ডলারের হাহাকারের মধ্যেই ১.৪২ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি আয় প্রত্যাবাসন মেয়াদোত্তীর্ণ
চলমান ডলার সংকটের কারণে আমদানিকারকরা রয়েছেন চাপে। কাঁচামাল আমদানি ও শিল্পোৎপাদন কমে যাওয়ায় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, শিল্প ও কর্মীরাও অনিশ্চিত ভবিষ্যত প্রত্যক্ষ করছে। অথচ গতবছরের ডিসেম্বর নাগাদ ১২০ দিনের নির্ধারিত মেয়াদ পেরোনোর পরও দেশে আসেনি ১.৪২ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি আয়।
পণ্য জাহাজীকরণ শেষে রপ্তানির নথিপত্র আমদানিকারকের ব্যাংকে পাঠানোর পরের দিন থেকে সর্বোচ্চ ১২০ দিনের মধ্যে মূল্য দেশে নিয়ে আসার বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
গত ২৯ জানুয়ারি বিভিন্ন ব্যাংককে মেয়াদোত্তীর্ণ রপ্তানি আয় (ওভারডিউ এক্সপোর্ট প্রসিড ) যত দ্রুত সম্ভব দেশে আনার উদ্যোগ নিতে নির্দেশনা দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে সার্বিক পরিস্থিতির প্রয়োজনীয়তা এবং গুরুত্ব তুলে ধরে দেশের অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করতে অতি-দরকারি এসব বৈদেশিক মুদ্রা দেশে আনার বিষয়ে তাগিদ দেওয়া হয়।
এছাড়া, ডিসেম্বরের শেষপর্যন্ত মেয়াদোত্তীর্ণ হয়নি (নন-ওভারডিউ) এমন প্রায় ২৩০ কোটি ডলার রপ্তানি আয়ও দ্রুত দেশে আনার ব্যবস্থা নিতে ব্যাংকগুলোকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক আগামী ১২ ফেব্রুয়ারির মধ্যে মেয়াদোত্তীর্ণ রপ্তানি আয়ের পরিমাণ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য দিতেও বলেছে।
রপ্তানি আয় মেয়োদোত্তীর্ণ হওয়ার অর্থ হলো– বিদেশে রপ্তানি হওয়া পণ্য বা সেবার মূল্য যেসময়ের মধ্যে পাওয়ার কথা ছিল– তা পাওয়া যায়নি। ব্যবসা পরিচালনার জন্য এ আয়ের ওপর নির্ভর করায় এতে আর্থিক সমস্যায় পড়তে পারেন রপ্তানিকারক। মেয়াদোত্তীর্ণ রপ্তানি আয় রপ্তানিকারকের সুনামহানিও করতে পারে, এতে ভবিষ্যতে তাদের ব্যবসায়িক চুক্তি সম্পাদনের সক্ষমতাও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, গত ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ওভারডিউ ১.৪২ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে প্রায় ২৭৬ মিলিয়ন ডলার শর্ট শিপমেন্টের (রপ্তানি পণ্যে ঘাটতি) অভিযোগে আটকে আছে। আমদানিকারক দেউলিয়া হওয়ার কারণে আটকে গেছে ৭৫ মিলিয়ন ডলার; আইনগত জটিলতায় আটকে আছে ২৫২ মিলিয়ন ডলার। এছাড়া, ১২২ মিলিয়ন ডলার বিবিধ কারণে আটকে আছে। আর ৭০০ মিলিয়ন ডলারের সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ নেই।
দেশের বর্তমান বৈদেশিক মুদ্রা সরবরাহ পরিস্থিতি সম্পর্কে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থবিভাগকে পাঠানো এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
আব্দুর রউফ তালুকদার বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে দায়িত্বগ্রহণের পর, দেশের বৈদেশিক মুদ্রা প্রবাহ বাড়াতে গত জুলাইয়ের এক বৈঠকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে মেয়াদোত্তীর্ণ রপ্তানি আয় আনার নির্দেশ দেন। জানুয়ারির শেষে বিভিন্ন ব্যাংকের চেয়ারম্যানদের সাথে এক বৈঠকেও একই নির্দেশনা দেন তিনি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, গত বছরে জুনের শেষপর্যন্ত মেয়াদোত্তীর্ণ রপ্তানি আয়ের পরিমাণ ছিল ১.২৮ বিলিয়ন ডলার, যার অর্থ দাঁড়াচ্ছে ছয় মাসে ১৪০ মিলিয়ন ডলারের বেশি রপ্তানি আয় মেয়াদোত্তীর্ণ হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কয়েকজন কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন যে, বৈদেশিক মুদ্রার (বিশেষত মার্কিন ডলারের) উচ্চ বিনিময় দরের সুবিধা নিতে ইচ্ছে করেই আয় প্রত্যাবাসনে দেরি করছেন রপ্তানিকারকরা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক আরও লক্ষ করেছে যে, অধিকাংশ রপ্তানিকারক নির্ধারিত ১২০ দিনের একদম শেষে এসে আয় প্রত্যাবাসন করছেন।
বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের ৮০ ভাগের বেশি আসে তৈরি পোশাক খাত থেকে। তৈরি পোশাকের মধ্যে নিট পোশাকের রপ্তানি বেশি। এই অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে, বাংলাদেশের নিট পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারকদের সমিতি (বিকেএমইএ)-র নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম টিবিএস'কে বলেন, 'এই অভিযোগ অমূলক ও মনগড়া। প্রত্যেক ব্যবসায়ী টাকার জন্য হাহাকার করছেন, এমন পরিস্থিতিতে বিনিময় হারে সামান্য বেশি পাওয়ার জন্য কেউ বিদেশে টাকা ফেলে রাখবে না'।
মোহাম্মদ হাতেম আরও বলেন, 'এক্সপোর্ট প্রসিড দেরি করে আনার সুযোগ ব্যবসায়ীদের নেই। রপ্তানিকারকরা যত দ্রুত সম্ভব দেশে তাদের আয় আনার সব ধরনের চেষ্টা করে যাচ্ছেন'।
বিকেএমইএ সভাপতি বলেন, আসলে যা হচ্ছে তা হলো- বৈশ্বিক সংকটের কারণে ক্রেতারা সময়মত বিল পরিশোধ করছেন না বা করতে পারছেন না। যেসব বিল রপ্তানির নথিপত্র দেওয়ার সাথে সাথে পরিশোধ করার কথা অর্থাৎ অন সাইট পেমেন্ট, সেগুলো পরিশোধেও ৩-৪ মাস বা তার বেশি সময় নিচ্ছে।
'এক্সপোর্ট প্রসিড দেশে আসতে দেরি হচ্ছে প্রধানত বিদেশি আমদানিকারকদের জন্য, স্থানীয় রপ্তানিকারকদের জন্য নয়। কিছু বিদেশি ক্রেতা ইচ্ছে করে দেরিতে অর্থ পরিশোধ করছে। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের ক্রেতাদের মধ্যে এমন মনোভাব দেখা যাচ্ছে' - যোগ করেন তিনি।
এদিকে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে রপ্তানি আয় দেশে না আনা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এর ফলে ওই রপ্তনিকারককে রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল (ইডিএফ) থেকে অর্থায়ন করা হয় না। নগদ প্রণোদনা দেওয়া হয় না। পরবর্তী এলসি খোলার সময় মার্জিন সুবিধাও বন্ধ করা হয়ে থাকে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক টিবিএস'কে বলেন, 'যৌক্তিক ব্যবসায়িক কোনো কারণে এক্সপোর্ট প্রসিড দেশে আসতে দেরি হলে, রপ্তানিকারকরা বাংলাদেশ ব্যাংকে আবেদন করতে পারেন। বাংলাদেশ ব্যাংক সেটি বিবেচনায় নেয় এবং দেশে আনার জন্য বাড়তি সময়ও দেয়। কিন্তু প্রকৃত বা যৌক্তিক কারণ ছাড়া সময়মত এক্সপোর্ট প্রসিড দেশে না আনার সুযোগ নেই'।
তিনি বলেন, 'বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো রপ্তানিকারকদের ব্যাক টু ব্যাক এলসি সুবিধা দেয়, যাতে তারা রপ্তানি পণ্য উৎপাদনের কাঁচামাল কিনতে পারেন। এতে বৈদেশিক মুদ্রা চলে যায়। এজন্য রপ্তানি বাবদ প্রাপ্য বৈদেশিক মুদ্রা সময়মত দেশে আসা জরুরি। তা নাহলে বৈদেশিক মুদ্রার ইনফ্লো ও আউট ফ্লোতে ভারসাম্যহীনতা দেখা দেয়'।
মেজবাউল হক বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক চাচ্ছে সাইট এলসির (পণ্য বা সেবার মূল্য পরিশোধের নথি ) বিপরীতে রপ্তানি করা পণ্যের মূল্য আমদানিকারকের ব্যাংকে নথিপত্র দাখিলের পরপরই যাতে দেশে আসে। এই পেমেন্ট খুবই দরকারি, কারণ বাংলাদেশ সবসময়ই বাণিজ্য ঘাটতিতে থাকা দেশ। ঘাটতির অংশ প্রবাসী আয়, বৈদেশিক ঋণ ও সহায়তা, সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগের মাধ্যমে আসা বৈদেশিক মুদ্রা দিয়ে মেটানো হয়ে থাকে।
গত কয়েক মাস ধরে দেশে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হারে অস্থিরতা চলছে। গত ৬ মাসে ডলারের বিপরীতে টাকার মান ২০ শতাংশের বেশি কমেছে। ডলার সংকটে পড়ে অনেক ব্যাংক এলসি খুলতে পারছে না।
বাংলাদেশ ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ থেকে ব্যাংকগুলোকে ডলার সরবরাহ করছে। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের এপর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংক ৯ বিলিয়নের বেশি ডলার ব্যাংকগুলোর কাছে বিক্রি করেছে। এরপরও ডলারের সংকট দূর হয়নি।
বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা) গত সেপ্টেম্বর থেকে একাধিকবার বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার পরিবর্তন করেছে। বাফেদার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, বর্তমানে রপ্তানিকারকদের প্রতি ডলারে ১০৩ টাকা দর দিচ্ছে ব্যাংকগুলো। পাশাপাশি যেসব রপ্তানিকারক গত নভেম্বর ও ডিসেম্বরের রপ্তানি হওয়া পণ্যের মূল্য আগামী ১৫ ফেব্রুয়ারির মধ্যে দেশে আনবেন তাদেরকে ডলার প্রতি আরও ৫০ পয়সা অতিরিক্ত দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাফেদা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা মনে করছেন, পরিস্থিতির সুযোগ নিতে ব্যবসায়ীরা নিজেদের সুবিধা অনুযায়ী রপ্তানি আয় দেশে আনছেন। ব্যাংকগুলো নতুন এলসি খুলতে অনাগ্রহী হওয়ায়– যখন নিজের আমদানি দায় মেটাতে হচ্ছে অথবা বেশি দাম পাওয়া যাচ্ছে তখনই তারা রপ্তানি আয় আনছেন।
জানতে চাইলে ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহী ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) প্রেসিডেন্ট ও ব্র্যাক ব্যাংকের এমডি ও সিইও সেলিম আর. এফ. রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, পণ্যের মূল্য কখন পরিশোধ করা হবে- সে বিষয়ে রপ্তানিকারক ও আমদানিকারকের মধ্যে সাধারণত চুক্তি থাকে। 'চাইলেই চুক্তির আগে এক্সপোর্ট প্রসিড আনা যায় না। তবে কিছু ক্ষেত্রে সুযোগ আছে। বড় রপ্তানিকারকদের কারোর কারোর ক্ষেত্রে সেটা সম্ভব। এটা যাতে তারা দ্রুত আনেন সেজন্য বাড়তি বিনিময় হার দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে'।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক বলেছেন, যে পরিমাণ এক্সপোর্ট প্রসিড ওভারডিউ আছে তা দীর্ঘদিনের। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত যে ১.৪২ বিলিয়ন ডলারের মেয়াদোত্তীর্ণ আছে সেগুলো ২০১২ সাল থেকে পর্যন্ত সৃষ্টি হয়েছে। এই সময়ে দেশ থেকে ৩৭৬ বিলিয়ন ডলারের পণ্য ও সেবা রপ্তানি হয়েছে। ফলে মোট রপ্তানির তুলনায় ওভারডিউ এর পরিমাণ খুবই সামান্য। তারপরও কোনো অর্থই যাতে বিদেশে আটকে না থাকে সেজন্য চেষ্টা চলছে'।