পাঁচ বছরেও রিটার্ন নেই, লোকসানি পদ্মা ব্যাংক থেকে বিনিয়োগ প্রত্যাহার করবে আইসিবি
পাঁচ বছর ধরে কোন রিটার্ন না পাওয়ায়- পদ্মা ব্যাংক (সাবেক ফারমার্স ব্যাংক) থেকে বিনিয়োগ প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি)। সমস্যাগ্রস্ত ব্যাংকটিতে নিজেদের শেয়ার বিক্রি করতে দেশি-বিদেশি কৌশলগত বিনিয়োগকারী খুঁজছে রাষ্ট্রায়ত্ত বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠানটি।
আইসিবি'র ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. আবুল হোসেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'ব্যাংক মুনাফা করলে তার অংশ পাওয়ার জন্য আমরা ইক্যুইটিতে বিনিয়োগ করেছি। কিন্তু এত দিনেও পদ্মা ব্যাংকের বিনিয়োগ থেকে কোন রিটার্ন পাইনি। এ কারণেই আইসিবির পরিচালনা পর্ষদ শেয়ার বিক্রি করে বিনিয়োগ প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে'।
ইক্যুইটিতে বিনিয়োগ হলো- পুঁজিবাজারে একটি কোম্পানির শেয়ার ক্রয়ের মাধ্যমে তাতে অর্থ লগ্নী করা।
এবিষয়ে জানতে চাইলে, পদ্মা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) তারেক রিয়াজ খান টিবিএসকে বলেন, পদ্মা ব্যাংক থেকে আইসিবির বিনিয়োগ প্রত্যাহার করার বিষয়ে শুনেছি। তবে এখানে আইসিবি ও রাষ্ট্রায়ত্ত চার ব্যাংক যে বিনিয়োগ করেছে, তা শতভাগ সরকারি তহবিল। এজন্য আইসিবির বিনিয়োগ প্রত্যাহার করতে হলে, বার্ষিক সাধারণ সভায় অনুমোদন নিতে হবে, বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদনও লাগবে।
আইসিবি তার বিনিয়োগ তুলে নিয়ে পদ্মা ব্যাংকের কোনো সমস্যা হবে কি-না, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, 'বিষয়টি সম্পর্কে আমি পুরোপুরি অবগত নই।'
ঋণ কেলেঙ্কারিতে ডুবতে সাবেক ফারমার্স ব্যাংককে উদ্ধার করতে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করার পর প্রায় পাঁচ বছর ধরে কোনো রিটার্ন না পাওয়ায় হতাশ পড়ছে চার রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকও। ব্যাংকগুলোর সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো এ তথ্য জানিয়েছে।
সূত্রগুলো আরও জানায়, ইক্যুইটিতে বিনিয়োগের বিপরীতে লভ্যাংশ বা অন্তত বিনিয়োগের অর্থের বিপরীতে বর্তমান আমানত হারে সুদ চেয়ে বারবার চিঠি দিয়েও – পদ্ম্যা ব্যাংকের কর্তৃপক্ষের কোনো সাড়া পাচ্ছে না ব্যাংকগুলো।
এ বিষয়ে পদ্মা ব্যাংকের এমডি বলেন, 'পদ্মা ব্যাংক এখনও অপারেটিং লোকসানে রয়েছে। ফলে ইক্যুইটি ইনভেস্টর প্রতিষ্ঠানগুলো কোন রিটার্ন পাচ্ছে না'।
সমস্যাগ্রস্ত বেসরকারি ব্যাংকটিকে দেউলিয়াত্ত থেকে বাঁচাতে ২০১৮ সালের এপ্রিলে অর্থমন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তে ব্যাংকটিতে ৭১৫ কোটি টাকা ইক্যুইটি বিনিয়োগ করে ৬৫ শতাংশ শেয়ার কেনে আইসিবি এবং রাষ্ট্রায়ত্ত চার বাণিজ্যিক ব্যাংক- সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী। ওই সময় প্রতিটি ব্যাংক ১৬৫ কোটি টাকা করে এবং আইসিবি ৫৫ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছিল, পরে আইসিবির বিনিয়োগ আরও ৩০ কোটি টাকা বাড়ে।
রাষ্ট্রায়ত্ত একটি বাণিজ্যিক ব্যাংকের শীর্ষ একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে টিবিএসকে বলেন, আমরা সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে নেওয়া আমানতের টাকা পদ্মা ব্যাংকের শেয়ারে বিনিয়োগ করেছি। তাই গত পাঁচ বছরে সেখান থেকে কোন রিটার্ন না পেলেও, বিনিয়োগ করা টাকার বিপরীতে আমানতকারীদের ৬% হারে সুদ দিতে হচ্ছে। এতে আমাদের লোকসান হচ্ছে।
তিনি বলেন, 'প্রায়ই ইক্যুইটির বিপরীতে লভ্যাংশ বা এতে বিনিয়োগ করা অর্থের আমানতের বর্তমান সুদহার বিবেচনা করে পদ্মা ব্যাংকের কাছে টাকা চেয়ে চিঠি পাঠানো হয়। ব্যাংকটি সে চিঠি রিসিভ করলেও টাকা দেওয়া দূরের কথা, কোনো জবাবই দেয় না'।
২০১৮ সালের এপ্রিলে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক ও আইসিবি থেকে বিনিয়োগ নেওয়ার সময় বলা হয়েছিলো যে, ফারমার্স ব্যাংক পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হবে। তখন এসব প্রতিষ্ঠান তাদের শেয়ার বিক্রি করে বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে নিতে পারবে। নাম পাল্টে পদ্মা ব্যাংক লিমিটেড নামে পরিচালিত হওয়া ব্যাংকটি এখনও পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হতে পারেনি।
আইসিবির এমডি আবুল হোসেন পদ্মা ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদেরও একজন সদস্য। তিনি বলেন, 'পদ্মা ব্যাংক কবে তালিকাভুক্ত হবে, তাও বোঝা যাচ্ছে না। তাই বিনিয়োগ প্রত্যাহার করতে শেয়ার বিক্রির জন্য স্ট্র্যাটেজিক বায়ার খুঁজছি আমরা। বায়ার পেলেই পদ্মা ব্যাংকের শেয়ার বিক্রি করে দেওয়া হবে'।
আইসিবি ও বিনিয়োগকারী ব্যাংকগুলোর একাধিক কর্মকর্তা টিবিএসকে জানান, সরকারের সিদ্ধান্তে ব্যাংকটিকে বাঁচাতে বিনিয়োগ করতে বাধ্য হয়েছিল তারা।
এসব প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহীদের (সিইও) পদ্মা ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে নিয়োগ দিয়ে গ্রাহকদের আস্থা অর্জনের চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু, প্রত্যাশা অনুযায়ী ব্যাংকটি ঘুরে দাঁড়াতে তো পারেইনি বরং লোকসানের বৃত্তেই ঘুরপাক খাচ্ছে বলে যোগ করেন তারা।
তারল্য সংকটের কারণে জীবন বীমা করপোরেশন, তিতাস গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানিসহ সরকারের অনেক প্রতিষ্ঠানের আমানত মেয়াদ পূর্তিতেও ফেরত দিতে পারছে না পদ্মা ব্যাংক। জীবন বীমা করপোরেশনের আমানতের টাকা ফেরত দিতে ২০২৯ সাল পর্যন্ত সময় নিয়েছে ব্যাংকটি।
আইসিবির সংকট
সূত্রগুলো জানায় জানায়, সাম্প্রতিক সময়ে পুঁজিবাজারে মন্দার কারণে ভালো মুনাফা করতে পারছে না আইসিবি। এতে লভ্যাংশ প্রদানের সক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে। এছাড়া, পুঁজিবাজারের বাইরে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করে তহবিল আঁটকে যাওয়াও আইসিবি'র সংকটের আরেক কারণ।
সূত্রগুলো আরও জানায়, আইসিবি অর্থমন্ত্রণালয়ের কাছে ১০ হাজার কোটি টাকা ও বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে ৩ হাজার কোটি টাকার তহবিল চেয়েছে। যদিও এবিষয়ে তেমন কোনো অগ্রগতি নেই।
এ পরিস্থিতিতে পদ্মা ব্যাংকের বিনিয়োগ তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেও – এই ব্যাংকে থাকা ১৫৭ কোটি টাকার আমানত আপাতত নগদায়ন করছে না আইসিবি।
পদ্মা ব্যাংকের একীভূতকরণের উদ্যোগও স্থবির
বিপুল খেলাপি ঋণ, আমানতের অর্থ ফেরত দিতে না পারা এবং বড় অংকের লোকসান নিয়ে ২০২১ সালের জুলাইতে রাষ্ট্রীয় কোনো ব্যাংকের সঙ্গে পদ্মা ব্যাংককে একীভূত (মার্জার) করা অথবা পদ্মা ব্যাংককে অধিগ্রহণের (এক্যুইজিশন) করার প্রস্তাব দিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেন ব্যাংকটির তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. এহসান খসরু।
ওই সময় দেওয়া ব্যাংকটির তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ এর প্রথম ছয়মাসে ব্যাংকটির পরিচালন (অপারেটিং) লোকসানের পরিমাণ ছিল ১২০ কোটি টাকা।
বিদ্যমান আইনের সংশোধনী সংসদে পাস হওয়ার পর, সেই মোতাবেক পদ্মা ব্যাংক ও রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বেসিক ব্যাংককে একীভূত করা যেতে পারে বলে ওই সময় জানিয়েছিলেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। কিন্তু, ওই আইন এখনও চূড়ান্ত হয়নি।
রাষ্ট্রায়ত্ত চার ব্যাংক ও আইসিবির বিনিয়োগে ফারমার্স ব্যাংককে বাঁচানোর চেষ্টা করা তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে একান্ত সাক্ষাৎকারে টিবিএসকে বলেছিলেন, পদ্মা ব্যাংককে 'নবজীবন' দেওয়ার সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল না।
সেসময় মুহিত টিবিএসকে বলেছিলেন, 'আমি এখন বুঝতে পারছি, ফারমার্স ব্যাংককে রক্ষা করার সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত হয়নি। প্রতিষ্ঠানটি বাঁচানোর চেয়ে একে বিলুপ্ত হতে দেওয়াই যথাযথ হতো'। তবে রাজনৈতিক চাপে ফারমার্স ব্যাংককে রক্ষায় উদ্যোগ নিয়েছেন বলেও জানান তিনি।
'যখন পদক্ষেপ নেওয়া সম্পন্ন হলো (ফারমার্স ব্যাংক রক্ষায়), তখন ভেবেছিলাম প্রতিষ্ঠানটি আপনা থেকেই বিলুপ্ত হয়ে যাবে,' উল্লেখ করেন সাবেক অর্থমন্ত্রী।
একীভূতকরণের প্রস্তাব দেওয়ার পর, ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে পদ্মা ব্যাংক এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বিনিয়োগ ব্যাংক ডেলমর্গান অ্যান্ড কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করেছে ব্যাংকটি। ডেলমর্গান ৭০ কোটি ডলার বিনিয়োগ আনতে মধ্যস্থতা করবে। এরমধ্যে ৩৫ কোটি ডলার আসবে ইক্যুইটি বিনিয়োগ হিসেবে, আর বাকি ৩৫ কোটি ডলার আসবে ঋণ হিসেবে।
ওই বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, আগামী ৪ থেকে ৬ মাসের মধ্যেই এ বিনিয়োগ আসবে।
কিন্তু এখনও সে বিনিয়োগ আসেনি বলে টিবিএসকে নিশ্চিত করেছেন পদ্মা ব্যাংকের এমডি তারেক রিয়াজ খান।
তবে তিনি জানান যে, বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে স্বাক্ষরিত সমঝোতা স্মারক অনুযায়ী, ২০২৪ সালের মধ্যে ব্যাংকের জন্য বিদেশি উৎস থেকে ইক্যুইটি বিনিয়োগ আনতে হবে।
তারেক টিবিএসকে বলেন, 'বিদেশ থেকে ইক্যুইটি পাওয়ার জন্য আমরা ইতোমধ্যে বেশকিছু প্রেজেন্টেশন তুলে ধরেছি। সকল ক্ষেত্রেই আমরা বাংলাদেশের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিচ্ছি। আশা করছি, চলতি বছরের মধ্যেই আমরা সুখবর পাব'।
বর্তমান পরিস্থিতি কী?
ব্যাংকটির বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে তারেক রিয়াজ খান বলেন, ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাথে পদ্মা ব্যাংকের স্বাক্ষরিত এমওইউ'তে ২০২২-২০২৪ পর্যন্ত তিন বছর মেয়াদি বিভিন্ন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আমানত গ্রহণ, ঋণ বিতরণ, খেলাপি ঋণ আদায় ও কমিয়ে আনাসহ বিভিন্ন সূচকে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যাংক কাজ করছে।
'২০২২ সালের যে লক্ষ্যমাত্রা এমওইউতে রয়েছে, সেগুলো অর্জনে আমরা সফল হয়েছি। চলতি বছর ও আগামী বছর লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারলে, ২০২৫ সালে পদ্মা ব্যাংক ব্রেক ইভেনে পৌঁছাতে পারবে বলে আশা করছি'- জানান তিনি।
পদ্মা ব্যাংকের এমডি জানান, আপাতত তারা কোনো ঋণ প্রদানে যাচ্ছেন না।
'তবে ছোট আকারে কৃষি ঋণ এবং এসএমই ঋণ বিতরণ শুরুর পরিকল্পনা করছি। কৃষিখাতের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক যে পাঁচ হাজার কোটি টাকার পুনঃঅর্থায়ন স্কিম গঠন করেছে, পদ্মা ব্যাংক তা বিতরণে অংশ নিতে ইতোমধ্যে চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। ওই তহবিল থেকে ০.৫০% সুদহারে টাকা নিয়ে ৪% সুদহারে কৃষকদের ঋণ দেওয়া যাবে।
সংকটময় এক ইতিহাস
২০১৩ সালে প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে দুর্নীতিতে ডুবতে বসা সাবেক ফারমার্স ব্যাংককে (বর্তমানে পদ্মা ব্যাংক) বাঁচাতে ২০১৮ সালে ৭১৫ কোটি টাকার মূলধন যোগান দিয়ে পাশে দাঁড়িয়েছিল সরকারি চার ব্যাংক- সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান- ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ।
সাবঅর্ডিনেট বন্ড ও ফিক্সড ডিপোজিটসহ ব্যাংকটিতে অন্যান্য উপায়ে আরও এক হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো।
তবে খেলাপি ঋণ আদায় করতে না পারায় সরকারি বিনিয়োগের এই প্রবাহও ব্যাংকের মূলধন ক্ষয় রোধ করতে পারেনি।
২০২১ সালের সেপ্টেম্বরের শেষ নাগাদ ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি দাঁড়ায় ৫৪০ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, একইসময়ে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ছিল ৬২ শতাংশ।