গার্মেন্টস মালিকরা কারখানা ইজারা দিতে মরিয়া কেন
প্রতিকূল অর্থনৈতিক আবহ এবং চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্যে – জ্বালানি ও বিদ্যুতের উচ্চ মূল্য, ব্যাংকের কাছে দেনা বৃদ্ধি, রপ্তানি কার্যাদেশ কমে আসার মতো ঘটনায় – টিকে থাকাই কঠিন হয়ে উঠেছে পোশাক ও টেক্সটাইল শিল্পের কারখানাগুলোর। আসন্ন লোকসানের মুখে ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে, বিকল্প একটি উপায়: কারখানা ইজারা দেওয়ার চেষ্টা করছেন কারখানা মালিকরা।
শিল্পের অভ্যন্তরীণরা বলছেন, এই কৌশলগত পদক্ষেপের লক্ষ্য পশ্চিমা দেশগুলোর বাজারে পড়তি চাহিদার প্রতিকূল প্রভাব হ্রাস। কিন্তু, খুব কম সংখ্যক ব্যবসায়ী-ই কারখানা ক্রয় বা ইজারা নেওয়ার আগ্রহ দেখাচ্ছে, এতে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন মালিকেরা।
যেমন বলা যায়, মাহফুজুর রহমানের মালিকানাধীন রোজ গার্ডেনের কথা। অ্যাকর্ড অনুমোদিত ৬ প্রোডাকশন লাইনের এই মিডিয়াম লাইট উভেন পোশাক কারখানাটি অবস্থিত সাভারের বিরুলিয়া সড়কে। গত আট মাস ধরে কারখানাটি বিক্রির চেষ্টা করছেন মাহফুজ। বিক্রয়মূল্য ২৫ শতাংশ কমিয়ে ৩ কোটি টাকার করার পরও এপর্যন্ত কোনও ক্রেতা পাননি তিনি।
করোনা মহামারি থেকে যখন দেশের দ্রুত অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার শুরু হয়, তখন বিপুল রপ্তানি কার্যাদেশ আসছিল বাংলাদেশে। মাত্র বছর দুই আগের সে সময়েই নারায়ণগঞ্জে ১২ তলা একটি কারখানা চালু করা হয়। বর্তমানে আরও লোকসান এড়াতে এই কারখানাটির মালিকও ইজারা দেওয়ার মরিয়া চেষ্টা করছেন।
এমনকী কিছু কারখানার মালিক জাতীয় দৈনিকে বিক্রি বা ইজারার বিজ্ঞাপন দিচ্ছেন। যেমন গত মে মাসে গাজীপুরের মৌচাকের ভান্নারায় অবস্থিত ৬৩,১২০ স্পিন্ডল-বিশিষ্ট একটি স্পিনিং মিল মাসিক ৩.১০ কোটি টাকা ভাড়ায় দেওয়ার বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়। তবে এখনও এটি ইজারা দেওয়া যায়নি।
এসব ঘটনা পোশাক ও টেক্সটাইল খাতের কয়েক ডজন কারখানার মধ্যে হাতেগোণা কয়েকটির উদাহরণ – প্রতিকূল সময়ে ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে যাদের মালিকেরা এগুলো বিক্রি বা ইজারা দিতে চাইছেন। এমনকী কিছুক্ষেত্রে মালিকপক্ষ কারখানা বন্ধ করে শ্রমিক ছাঁটাইয়ে বাধ্য হচ্ছে।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায় ডার্ড গ্রুপের ঘটনাই। পোশাক, টেক্সটাইল, প্রকৌশল, সফটওয়্যার ও কৃষি খাতের বিভিন্ন কোম্পানি রয়েছে এই শিল্পগোষ্ঠীর অধীনে। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে তারা তিনটি কারখানা বন্ধ করেছে। বেশিরভাগ বন্ধের ঘটনাই ঘটেছে ঈদুল আজহার দিন কয়েক আগে, এতে ছাঁটাই হয়েছে ৮ হাজার শ্রমিক।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মালিকেরা কত সংখ্যক কারখানা বিক্রি বা ইজারায় দেওয়ার চেষ্টা করছেন – সে সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্য জানা নেই তাদের। তবে ইদানীং প্রায়ই তাদের এ প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হচ্ছে।
প্লামি ফ্যাশনস এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং নিট পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিকেএমইএ)-র সাবেক সভাপতি ফজলুল হক বলেন, "অনেক কারখানা মালিক তাদের স্থাপনা বিক্রি বা ভাড়ায় দিতে চাচ্ছেন, কিন্তু ক্রেতা পাওয়া যাচ্ছে না। কারণ, ছোট হোক বা মাঝারি- সব উৎপাদক ও রপ্তানিকারক এখন টিকে থাকার চেষ্টা করছে।"
আগের বছরে ৪,৫০০টি থাকলেও, উভেন ও নিট পোশাক খাতের সক্রিয় কারখানার সংখ্যা কমে প্রায় ২,০০০ হাজারে নেমে এসেছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
চলমান বিভিন্ন প্রতিকূলতা অন্যান্য অন্যান্য কারখানার চেয়ে ভালোভাবে সামলাতে পেরেছেন প্যাসিফিক জিন্স গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ এম তানভির। এখন কারখানা বিক্রি বা ইজারা দিতে ইচ্ছুক অন্য মালিকেরা তার সাথে যোগাযোগ করছেন বলে জানান তিনি।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে তানভির বলেন, "কারখানা ভাড়া দেওয়া সাধারণত তা বন্ধেরই প্রথম পদক্ষেপ। এমনকী রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলে অবস্থিত কারখানাগুলোও প্রোডাকশন লাইন কমাচ্ছে, আর কর্মী ছাঁটাই করছে। এটা খুবই আশঙ্কাজনক পরিস্থিতি।"
বিকেএমইএ'র নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম জানান, শুধু ছোট কারখানাগুলোই নয়, বরং আগে ভালো ব্যবসা করা কিছু বড় ফ্যাক্টরিও ইজারার চেষ্টা করছে।
এবিষয়ে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ)'র সহ-সভাপতি শহীদুল্লাহ আজিম উল্লেখ করেন যে, অর্ডারের সংখ্যা কমে যাওয়ার তীব্র নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে পোশাক শিল্পে। এতে গত কয়েক মাস ধরে কর্মসংস্থান সৃষ্টি বন্ধ রয়েছে।
দীর্ঘ সময় ধরে বিশ্ববাজারে মন্দাভাব অব্যাহত থাকায়, ব্যবসার সার্বিক পরিস্থিতি যে অনুকূল নয়- তা স্বীকার করেছেন বিজিএমইএ'র সভাপতি ফারুক হাসান।
তবে তার মতে, কারখানার ব্যবস্থাপকরা যখন ব্যর্থ হন, তখন কোনো ইউনিট বিক্রি বা ইজারায় দেওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু, ব্যাংক ঋণ বেশিরভাগ সময়েই বিক্রির ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
কেন এই পরিস্থিতি
রপ্তানিকারকদের মতে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে ক্রমবর্ধবান ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা ও পশ্চিমা দেশগুলোয় উচ্চ মূল্যস্ফীতি – রপ্তানি কার্যাদেশ কমার অন্যতম প্রধান কারণ।
২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রধান কয়েকটি বাজারে পোশাক রপ্তানিতে পতন দেখা যায়। উদাহরণস্বরূপ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় বাজার। কিন্তু, বিজিএমইএ'র তথ্যানুসারে, সদ্য সমাপ্ত অর্থবছরের জুলাই-মে সময়ের মধ্যে, সেদেশে রপ্তানি বছরে ৫ শতাংশের বেশি কমে ৭.৭ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে।
একই সময়ে, দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বাজার- জার্মানিতে পোশাক রপ্তানি ৭.২২ শতাংশ ও রাশিয়ায় ২৯ শতাংশ কমেছে।
চলতি বছরের শুরুর দিকে সরকার গ্যাসের মূল্য বাড়ানোর ফলে উদ্যোক্তাদের দুর্দশা আরও তীব্র হয়েছে। শিল্প ও কারখানার আকার ভেদে – ৮৮ থেকে ১৭৯ শতাংশ পর্যন্ত গ্যাসের মূল্য আকস্মিকভাবে বাড়ানোয় – বাড়তি চাপের মধ্যে পড়েছেন উদ্যোক্তারা। অনেকেই এই খাতে আর ব্যবসা না করার কথাও ভাবছেন।
যেমন গ্যাস বিল দিতে না পারায় নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও উপজেলায় অবস্থিত উ-সান নিট কম্পোজিট মিল সম্প্রতি বন্ধ হয়ে গেছে। বিকেএমইএ'র নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ব্যাংকের কাছে দেনা বাড়তে থাকায়, আগ্রহী ক্রেতারাও পরে আর মিলটি কিনতে রাজি হয়নি।
বিজিএমইএ'র শহীদুল্লাহ আজিম বলেন, পোশাক উৎপাদনের গড় খরচ বেড়ে গেছে। এরমধ্যে গ্যাস ও বিদ্যুত-সহ নানান পরিষেবার মূল্য বৃদ্ধি উদ্যোক্তাদের ব্যবসা বন্ধ করতে বাধ্য করছে। এছাড়া, জ্বালানি সংকট তো রয়েছেই। এসব মিলিয়ে, আমাদের সময়মতো রপ্তানি চালান পৌঁছানোও ব্যাহত হচ্ছে। বিকল্প উপায় হিসেবে অনেক রপ্তানিকারক বিমানে করে চালান পাঠাতে বাধ্য হচ্ছেন।
রপ্তানিকারক ও উৎপাদকদের এসব প্রতিকূলতার সুযোগ নিয়ে বায়াররাও মূল্যছাড় আদায়ের জন্য চাপ দিচ্ছে বলেও জানান তিনি।
ইজারা বা ক্রয়ে আগ্রহ নেই কেন
শিল্প-সংশ্লষ্টদের মতে, গার্মেন্টস ও টেক্সটাইল কারখানা বিক্রির প্রচেষ্টায় প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে তাদের উল্লেখযোগ্য পরিমাণ দেনা, যা বিশেষত রয়েছে বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে। এতে সম্ভাব্য ক্রেতারা হয় আগ্রহ হারাচ্ছেন নাহলে ন্যূনতম আগ্রহই দেখাচ্ছে।
এমনকী চীনা ক্রেতারাও প্রথমে আগ্রহ দেখালেও পরবর্তীতে উচ্চ দেনার বিষয়টি বিবেচনা করে সরে যান।
মোহাম্মদ হাতেম টিবিএসকে জানান, গ্যাস-সংযোগ থাকায় শুরুতে নারায়ণগঞ্জের উ-সান নিট কম্পোজিট মিল কেনার আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন তিনি। কিন্তু, আরও অনুসন্ধানের পর আবিষ্কার করেন যে, মিলটির প্রায় ১২৬ কোটি টাকা দায় রয়েছে ব্যাংকের কাছে। যা মিলটির ৪৫ কোটি টাকা মূল্যায়নের চেয়েও অনেক বেশি। ফলে তিনি আর মিলটি না কেনারই সিদ্ধান্ত নেন।
উদ্যোক্তাদের সম্পদের মূল্যের চেয়ে ব্যাংকের কাছে থাকা দেনা যখন বেশি হয়, তখনই জটিলতা দেখা দেয় বলে জানান বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান।
তিনি বলেন, এখনকার মতো প্রতিকূল সময়ে, সাধারণত ব্যাংকগুলো লোকসানের একটা অংশ শেয়ার কর কারখানা মালিকদের বিক্রির একটা সুযোগ করে দেয়। কিন্তু, (রপ্তানি) বাজারেই যখন মন্দাভাব, তখন এ ধরনের কারখানায় বিনিয়োগের ঝুঁকি নিতে চান না সম্ভাব্য বিনিয়োগকারীরা।
এ সব জটিলতা নিরসনে বাংলাদেশে কোনো 'এক্সিট পলিসি' নেই। সরকার একটি 'এক্সিট পলিসি' বাস্তবায়ন করলে, তা উদ্যোক্তাদের চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় সহায়ক হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।