গম আমদানি নিয়ে আপাতত স্বস্তি, তবে খরা ও তাপপ্রবাহে ভবিষ্যৎ শঙ্কায়
ইউক্রেনের শস্য রপ্তানি চুক্তির মেয়াদ আরো ৬০ দিন বৃদ্ধির ঘটনা বাংলাদেশের মতোন নেট খাদ্য আমদানিকারক দেশের জন্য স্বস্তিদায়ক হয়েছে। কারণ প্রতিকূল আবহাওয়ার প্রকোপে দ্বিতীয় প্রধান খাদ্যশস্যটির বৈশ্বিক উৎপাদন হ্রাস পেতে পারে এমন উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। সেজন্য এখনই নিরাপদ মজুত গড়ে তোলার লক্ষ্য রয়েছে বাংলাদেশের।
কৃষ্ণসাগর দিয়ে রপ্তানি চুক্তির মেয়াদ বৃদ্ধির সুযোগ পূর্ণ সদ্ব্যবহারের প্রস্তুতি নিচ্ছেন আমদানিকারকরা। যেহেতু, করোনা মহামারি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ২০২০ সাল থেকে বাংলাদেশের গম ক্রয় প্রায় একতৃতীয়াংশ কমে গেছে।
তবে উদ্বেগ লাঘব হওয়া মানেই তা পুরোপুরি দূর হয়েছে এমনটা নয়।
এই মওসুমের জন্য ভারতে তাপপ্রবাহের পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। দীর্ঘসময় ধরে খরা প্রবণতা অব্যাহত থাকায় – চীন, ব্রাজিল ও যুক্তরাষ্ট্রে – বড় আঘাত আসতে পারে গম উৎপাদনে।
এর অর্থ দাঁড়াচ্ছে, বৃহৎ গম উৎপাদক দেশগুলোই হয়ে উঠতে পারে শস্যটির বড় আমদানিকারক, এতে বিশ্ববাজারের জোগান ও দামের ওপর আরো চাপ সৃষ্টি হবে।
এদিকে খরার কারণে আর্জেন্টিনার কর্তৃপক্ষ আশঙ্কা করছেন, চলতি বছর সয়াবিন উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে না। ইন্দোনেশিয়াও সীমিত পরিসরে পাম তেল রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। ফলে ভোজ্যতেল নিয়েও একই ধরনের শঙ্কা করা হচ্ছে।
অনিশ্চিত বৈশ্বিক জোগানকে মাথায় রেখে ভোজ্যতেল পরিশোধকরা এরমধ্যেই দাম আরো বাড়ানোর ইঙ্গিত দিয়েছে।
তবে সবটাই নিরাশার চিত্র নয়।
ব্রাজিলের পর বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহৎ সয়াবিন তেলের উৎস- আর্জেন্টিনায় সরকারি কর্মকর্তাদের সাম্প্রতিক এক সফরে তারা দেশটির থেকে সরবরাহের প্রতিশ্রুতি আদায় করতে পেরেছেন। এতে আশার এক ক্ষীণ আলোক রেখা দেখা যাচ্ছে।
অন্যদিকে, বেসরকারি খাতের গম আমদানি কমলেও, চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে সরকারি উদ্যোগের অধীনে ক্রয় উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে ৬ লাখ টনের বেশি হয়েছে। ২০২১-২২ অর্থবছরের পুরো সময়ে যা ছিল ৫.৪ লাখ টন।
সরকারের কাছে চালের মজুতও – যা দেশে প্রধান খাদ্য – ১৫ লাখ টনের বেশি। সবচেয়ে বেশি ফলনের মওসুম বোরোতে ধানের সর্ববৃহৎ আবাদও ভালো সম্ভাবনা দেখাচ্ছে। তাই চাল নিয়ে স্বস্তি রয়েছে খাদ্য কর্মকর্তাদের মধ্যে।
কৃষ্ণসাগর শস্য রপ্তানি চুক্তির মেয়াদ বৃদ্ধিতে স্বস্তি
গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়ার সাথে যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই অবরোধের মধ্যে পড়ে ইউক্রেনের বন্দরগুলো। ফলে বিশ্বের অন্যতম এক খাদ্যঝুড়ি থেকে সরবরাহ ব্যাহত হয়।
বাংলাদেশের খাদ্যশস্য আমদানির একটি সহজ উৎস হলো ভারত। কিন্তু, দাবদাহে ফসলের ক্ষতি হয়েছে এমন আভাসের পর এবং স্থানীয় বাজারে দাম বাড়ায় – গত বছরের বছরের মে মাসে দেশটির সরকার গম রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা দেয়।
ফলে ২০১৯-২০ অর্থবছরের ৬৩ লাখ টনের তুলনায় ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশের গম আমদানি ৪০ লাখ টনে নেমে আসে। গত বছরের জুলাই থেকে গত ১৩ মার্চ পর্যন্ত মোট গম আমদানি হয়েছে ২১.৫ লাখ টন, এই অবস্থায় আগামী ১৮ মার্চ কৃষ্ণসাগর চুক্তির মেয়াদ পূর্ণ হতে চলায় বড় শঙ্কা দেখা দেয়।
তবে চুক্তির মেয়াদ আরো দুই মাস বাড়ানোর ফলে আমদানিকারকরা আশা করছেন যে, ইউক্রেন থেকে বিশ্ববাজারে সরবরাহ অব্যাহত থাকবে। গত বছরের জুলাইয়ে চুক্তি স্বাক্ষরের পর থেকে দেশটি ২.৪ কোটি টনের বেশি গম রপ্তানি করেছে, আমদানিকারকদের মধ্যে বাংলাদেশও আছে।
গম আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান বিএসএম গ্রুপের চেয়ারম্যান আবুল বশর চৌধুরী দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেনের শস্য চুক্তির মেয়াদ বৃদ্ধিতে বাংলাদেশের ভোক্তারা উপকৃত হবে। বিশেষ করে, চুক্তির মেয়াদ বৃদ্ধির অনিশ্চয়তায় আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বৃদ্ধির যে প্রবণতা ছিল, তা কমে আসবে। তবে চুক্তির অধীনে শস্যবাহী জাহাজ পরিদর্শনের সময় কমলে পণ্যের দাম আরো কমে আসবে বলে মন্তব্য করেন এই আমদানিকারক।
কৃষ্ণসাগরের বন্দরগুলোয় প্রবেশ ও বন্দর ত্যাগের সময় জাহাজগুলো পরিদর্শনে অত্যধিক দেরি এবং চলমান ডলার সংকট – চুক্তির মেয়াদ বৃদ্ধির সুফলকে সীমিত করতে পারে বলে মনে করছেন অন্যান্য শস্য আমদানিকারকরা।
মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান মোস্তফা কামাল জানান, তিনি গত বছরের ডিসেম্বরে গম আমদানির একটি ঋণপত্র খোলেন, কিন্তু শস্যবাহী জাহাজ এখনও বাংলাদেশে পৌঁছায়নি।
কামালের মতে, কৃষ্ণসাগরে তুরস্ক, রাশিয়া ও ইউক্রেনের ত্রিপক্ষীয় জাহাজ পরিদর্শন প্রক্রিয়ার ফলেই এই বিলম্ব হচ্ছে।
তিনি জানান, বর্তমানে তিনি ইউক্রেনের বদলে রাশিয়া, ব্রাজিল ও রোমানিয়া থেকে গম আমদানি করছেন।
অন্যদিকে, প্রধানত ইউক্রেন থেকে গম আমদানিকারী বসুন্ধরা গ্রুপ পড়েছে ভিন্ন এক সমস্যায়।
নাম না প্রকাশের শর্তে গ্রুপের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বলেন, আমদানির এলসি খোলার জন্য তারা দরকারি ডলার সংগ্রহ করতে পারছেন না, ফলে তাদের কারখানাগুলো সক্ষমতার নিচে পরিচালিত হচ্ছে।
সরকারি কর্মকর্তারা অবশ্য বলছেন, আনুষ্ঠানিক উৎস থেকে নিত্যপণ্য সহজলভ্য।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব (বৈদেশিক সংগ্রহ) মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান টিবিএসকে বলেন, 'আমরা ভারত, রাশিয়া থেকে চুক্তি অনুযায়ী গম আমদানি করছি। আমাদের মজুতও বেশ শক্ত অবস্থানে রয়েছে। এই চুক্তিগুলো আমরা সংকটের মধ্যেই করেছিলাম। আমরা বিভিন্ন সোর্স থেকে গম আমদানির জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি'।
খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, দেশে গমের চাহিদা রয়েছে ৭০-৭৫ লাখ টন। দেশে গমের উৎপাদন ১০ লাখ টনের কিছু বেশি। বাকিটা আমদানি করা হয়।
সরকার আমদানির জন্য বিভিন্ন উৎসের দিকে উদ্যোগী হলেও, এলসি খোলা নিয়ে উদ্বেগ এখনও রয়েই গেছে।
টিকে গ্রুপের পরিচালক (অর্থায়ন ও পরিচালন) মো. শফিউল আতহার তসলিম বলেন, 'এখন যে বিষয়ে উদ্বেগ রয়েছে তা হলো এলসির পেমেন্ট সময়মত করা যাচ্ছে না। এতে করে আমাদের সোর্সের সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, আমাদের ওপর আস্থাহীনতা তৈরি হচ্ছে'।
খাদ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, চলতি অর্থবছরের আট মাসে সরকারি, বেসরকারি খাত মিলিয়ে প্রায় ২১.৪৬ লাখ টন গম আমদানি হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের আমদানির তথ্য বলছে ২০২১-২২ অর্থবছরে মোট গম আমদানি ৬২.৩ শতাংশ হয়েছিল ভারত থেকেই। এর বাইরে কানাডা থেকে ১৩.৩ শতাংশ, ইউক্রেন থেকে ৮.৭ শতাংশ এবং অষ্ট্রেলিয়া থেকে ৭.৬ শতাংশ আমদানি হয়।
তবে ইউক্রেন, রাশিয়া ও ভারতের তুলনায় অস্ট্রেলিয়া ও কানাডার গমের দাম বেশি।
বিশেষজ্ঞদের মধ্যে ভীতি রয়েছে যে, চীন ও আমেরিকার (যুক্তরাষ্ট্র) মতো উন্নত দেশ বিশ্ববাজার থেকে অতিরিক্ত গম কিনতে বাধ্য হলে দেশের গম আমদানির ক্ষেত্রে সংকট তৈরি হবে।
সয়াবিন নিয়ে উদ্বেগ দূর হয়নি
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর ভোজ্য তেলের দাম বাড়তে থাকে।
এই পরিস্থিতিতে, আর্জেন্টিনা – সয়াবিন তেলের তৃতীয় বৃহত্তম উৎপাদক – নিজস্ব খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গত বছরের মার্চ মাসে রপ্তানির উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। পাম তেলের বৃহত্তম রপ্তানিকারক ইন্দোনেশিয়াও রপ্তানি কমায়।
উভয় দেশ দুই মাসের মধ্যে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিলেও, ইতোমধ্যেই তার প্রভাব পড়ে সরবরাহ চক্রে। অবশ্য, নিষেধাজ্ঞা উঠে গেলে সরবরাহ স্বাভাবিক হতে এবং দাম কমতে শুরু করে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, এক বছরের ব্যবধানে বিশ্ববাজারে অপরিশোধিত সয়াবিন তেলের দাম ১৫ শতাংশ কমেছে। কিন্তু, ডলার সংকটের কারণে এই সুবিধা নেওয়া যায়নি।
প্রচন্ড খরার কারণে এ বছর আর্জেন্টিনায় সয়াবিনের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় অনেক কমে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। প্রধান রপ্তানিকারক দেশটির উৎপাদন কমে গেলে বৈশ্বিক সরবরাহ কমে যাবে এবং দামও বেড়ে যাওয়ার শঙ্কা প্রকাশ করেছেন স্থানীয় আমদানিকারকরা।
সয়াবিন তেল পরিশোধন করে বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠান টিকে গ্রুপের পরিচালক (অর্থায়ন ও পরিচালন) মো. শফিউল আতহার তসলিম বলেন, 'আর্জেন্টিনায় যদি উৎপাদন কম হয়, তাহলে গ্লোবাল সরবরাহ চেইনে একটা ঘাটতি হবে। তখন হয়তো দাম বাড়তে পারে'।
এই পরিস্থিতিতে টিসিবির (ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ) জন্য সরকারি পর্যায়ে তেল আমদানির করতে সম্প্রতি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব, টিসিবির চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ ট্রেড এন্ড ট্যারিফ কমিশনের কর্মকর্তাসহ একটি টিম আর্জেন্টিনা সফর করে।
টিসিবির চেয়ারম্যান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আরিফুল হাসান জানান, আর্জেন্টিনা থেকে ফেরার পর দুটি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান আমাদের সয়াবিন তেল সরবরাহের জন্য লিখিত প্রস্তাবনা দিয়েছে। এর বাইরে আরও একটি প্রতিষ্ঠান আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছে, যারা আর্জেন্টিনা থেকে তেল সরবরাহ করবে বলে জানিয়েছে।
তিনি বলেন, সরকারি কেনাকাটা একটু সময়সাপেক্ষ, চুক্তির বিষয়গুলোতেও আলোচনার অনেক বিষয় থাকে। 'তবে আমরা চাচ্ছি কীভাবে দ্রুত চুক্তি করা যায়। আমরাও চাই এমন একটা চুক্তি করতে, যেখানে আন্তর্জাতিক বাজারে যখন দাম কমবে- আমরাও যেন সেই সুযোগটা নিতে পারি'।
টিসিবির তথ্য বলছে, গত বছরের একই সময়ের চেয়ে বর্তমানে বাজারে ৯ শতাংশ বেশি দামে সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুসারে, ২০২১-২২ অর্থবছরে আর্জেন্টিনা থেকে ৪৮.২ শতাংশ অপরিশোধিত সয়াবিন তেল আমদানি হয়েছে। দ্বিতীয় স্থানে থাকা ব্রাজিল থেকে আমদানি হয়েছে ৩২.৪ শতাংশ। এর বাইরে প্যারাগুয়ে থেকে ১৪.২ শতাংশ আমদানি হয়েছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, দেশে ভোজ্যতেলের বার্ষিক চাহিদা প্রায় ২০ লাখ টন। এর মধ্যে সয়াবীন বীজের আমদানি হয় প্রায় ২৪ লাখ টন; যেখান থেকে ৪ লাখ টন তেল উৎপাদিত হয়।
আর পরিশোধিত সয়াবিন তেলের আমদানি ৫ লাখ টন। এর বাইরে অপরিশোধিত পাম তেলের আমদানি হয় ১১ লাখ টন। এই বাইরে দুই লাখ টনের মত সরিষাসহ অন্যান্য ভোজ্য তেল দেশেই উৎপাদন হচ্ছে।