এবার পালা গ্যাসের দাম বাড়ানোর
কিছুদিন আগে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির পরপরই এ সপ্তাহে খুচরা পর্যায়ে গ্যাসের দাম ১৭ শতাংশ বাড়তে পারে বলে জানিয়েছে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সূত্র। এর ফলে ভোক্তাদের মূল্যস্ফীতিজনিত যন্ত্রণা আরও বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
তিতাসসহ অন্য গ্যাস বিতরণকারী সংস্থাগুলো গ্যাসের দাম ও বিতরণ খরচের সমন্বয় চেয়ে সম্প্রতি বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছে।
জ্বালানি খাতসংশ্লিষ্ট সূত্রের তথ্যমতে, নতুন করে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির ফলে শিল্প খাত, বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং ক্যাপটিভ বিদ্যুৎকেন্দ্র সবচেয়ে বড় ধাক্কা খাবে।
জমা দেওয়া মূল্য সমন্বয় প্রস্তাব অনুসারে, শিল্প ও ছোট আকারের ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ ইউনিটগুলো এখন প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের জন্য যথাক্রমে ১১.৭৮ টাকা ও ১৬ টাকা দাম দেয়, যা একলাফে ২৪ টাকা হতে পারে।
প্রস্তাবিত মূল্য অনুসারে, এক চুলা ব্যবহারে প্রতি মাসে খরচ প্রায় ১৬৮ টাকা বেড়ে ১ হাজার ১৫৮ টাকা হবে। আর দুই চুলা ব্যবহারের খরচ প্রায় ১৮৩ টাকা বেড়ে ১ হাজার ২৬৩ টাকা হবে।
সর্বশেষ মূল্যবৃদ্ধির প্রায় আট মাস পর আবারও দাম বাড়ছে গ্যাসের। জ্বালানি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এবারের মূল্যবৃদ্ধির পর ২০২৩ অর্থবছরে জ্বালানি খাতে সরকারের দেওয়া ৬,০০০ কোটি টাকা ভর্তুকি অনেকটাই কমে যাবে। তবে বিশেষজ্ঞরা এই পদক্ষেপকে সমগ্র জ্বালানি খাতের জন্য 'অযৌক্তিক' ও 'ক্ষতিকর' হিসেবে অভিহিত করেছেন।
এর আগেরবার ২০২২ সালের জুনে গ্যাসের ২৩ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধি বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআসি) গণশুনানির পর ঘোষণা দিলেও, এবারের দ্রুত মূল্য সমন্বয় নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে কার্যকর করার সম্ভাবনা রয়েছে।
গত ১৪ বছরে গ্যাসের দাম ১৭৪.৪২ শতাংশ বেড়েছে।
এ বিষয়ে মন্তব্যের জন্য জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (অপারেশন) এসএম জাকির হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড। তবে তিনি মূল্যবৃদ্ধির সম্ভাবনা বাতিল করে দেননি, আবার কোনো মন্তব্যও করেননি।
উদ্যোক্তাদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া
শিল্পোদ্যোক্তাদের মধ্যে মূল্যবৃদ্ধির এ আলোচনা নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে। অনেকে দাবি করছেন, এর ফলে বাংলাদেশের শিল্প খাতের প্রতিযোগিতা-সক্ষমতা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
কেউ কেউ গ্যাসের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহের জন্য বাড়তি দাম দিতে প্রস্তুত। অন্যদিকে অনেকে বলছেন, গ্যাসের বর্তমান সংকটময় পরিস্থিতির উন্নতি না করে কেবল মূল্য বাড়ানো হলে শিল্প টিকবে না।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিকেএমইএ)-এর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, তারা সম্প্রতি সরকারকে চিঠি দিয়ে গ্যাস সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন হলে বাড়তি মূল্য দিতে রাজি আছেন বলে জানিয়েছেন।
'কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতির উন্নতি না হলে শিল্প টিকে থাকতে পারবে না,' দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন তিনি।
বর্তমানে শিল্প ও ছোট পর্যায়ের ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ জন্য ব্যবহার হওয়া গ্যাসের দাম ঘনমিটারপ্রতি ১৬ টাকা, আর এর বাইরে অন্যান্য কাজে ব্যবহার হওয়া গ্যাসের দাম ১২ টাকা।
লিটল স্টার স্পিনিং মিলস লিমিটেড-এর চেয়ারম্যান মোহাম্মদ খোরশেদ আলম টিবিএসকে বলেন, 'টেক্সটাইলের কিছু আইটেম এখন লোকসানে বিক্রি করতে হচ্ছে। দেড় বছর আগে যে গ্যাসের দাম ৮ টাকা ছিল, তা এখন ১৬ টাকা। দাম বেড়ে ২৪ টাকা হলে শিল্প টিকতে পারবে না।'
উৎপাদন হিসেবের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, বর্তমানে প্রতি কেজি ইয়ার্ন উৎপাদনে গ্যাস-বিদ্যুতের ব্যয় ৮ শতাংশ। 'তা যদি এখন ১৬ শতাংশ হয়ে যায়, তাহলে আমরা বৈশ্বিক ব্যবসায়িক প্রতিযোগিতা-সক্ষমতায় পিছিয়ে যাব।'
এ সময় উজবেকিস্তানে গ্যাসের দামের উদাহরণ তুলে ধরেন তিনি। দেশটিতে শিল্পখাতে প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম পড়ে সাত টাকা।
চারগুণ বেশি বিতরণ খরচ দাবি তিতাস-এর
দেশের বৃহত্তম গ্যাস বিতরণ কোম্পানি তিতাস গ্যাস বিতরণ চার্জ এক লাফে চারগুণ বাড়িয়ে প্রতি ঘনমিটারে ০.৬৩৮৭ টাকা করতে কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন জানিয়েছে।
কোম্পানিটির প্রস্তাব অনুযায়ী, বর্তমানে ধার্য থাকা প্রতি ঘনমিটারে ০.১৩০০ টাকা বিতরণ খরচ এর নগদ প্রবাহের ওপর মারাত্মক প্রভাবে ফেলেছে। কারণ যেকোনো ভোক্তার গ্যাস বিলের ৩ শতাংশ উৎসে কর হিসেবে রাষ্ট্রীয় কোষাগারের সঙ্গে যোগ হয়।
প্রস্তাবে বলা হয়েছে, ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরের আগে উৎসে কর গ্যাসের ওয়েটেড গড় মূল্যের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ছিল। কিন্তু এখন তা সব ভোক্তার বিলে প্রযোজ্য হওয়ার জন্য সংশোধিত করা হয়েছে। এর ফলে কোম্পানিটির গ্যাসের ইউনিটপ্রতি আয় ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে।
কর পরিশোধের আগে ২০১৪-২০১৫ অর্থ বছরে তিতাসের আয় ছিল ৯৭০ কোটি টাকা। গত অর্থ বছরে তা কমে ৩৮৬ কোটিতে নেমেছে।
অন্যদিকে এই সময়ে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে উৎসে করের অবদান ২৮২.৪৬ কোটি টাকা বেড়ে ৪৪২ কোটি টাকা হয়েছে।
অযৌক্তিক
গ্যাসের এই চড়া মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা। অনেকে একে অযৌক্তিক ও চূড়ান্তভাবে জ্বালানিখাতের জন্য ক্ষতিকর হিসেবে মনে করছেন।
কনজিউমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)-এর জ্বালানিবিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. সামছুল আলম বলেন, 'আমাদের পর্যবেক্ষণে এ ধরনের মূল্যবৃদ্ধির কোনো কারণ খুঁজে পাইনি। এমন সিদ্ধান্তের ফলে গ্যাস ও জ্বালানি খাত পঙ্গু হয়ে পড়বে।'
তিনি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, এ নীতির ফলে জনগণের জন্য বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়বে, কিন্তু এর মাধ্যমে নিয়মিত চলা লোডশেডিং ও গ্যাস রেশনিং কমানো সম্ভব হবে না।