গ্রাহকদের জন্য এবার বৈদ্যুতিক শক!
সাম্প্রতিক সময়ে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি, উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি এবং স্থানীয় মুদ্রার অবমূল্যায়নের ফলে জীবনযাত্রার ব্যয় নির্বাহে দুর্দশার মধ্যে রয়েছেন গ্রাহকরা। তাদের ওপর আরেকটি আঘাত অচিরেই আসতে চলেছে, কারণ খুচরা বা গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম ১৫ শতাংশের বেশি বাড়িয়ে প্রতিইউনিট (কিলোওয়াট ঘণ্টা) ৮ টাকা ২৩ পয়সা করার সুপারিশ করেছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)-র কারিগরি কমিটি।
বিইআরসি চেয়ারম্যান আবদুল জলিল ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, সরকার বিদ্যুতে ভর্তুকি দেওয়া বন্ধ করলে, কারিগরি কমিটির সুপারিশের চেয়েও উচ্চ হতে পারে খুচরা পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম।
গত নভেম্বরে পাইকারিতে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর পর ছয়টি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থা— খুচরা পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম প্রায় ২০ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে এক গণশুনানিতে। রোববার (৮ জানুয়ারি) ঢাকার বিয়াম মিলনায়তনে এ বিষয়ে দিনব্যাপী গণশুনানি শুরু হয়েছে।
বিইআরসি চেয়ারম্যান আবদুল জলিলসহ পাঁচ সদস্যের একটি প্যানেল বিদ্যুৎ বিতরণ ও সরবরাহকারী সংস্থাগুলোর প্রস্তাব শোনেন।
বর্তমানে খুচরা পর্যায়ে প্রতিইউনিট বিদ্যুতের দাম ৭.০২ টাকা।
তবে খুচরা পর্যায়ে কারিগরি কমিটির সুপারিশকৃত মাত্রার চেয়ে কম বা বেশি, যেভাবেই বাড়ানো হোক না কেন–তা দেশের কৃষি উৎপাদনকে ব্যাপক নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করবে, এতে নিত্যপণ্যের দামে আরেকদফা মূল্যস্ফীতির আঘাত আসবে, বেড়ে যাবে জীবনযাত্রার ব্যয়। এমন সতর্কবার্তা দিয়েছেন অর্থনীতিবিদ ও বিদ্যুৎ, জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা।
দেশের সর্বোচ্চ বৈদেশিক মুদ্রা আয়কারী–তৈরি পোশাক ও বস্ত্র খাতও এতে করে আন্তর্জাতিক বাজারে– প্রতিযোগী সক্ষমতা হারানোর আশঙ্কা করছে, গত জুনে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির পর ইতোমধ্যেই এদিক দিয়ে প্রভাবিত হয়েছে এই খাত।
ধান উৎপাদনেও পড়বে নেতিবাচক প্রভাব, বিশেষত আসন্ন বোরো ধানের মওসুমে, যখন সেচের জন্য বিদ্যুতের ব্যাপক চাহিদা থাকে। রেকর্ড মূল্যস্ফীতির শিকার চাষিদের পক্ষে বাড়তি দাম দিয়ে সেচকাজ চালিয়ে যাওয়া হয়ে পড়বে কঠিন চ্যালেঞ্জ।
এর আগে গত বছরের নভেম্বরে পাইকারি বিদ্যুতের দাম প্রতি কিলোওয়াট ঘণ্টায় ১৯.৯২ শতাংশ বাড়িয়ে ৬ টাকা ২০ পয়সা করার ঘোষণা দেয় বিইআরসি, যা কার্যকর হয় ডিসেম্বর থেকে।
পাইকারিতে দাম বৃদ্ধির পেক্ষাপটে, এরসঙ্গে দাম সমন্বয়ের জন্য ছয়টি বিতরণ ও একটি সঞ্চালন কোম্পানি প্রস্তাব দিয়েছে রেগুলেটরি কমিশনকে।
রোববারের গণশুনানিতে বিতরণ কোম্পানিগুলোর কর্মকর্তারা তাদের রাজস্ব প্রয়োজনীয়তার দিকটি তুলে ধরে, পাইকারি মূল্যবৃদ্ধিকে খুচরা পর্যায়ে মূল্যবৃদ্ধির মাধ্যমে পুরোপুরি সমন্বয় করার প্রস্তাব দেন। একইসঙ্গে, তারা বিতরণ মূল্য ৪২.৭৩ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব দেন। বাংলাদেশ পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি লিমিটেড তাদের বিতরণ চার্জ ১১৮.৫১ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে।
এসব প্রস্তাব পর্যালোচনার পর বিইআরসির কারিগরি কমিটি খুচরা পর্যায়ে ১৫.৪৩ শতাংশ দাম বাড়ানোর সুপারিশ করে।
কমিটির মতে, এভাবে দাম বাড়ালে বিতরণ কোম্পানিগুলো বাড়তি ৮ হাজার কোটি টাকা আয় করতে পারবে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে।
এছাড়া, বিতরণ চার্জ গড়ে ৩ শতাংশ এবং সঞ্চালন চার্জ ১৩.১৯ শতাংশ বাড়ানোর সুপারিশও করেছে।
বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানিগুলোর প্রস্তাব ও কারিগরি কমিটির সুপারিশের বিরোধিতা করে কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)-এর জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক এম শামসুল হক বলেছেন, গ্রাহক পর্যায়ে দাম বাড়ানোর মাধ্যমে এই কোম্পানিগুলো যেভাবে রাজস্ব বাড়াতে চাইছে, সেটা তাদের অভ্যন্তরীণ ব্যয় সমন্বয়ের মাধ্যমেই করা সম্ভব।
তিনি বলেন, 'নজিরবিহীন এই মূল্যস্ফীতি ও মজুরি ঘাটতির সময়ে, অর্থনীতির সামষ্টিক ও ব্যষ্টিক পর্যায়ের ভোক্তাদের ক্ষতিগ্রস্ত না করেই কোম্পানিগুলো দরকারি রাজস্ব ব্যবস্থাপনা করতে পারবে। যেমন ধরেন ডেসকো উদ্বৃত্ত আয়ের পরিস্থিতিতে রয়েছে। অন্যান্য কোম্পানিগুলোর আর্থিক প্রতিবেদন ও তাদের আয়ের উৎস লক্ষ করলে দেখবেন, তাদের কারোরই বিতরণ মূল্য বাড়ানোর কোনো প্রয়োজন নেই'।
তবে, বিইআরসি চেয়ারম্যান আবদুল জলিল জানিয়েছেন, গণশুনানি চলাকালে দেওয়া সুপারিশগুলো পর্যালোচনা করে আগামী ৩০ জানুয়ারির মধ্যে খুচরা পর্যায়ে দাম বাড়ানোর ঘোষণা দেওয়া হবে।
রপ্তানি বাজারে প্রতিযোগী সক্ষমতা হারানোর শঙ্কা
দেশের রপ্তানিমুখী পোশাক শিল্প খাতের আশঙ্কা, বিদ্যুতের খুচরা মূল্যবৃদ্ধি তাদের উৎপাদন খরচ বাড়াবে। এতে করে আন্তর্জাতিক বাজারে তাদের প্রতিযোগিতার সক্ষমতায় প্রভাব পড়বে।
বাংলাদেশের নিট পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারকদের সমিতি (বিকেএমইএ)-র নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে তাদের কোনো কারখানারই এই বাড়তি ব্যয় বহনের সক্ষমতা নেই।
তিনি বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে তৈরি হওয়া উচ্চ মূল্যস্ফীতির এই সময়ে বৈশ্বিক চাহিদা পড়তির দিকে থাকায়, প্রচণ্ড চাপের মধ্যে রয়েছে পোশাক খাত। বেশকিছু সংখ্যক পোশাক রপ্তানিকারক এখনও তাদের বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করতে পারেননি। বিল বকেয়া থাকায় তাদের কাউকে কাউকে আইনি পদক্ষেপের সম্মুখীন হতে হয়েছে বলেও জানান হাতেম।
এই পরিস্থিতিতে সুপারিশকৃত দাম বৃদ্ধি বাস্তবায়ন করা হলে, বড় সংখ্যক কারখানাই উৎপাদন অব্যাহত রাখতে সমস্যার মধ্যে পড়বে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
এই ব্যবসায়ী নেতার অভিযোগ, বিদ্যুতের পর্যাপ্ত বা মানসম্মত সরবরাহ নিশ্চিত না থাকায়– এখনও তাদের ক্যাপটিভ জেনারেটর চালিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ডিজেলের পেছনে ব্যয় করতে হচ্ছে।
তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির মূল্য কমতে থাকলেও, তার সুফল পাচ্ছে না স্থানীয় শিল্প।
ধান উৎপাদন আরও ব্যয়বহুল হবে
বোরো মৌসুমে বিভিন্ন ধরনের প্রায় ১৫ লাখ সেচ পাম্প ব্যবহার করা হয়, যা দেশের মোট ধান উৎপাদনে ৫০ শতাংশের বেশি অবদান রাখে। কৃষি খাত সংশ্লিষ্টদের মতে, এরমধ্যে ২৫ শতাংশ পাম্প-ই বিদ্যুৎ চালিত। তাই বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হলে, সেচ ব্যয়ও উল্লেখযোগ্য হারে বাড়বে বলে জানান তারা।
কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম খান টিবিএসকে বলেন, 'বোরো মৌসুমটা বিভিন্ন উপকরণ নির্ভর, এরমধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সেচ। এর আগেই বেড়েছে জ্বালানি তেলের দাম, এবার বিদ্যুতের দামও বাড়লে, দুইয়ে মিলে সেচের খরচ আরও বেড়ে যাবে। এটা কৃষককে চাষাবাদে অনুৎসাহিত করতে পারে, যেখানে আমরা পতিত জমি চাষের আওতায় আনার কথা বলছি'।
তিনি পরামর্শ দেন– আমরা যদি বোরো মওসুমে ভালো ফলন চাই, তাহলে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হলেও– বিদ্যুৎ ও ডিজেলের কারণে কৃষকের যে বাড়তি খরচ হবে, সেটা তাকে নগদ সহায়তা হিসেবে ফেরত দিতে হবে।
টিকে গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের পরিচালক (ফাইন্যান্স অ্যান্ড অপারেশন) মো. শাফিউল আতহার তাসলিম টিবিএসকে বলেন, আমরা এখনো গ্যাসের সংকটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। এতে করে, উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এছাড়া রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব তো আছেই। তার ওপর বিদ্যুতের দাম বাড়লে আরেক দফা কষ্ট বাড়বে, ভোক্তার ওপর চাপ তৈরি হবে'।
জীবনযাত্রা ব্যয় ও নিত্যপণ্যের দাম বাড়বে
সাম্প্রতিক সময়ে তরল জ্বালানি ও গ্যাসের দাম বৃদ্ধি এবং মার্কিন ডলারের বিপরীতে স্থানীয় মুদ্রার অবমূল্যায়নের কারণে, গত বছরের গড় মুদ্রাস্ফীতি উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে ৭.৭০ শতাংশে দাঁড়িয়েছে- যা গত ১১ বছরে সর্বোচ্চ বার্ষিক গড়।
রেকর্ড মূল্যস্ফীতির মধ্যে জীবনযাপনের ব্যয় নির্বাহে সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগে আছে শহর ও গ্রামাঞ্চলের নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষ। বিদ্যুতের খুচরা পর্যায়ে দাম বৃদ্ধি তাদের জীবন সংগ্রামকে আরও কঠিনতর করে তুলবে বলে জানাচ্ছেন অর্থনীতিবিদ ও মজুরি বিশেষজ্ঞরা।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) গত ডিসেম্বর মাসের তথ্যে দেখা গেছে, ওই মাসে মূল্যস্ফীতি হারের চেয়ে বেশ নিম্ন ছিল মজুরি বৃদ্ধির হার।
গত ২ জানুয়ারি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বিবিএস জানায়, ডিসেম্বরে মজুরি বেড়েছে ৭.০৩ শতাংশ হারে, যা আগের মাসে ছিল ৬.৯৮ শতাংশ। আগের মাসের তুলনায় সামান্য এই বৃদ্ধি ঘটলেও, তা ছিল মূল্যস্ফীতি হারের চেয়ে ১.৬৮ শতাংশ কম।
গত ডিসেম্বরে রেকর্ড রপ্তানি আয় অর্জন করেছে পোশাক খাত। তবে এই খাতের শ্রমিকরা ন্যূনতম মানসম্মত জীবিকা নির্বাহের দরকারি আয়ও করতে পারছেন না বলে জানিয়েছে স্থানীয় একটি থিঙ্ক ট্যাংক। ডিসেম্বরের মূল্যস্ফীতির চিত্র তাদের মজুরি বৃদ্ধির দাবিকে সমর্থন দিচ্ছে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ (বিআইডিএস) এর সাবেক মহাপরিচালক ড. মোস্তফা কে মুজেরি এই বাস্তবতায়, বাজার মনিটরিং, দরিদ্রদের জন্য খাদ্য সহায়তার পাশাপাশি উৎপাদন বাড়াতে বিভিন্ন দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ গ্রহণ করার মাধ্যমে সরকারের প্রতি জোরালো নীতিগত পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য পরিষদ গার্মেন্টস কর্মীদের মাসিক বেতন বর্তমানের ৮ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ২২ হাজার টাকা (৬৫ শতাংশ হবে মূল বেতন) করার দাবি জানিয়েছে।
ঐক্য পরিষদের চেয়ারম্যান তৈহিদুর রহমান জানান, নিত্যপণ্য, জীবনযাত্রার ব্যয় ও বাড়িভাড়া বেড়ে যাওয়ার প্রেক্ষিতে তারা এই দাবি করেছেন।