন যোগাতে পারছে।
কোম্পানিটির একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রতিষ্ঠানটির মূল উদ্যোক্তাদের মধ্যে আহসান উল্লাহ ও আসাদ উল্লাহ দেশের বাইরে থাকেন। তারা কোম্পানির মিটিংয়ে আসেন না। অন্যদিকে, আবদুল হালিম সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতে পারছেন না। মূলত পরিচালনা পর্ষদের দূর্বলতার প্রভাব ব্যবস্থাপনায় পড়েছে।
বর্তমান আর্থিক পরিস্থিতি
শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্তির পর কোম্পানিটি ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত নিয়মিত ডিভিডেন্ড দিয়েছে।
এরপর লোকসানের কারণে দীর্ঘদিন ডিভিডেন্ড দিতে পারেনি।
এরপর ২০১৭ সাল থেকে আবার ডিভিডেন্ড দিতে শুরু করে। তবে লোকসানের কারণে ২০২০-২১ হিসাব
বছরে তা পারেনি তারা।
এদিকে ডিভিডেন্ড দিতে না পারলেও কোম্পানিটির শেয়ার দর নিয়মিত কারসাজি করে বাড়ানো হয়।
২০২১ সালে এর শেয়ার দর কোন কারণ ছাড়াই ৮৭ টাকা থেকে ৯০ শতাংশ বেড়ে ১৬৫ টাকায় উঠেছিল।
আবার সেখান থেকে ৫০ শতাংশ কমে ৮৩ টাকায় নেমে আসে। একই ভাবে কোম্পানিটির শেয়ার চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে বেড়েছিল।
এর আগে অস্বাভাবিকভাবে শেয়ার লেনদেন এবং দর বৃদ্ধির কারণে ২০১৮ সালে শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের মূল ট্রেডিং প্লাটফর্মে কোম্পানিটির লেনদেন বন্ধ করে দিয়েছিল।
তবে বাংলাদেশে সিকিউরিটিজ এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) আজিজ পাইপসের শেয়ার নিয়ে কারসাজি করার দায়ে কাউকে শাস্তি দেয়নি।