নষ্ট ডিমের হেঁয়ালি: শূন্য রসুই, ক্ষুধার্ত পেট ও পাল্টাপাল্টি দোষারোপের পালা
বাজারে ডিমের দাম ক্রমে বাড়তে থাকায়, সর্বোচ্চ মূল্যসীমা বেধে দেওয়ার পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। একটি পচা ডিমের মতই নিত্যপণ্যের বাজারের বেহাল দশা তুলে ধরে এ ঘটনা।
আজ রোববার (১৩ আগস্ট) এক সভা শেষে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ-মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম বলেছেন, প্রতিটি ডিমের দাম ১২ টাকার বেশি হওয়া উচিত না। অথচ বাজারে এখন ১৪-১৫ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
এই পার্থক্য উল্লেখ করে রেজাউল করিম বলেন, প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের সার্ভে অনুযায়ী, একটি ডিমের উৎপাদন খরচ সাড়ে ১০ টাকা হিসাব করা হয়েছে, তাই খুচরা পর্যায়ে ১২ টাকায় বিক্রি করলেও উৎপাদকরা লাভ করতে পারবেন।
খুচরা ব্যবসায়ীরা এর চেয়ে বেশি দামে বিক্রি করলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও সতর্ক করেন তিনি।
ডিমের সাম্প্রতিক দরবৃদ্ধির ঘটনায় বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশিও পরোক্ষ হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, ডিমের দাম নিয়ন্ত্রণে না আসলে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সাথে সমন্বয় করে ডিম আমদানির অনুমতি দেয়া হবে।
গত বছরের আগস্টে যখন প্রতি পিস ডিমের দাম সাড়ে ৯ টাকা থেকে বেড়ে সাড়ে ১২ টাকা হয়, তখনও তিনি এ হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন।
'সুযোগসন্ধানী ব্যবসায়ীদের' সমালোচনা করে তিনি বলেছিলেন, এসব ব্যবসায়ীরা বাজারে অস্থিরতার সুযোগ নিচ্ছে, দাম বাড়ার ঘটনা প্রকৃত অবস্থা তুলে ধরে না।
আজ রোববার এক অনুষ্ঠানে তিনি আবারো বলেছেন, দাম নিয়ন্ত্রণে না আসলে, ডিম আমদানি করা হবে।
এক সময় আমিষের সস্তা উৎস বলে পরিচিত ডিম এখন আরো দামি হয়ে উঠছে এভাবেই। দামের উত্তাপে দরিদ্র মানুষের ডিম কেনা কমে যাচ্ছে।
অন্যান্য পণ্য ও সেবার লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধিও পরিস্থিতির অবনতি ঘটাচ্ছে। এতে মুরগি ও গরুর মাংস প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে স্বল্প-আয়ের মানুষের পাত থেকে। এখন মনে হচ্ছে, সেদিকেই এগোচ্ছে ডিম।
রান্নাঘরের হাঁড়ির হাল
ডিমের দাম বাড়ার চলমান এই অবস্থা, গত সপ্তাহে নতুন উচ্চতায় পৌঁছায়।
গত বছরের জুনে এক ডজন ডিমের দাম ছিল ৯০ টাকা। কিন্তু রোববার রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে ১৭০-১৭৫ টাকায় এক ডজন ডিম বিক্রি হয়েছে। এটা এক সপ্তাহের আগের ১৪০-১৪৫ টাকা ডজনের চেয়েও বেশি।
মোহাম্মদপুর নিবাসী হেলেনা বেগম বিভিন্ন বাসাবাড়িতে গৃহপরিচারিকার কাজ করেন। এভাবে মাসে ১০ হাজার টাকা আয় করেন বলে জানান তিনি।
হেলেনা বলেন, 'এই টাকায় সংসার খরচ চালাতে হয়। আমার দুই ছেলে, তারা শেষবার গরুর মাংস খেয়েছিল কুরবানির ঈদের পর। একটু ডিমের তরকারি থাকলে বাচ্চারা খুশিই হতো, এখন সেটাও কিনতে পারছি না।'
রাজধানীর সাতমসজিদ সড়কে ভ্যানে খাবার বিক্রি করেন মানিক মিয়া। তার দোকানে পাওয়া যায়, খিচুড়ি, ভাত ও ডিমের তরকারি। ডিমের দাম বাড়ায় মানিক মিয়ার ব্যবসায় বড় ক্ষতি হয়েছে। কারণ, তার বেশিরভাগ ক্রেতাই দিনমজুর, রিকশাচালকসহ নিম্ন আয়ের মানুষ।
মানিক বলেন, 'আগে খুব সহজেই প্রায় ২৫-৩০ টাকায় খিচুড়ি ও ডিম বিক্রি করতে পারতাম। এখন সেই দাম বাড়িয়ে ৫০ টাকা করতে হয়েছে। এতে আমার কাস্টমার কমে গেছে, আগের মতো আর আয় হচ্ছে না।'
পুষ্টিচাহিদা মেটাতে মাথাপিছু কয়টি ডিম খাওয়া দরকার তার একটি হিসাব দিয়েছে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (ইউএন- ফাও) এর। ২০২২ সালেই সর্বনিম্ন সীমায় নামে বাংলাদেশিদের ডিম আহার। ফাও বলছে, বছরে অন্তত ১০৪টি ডিম খাওয়া দরকার। আর এই সময়ে বাংলাদেশিরা মাথাপিছু তার চেয়ে একটু বেশি ১০৪.২৩টি ডিম খেয়েছেন।
আনুষ্ঠানিক তথ্য বলে, ডিম উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ বাংলাদেশ, এমনকী রপ্তানির সম্ভাবনাও আছে। কিন্তু, এর তিন বছর পরে পরিস্থিতির উল্টো চিত্রই চোখে পড়ছে।
মানিক যখন তার ব্যবসার মন্দার কথা বলছিলেন, তখন খাওয়া থামিয়ে রিক্সাচালক জিসান প্রশ্ন রাখেন, 'ডিমের বাজার থেকে কে এত টাকা কামিয়ে নিচ্ছে?' তারপর আবারো ভাত, ডাল ও ভর্তার পাতে হাত বাড়ান।
গলদ কোথায়?
সকালের নাস্তায় যুক্তরাষ্ট্রে প্রচলিত একটি খাবার হল এগ বেনেডিক্ট। যেটি তৈরি করা জটিল এবং সময়সাপেক্ষ। ইংলিশ মাফিনের দুই অর্ধেকের মধ্যে প্রতিটিতে শুকিয়ে সংরক্ষণ করা মাংস, একটি করে পোচ করা ডিম এবং হল্যান্ডাইজ সস দিয়ে এটি তৈরি করা হয়।
পৃথকভাবে এর সবকটি উপাদান মাফিনের অর্ধেক অংশে বসানো সহজ। কিন্তু সেগুলোকে একসঙ্গে করতে গেলেই অসুবিধা দেখা দেয়।
বাংলাদেশের বর্তমান ডিমের বাজারের অবস্থাও এগ বেনেডিক্ট প্রস্তুত করার মতো – সাধারণভাবে দেখলে সহজ মনে হয়, তবে সবকিছু একসাথে মেলানোর চেষ্টা করলে এটি ঘোলাটে হয়ে ওঠে।
যদিও কেউ সঠিকভাবে দাম বৃদ্ধির কারণ আলাদা করতে পারছেন না। তবে বাণিজ্যমন্ত্রী প্রায়শই বলছেন, ব্যবসায়ীরাই মুনাফার জন্য এমন করছে।
পাইকারি বিক্রেতা এবং সংশ্লিষ্টরা বলছেন, উচ্চ চাহিদা এবং কম সরবরাহের কারণে এমন দাম বাড়ছে। মানুষ যেহেতু মাছ ও মাংসের মতো দামী খাদ্য কেনা কমিয়েছে, তাই সেরা বিকল্প হয়ে উঠেছে ডিম। ফলে ডিমের চাহিদাও বেড়েছে।
ঢাকার বেড়িবাধ এলাকায় ডিমের পাইকারি বিক্রেতা শফিকুল ইসলাম জানান, চাহিদার তুলনায় সরবরাহ অনেক কম।
তিনি বলেন, মহামারী চলাকালীন বেশিরভাগ হোটেল এবং রেস্তোরাঁ বন্ধ থাকায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ছিল। অন্যথায় দাম আরও আগে বেড়ে যেত।
সরকারি হিসেবে দেশে প্রতিদিন ছয় কোটির বেশি ডিম উৎপাদিত হলেও, বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিল (বিআইপিসিসি) বলছে, উৎপাদন হচ্ছে চার কোটি।
বিআইপিসিসি মতে, বার্ষিক মাথাপিছু ডিমের চাহিদা ১০০-১০৪টি। এ ক্ষেত্রে সরকারের পরিসংখ্যান জানা যায়নি।
গত বছর ক্রমাগত মূল্যবৃদ্ধির মধ্যে সরকার বাজার মনিটরিং জোরদার করে, যার ফলে দাম কমেছে।
প্রতি ডজন ডিম ১৫৫ থেকে ১৬০ টাকায় বিক্রি হলেও দাম নেমে আসে ১২০-১৩০ টাকায়।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর (ডিএনসিআরপি) দেখতে পায়, পাইকারি বিক্রেতারা জ্বালানির দাম বৃদ্ধিকে পুঁজি করে ফোন কল এবং টেক্সট মেসেজের মাধ্যমে উচ্চ মূল্য নির্ধারণ করে ডিমের বাজারকে অস্থিতিশীল করছে।
গত বছরের আগস্টে এক অনুষ্ঠানে ডিএনসিআরপির মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) এএইচএম শফিকুজ্জামান বলেন, জ্বালানির দাম বাড়ায় প্রতি ডিম পরিবহনের খরচ ০.৩-০.৪ টাকা বাড়ার কথা। কিন্তু ব্যবসায়ীরা দাম বাড়িয়েছে ডিম প্রতি ২.৭০ টাকা। ডিম ব্যবসায়ী সমিতি ফোনে দাম নির্ধারণ করে সারা দেশে বাজার অস্থিতিশীল করে।
পরের দিন, ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বারস অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফবিসিসিআই) ডিমের দামের কারসাজিকারীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানায়।
বাংলাদেশ এগ প্রডিউসার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি তাহের আহমেদ সিদ্দিকী অবশ্য বলেন, শহরের নির্দিষ্ট এলাকার ডিম ব্যবসায়ীদের কারণে এই মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে এবং এ ব্যাপারে সমিতি অসহায়।