করদাতাদের পকেট থেকে দেওয়া নগদ প্রণোদনার সুফল যেভাবে পশ্চিমা পোশাক ক্রেতারা নিচ্ছে
দেশের পোশাক রপ্তানিকারকদের নানা ধরনের কর সুবিধা ও নগদ প্রণোদনা দেওয়া হয়। এসব ভর্তুকি পোশাকের দামের সঙ্গে যোগ করে এর সুফল নিজেদের ঘরে তুলছে পশ্চিমা ব্র্যান্ড ও ক্রেতারা। কিন্তু এই চর্চার কারণে নিজেদের ন্যায্য ভাগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন দেশের পোশাক শ্রমিকরা। কারণ এই ব্যয়বৃদ্ধির সময়েও তাদেরকে তাদের ন্যূনতম মজুরি এখনও পাঁচ বছর আগে নির্ধারণ করে দেওয়া ৮ হাজার টাকাই।
উদাহরণ দিতে গিয়ে শিল্পসংশ্লিষ্টরা জানান, এক দশক আগে বাংলাদেশ একটি মানসম্মত টি-শার্ট বিক্রি করত দেড় ডলারে। সবরহারকারীদের মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতার কারণে ওই টি-শার্ট এখনও একই কিংবা কখনও কখনও এরচেয়েও কম দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। যেখানে পশ্চিমা খুচরা বিক্রেতারা এই টি-শার্ট প্রতি পিস সাড়ে চার ডলারে বিক্রি করে—অর্থাৎ তাদের মুনাফার মার্জিন অনেক বেশি।
একইভাবে বাংলাদেশ একটি শার্ট সাড়ে চার ডলারে এবং একজোড়া ডেনিম প্যান্ট সাড়ে ছয় ডলারে বিক্রি করলেও মার্কিন ও ইউরোপের খুচরা বিক্রেতারা সেগুলো যথাক্রমে সাড়ে ১৩ ও সাড়ে ১৯ ডলারে বিক্রি করছে। এভাবে এই খুচরা বিক্রেতারা তিনগুণ পর্যন্ত মুনাফার মার্জিন রাখে।
রপ্তানিকারকরা বলছেন, গত পাঁচ বছরে উৎপাদন খরচ ৪০ শতাংশ বাড়লেও, পশ্চিমা ক্রেতারা বাংলাদেশে তৈরি টি-শার্টের দাম কয়েক সেন্টও বাড়াতে চায় না।
বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, তারা পোশাকের 'কাটিং-অ্যান্ড-মেকিং' চার্জ বাড়ানোর কথা বলে আসছেন, কিন্তু তাদের চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে।
আরএমজির জন্য নগদ প্রণোদনা ও কর সুবিধা
পোশাক রপ্তানিকারকরা এখন স্থানীয়ভাবে কেনা কাঁচামাল, যেমন সুতা ও ফ্যাব্রিক থেকে তৈরি করা পোশাক রপ্তানির সময় ৫ শতাংশ নগদ প্রণোদনা পায়। অপ্রচলিত বাজারে রপ্তানি করতে পারলে বাড়তি ৪ শতাংশ নগদ প্রণোদনা দেওয়া হয়। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া বাকি সব রপ্তানি গন্তব্যই অপ্রচলিত রপ্তানি বাজার। এছাড়া সমস্ত দেশে রপ্তানিতেই অতিরিক্ত ১ শতাংশ নগদ প্রণোদনা পায় পোশাক রপ্তানিকারকরা।
সেপ্টেম্বরে ওইসিডি ও জাতিসংঘের 'প্রোডাকশন ট্রান্সফরমেশন পলিসি রিভিউ অভ বাংলাদেশ: ইনভেস্টিং ইন দ্য ফিউচার অভ আ ট্রেডিং নেশন' শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এতে উঠে এসেছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে রপ্তানিতে বাংলাদেশ প্রায় ৭ হাজার ৫৫০ কোটি টাকা (৭০০ মিলিয়ন ডলার) নগদ প্রণোদনা দিয়েছে—যা ওই অর্থবছরের বাজেটে দেশের মোট ভর্তুকি ব্যয়ের প্রায় ১০ শতাংশের সমান।
প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, এসব প্রণোদনা থেকে মূলত তৈরি পোশাক (আরএমজি) খাতই উপকৃত হয়। কারণ বাংলাদেশ সরকারের সাম্প্রতিকতম অফিশিয়াল তথ্য অনুসারে, এই নগদ প্রণোদনার ৬৫ শতাংশ বা প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা পেয়েছে গার্মেন্টস ও টেক্সটাইল শিল্প।
তবে পোশাক রপ্তানিকারকরা শুধু নগদ প্রণোদনাই পায় না। এর পাশাপাশি তারা প্রচুর কর ও শুল্ক সুবিধাও ভোগ করে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) প্রাক্কলন অনুসারে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে সব মিলিয়ে কর ভর্তুকি দেওয়া হয়েছে ১.৭৮ লাখ কোটি টাকা। এই আর্থিক সহায়তার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ পেয়েছে পোশাক রপ্তানিকারকরা।
বাংলাদেশি ও অন্য দেশের শ্রমিকেরা যা পান
বর্তমানে বাংলাদেশে একজন পোশাককর্মীর ন্যূনতম মজুরি ৮ হাজার টাকা। এক মার্কিন ডলারের ১১০ টাকা বর্তমান বিনিময় হারের ভিত্তিতে এ মজুরি ৭৩ ডলারের কম। পাঁচ বছর আগে ২০১৮ সালে যখন এ মজুরি নির্ধারণ করা হয়েছিল, তখন ৮ হাজার টাকা ছিল ৯৪ ডলারের সমতুল্য।
অন্যদিকে চীনে পোশাক খাতের শ্রমিকদের মাসিক ন্যূনতম মজুরি ৩০০ ডলারের বেশিও হয়। এছাড়া ন্যূনতম মজুরির এ পরিমাণ কম্বোডিয়ায় ২০০ ডলার, ভারতে ১৭১ ডলার, ভিয়েতনামে ১৭০ ডলার এবং পাকিস্তানে ১১০ ডলার। এমনকি মিয়ানমারেও ন্যূনতম মজুরি প্রতি মাসে ১০০ ডলারের ওপরে।
করদাতাদের অর্থ কাদের পকেটে যাচ্ছে?
এসব প্রণোদনার সরাসরি সুফল পায় পশ্চিমা ক্রেতা ও তাদের ভোক্তারা। রপ্তানিকারকেরা জানান, বাংলাদেশ সরকার রপ্তানিকারকদের যে প্রণোদনা দেয়, তা হিসাবে নিয়েই মার্কিন ও ইউরোপীয় ব্র্যান্ড এবং ক্রেতারা পোশাকের দাম ঠিক করে।
বিভিন্ন দেশে পোশাকপণ্য রপ্তানির একটি বায়িং হাউসের পরিচালক ইকবাল হোসেন বলেন, 'সব ব্যবসায়ীই এটা করে। এটা একটা সাধারণ চর্চা।'
তবে এ প্রণোদনার প্রকৃত সুবিধাভোগী হচ্ছেন উৎপাদকেরা। তারা তাদের মুনাফা সর্বোচ্চ করার জন্য দাম বাড়ানোর কৌশল অবলম্বন করেন। যেমন, একটি শার্টের প্রকৃত রপ্তানি মূল্য যদি তিন ডলার হয়, তাহলে অনেকসময় কিছু রপ্তানিকারক বেশি প্রণোদনা পাওয়ার জন্য শার্টের দাম চার ডলার ধরে। এ সুবিধা নেওয়ার জন্য তারা তাদের প্রকৃত গন্তব্য বাজারে পৌঁছানোর আগে প্রাথমিকভাবে দুবাই, হংকং, সিঙ্গাপুর বা অন্যান্য দেশে মধ্যবর্তী গন্তব্যে তাদের পণ্য বর্ধিত মূল্যে রপ্তানি করে।
বাংলাদেশি শ্রমিকদের কম উৎপাদনশীলতাকে দায়ী করছেন মালিকেরা
এশিয়ান প্রোডাক্টিভিটি অর্গানাইজেশন-এর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, মূল্যের দিক থেকে একজন বাংলাদেশি পোশাককর্মীর ঘণ্টায় উৎপাদনশীলতা দাঁড়ায় ৩.৪ ডলারে। উৎপাদনশীলতার এ হার প্রতিযোগী দেশগুলোতে তুলনামূলকভাবে বেশি—মায়ানমারে ৪.১ ডলার, ভিয়েতনামে ৪.৭ ডলার, ভারতে ৭.৫ ডলার, ফিলিপাইনে ৮.৭ ডলার, চীনে ১১ ডলারের বেশি এবং শ্রীলঙ্কায় প্রায় ১৬ ডলার।
ওইসিডির রিপোর্টে আরও দেখা গেছে, বাংলাদেশের শ্রম-উৎপাদনশীলতা অন্যান্য দেশের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে কম। ২০১৯ সালে বাংলাদেশের শ্রম-উৎপাদনশীলতা যুক্তরাষ্ট্রের মাত্র ৯ শতাংশ, ভারতের ১২ শতাংশ এবং ভিয়েতনামের ১৪ শতাংশ ছিল।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) সভাপতি ফারুক হাসান বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের মধ্যে শ্রমিকদের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, অপচয় কমানো এবং সম্পদ সাশ্রয় বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন।
তিনি বলেন, 'প্রতি বছরই উৎপাদন খরচ বাড়ছে। তবু আমরা উৎপাদনশীলতার বৈশ্বিক বেঞ্চমার্ক ছুটে পারিনি। তাই উদ্ভাবন, প্রযুক্তিগত অগ্রগতি এবং জ্ঞানভিত্তিক রূপান্তরের মতো দীর্ঘমেয়াদি অগ্রাধিকারগুলোতে মনোনিবেশ করার পাশাপাশি স্বল্পমেয়াদে ভারসাম্যও বজায় রাখতে হবে আমাদের।'
ফারুক হাসান বলেন, উৎপাদনশীলতা বাড়ালে কারখানা ও শ্রমিক দুই পক্ষই উপকৃত হয়।
বাংলাদেশ যে অনন্য কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে, সেগুলোও তুলে ধরেন ফারুক। তিনি জানান, অন্যান্য প্রতিযোগী দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের তুলনা করা ঠিক হবে না, কেননা ওই সব দেশের কাঁচা তুলা ও রাসায়নিকের মতো নিজস্ব কাঁচামাল রয়েছে। আর বাংলাদেশকে এসব সুবিধা ছাড়াই প্রতিযোগিতা করতে হচ্ছে।
বিজিএমইএর একটি প্রাক্কলন অনুসারে, গত পাঁচ বছরে উৎপাদন খরচ ৪০ শতাংশের বেশি বেড়েছে।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, উৎপাদন দক্ষতা কম থাকা সত্ত্বেও অপারেটরদের সহায়তা করার জন্য উল্লেখযোগ্যসংখ্যক হেলপার নিয়োগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অনন্য।
তিনি বলেন, নতুন মজুরি কাঠামো বাস্তবায়নের পর অনেক কারখানায় হেলপার নিয়োগ বন্ধ হয়ে যেতে পারে। ফলাফলের ভিত্তিতে বেতন পাওয়া 'পিস-রেট' কর্মীরা নির্দিষ্ট মজুরি কাঠামোর অধীনে থাকা শ্রমিকদের চেয়ে বেশি দক্ষতায় কাজ করে।
হাতেম নতুন মজুরি কাঠামো বাস্তবায়নে কমপক্ষে তিন মাস সময় দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন, কারণ পোশাকের ক্রয়াদেশ সাধারণত উৎপাদনের তিন থেকে ছয় মাস আগে পাওয়া যায়।
কম মজুরির সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসার উপায়
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও স্থানীয় বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশকে স্বল্প মজুরির সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হলে বহুমুখীকরণ ও উদ্ভাবনে গুরুত্ব দিতে হবে।
ওইসিডির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মূলত ভবিষ্যত কর্মসংস্থানের সীমিত সম্ভাবনা ও অর্থপূর্ণ আনুষ্ঠানিক কর্মসংস্থান সম্ভাবনা তৈরিতে ব্যর্থতার কারণে বাংলাদেশ কম উৎপাদনশীলতার চক্রে আটকা পড়েছে।
এতে আরও বলা হয়েছে, আরও গতিশীল খাতে—যেসব কাজে উৎপাদনশীলতা গড় হারের চেয়ে বেশি বৃদ্ধি পায়—শ্রম স্থানান্তরে কম গুরুত্ব দেওয়ায় দেশ উৎপাদনশীলতায় পিছিয়ে রয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ইলেকট্রনিস, পাদুকা ও সেমি-কন্ডাক্টরের মতো গতিশীল খাতের কারণে ভিয়েতনামে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পেয়েছে।
উদ্ভাবনে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ কম
বৈশ্বিক পোশাক উৎপাদনের নির্ভরযোগ্য হাব হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে বাংলাদেশ। তবে এদেশ এখনও উদ্ভাবনী অর্থনীতিতে রূপান্তরিত হতে পারেনি।
স্থানীয়ভাবে গড়ে ওঠা প্রতিষ্ঠান ও অত্যন্ত প্রভাবশালী দেশীয় উদ্যোক্তা শ্রেণি আছে বাংলাদেশের। তবে দেশে ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড মোটাদাগে দুই ভাগে বিভক্ত: ১) সুরক্ষিত স্থানীয় বাজারের মধ্যে মৌলিক ও প্রয়োজনীয় পণ্য বিপণন, ২) দেশের তুলনামূলক কম শ্রম খরচের সুবিধা নিয়ে ব্যয়-সাশ্রয়ী কিন্তু শ্রমঘন পণ্য রপ্তানি করা।
এই প্রচলিত ব্যবসায়িক কৌশলগুলো লক্ষ্যযুক্ত নীতি কাঠামোর ওপর ভর করে টিকে থাকে। এ নীতিকাঠামো নিয়মনীতি ও নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে দেশীয় উৎপাদন বাড়াতে সহায়তা করে।
ওইসিডি প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, বাংলাদেশের মাত্র ১.২ শতাংশ প্রতিষ্ঠান উন্নয়ন ও গবেষণায় (আরঅ্যান্ডডি) বিনিয়োগ করে—যা ভারতীয় প্রতিষ্ঠানের অর্ধেকেরও কম। এছাড়া মাত্র ২.৬ শতাংশ বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান বিদেশি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে পাওয়া প্রযুক্তি অনুমোদনক্রমে ব্যবহার করে। ভিয়েতনাম ও তুরস্কে এ হার যথাক্রমে ১০.৮ শতাংশ ও ১৪.৪ শতাংশ।
বাংলাদেশে উদ্ভাবনের জন্য প্রযুক্তিগত ও ব্যবস্থাপনাগত দক্ষতার ব্যবধান রয়েছে উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উদ্ভাবন ও শিক্ষণে সহায়তার না দেওয়া এর অন্যতম কারণ। এছাড়া আন্তর্জাতিক অংশীদাররাও বাংলাদেশকে উদ্ভাবন-অংশীদার হিসেবে না দেখে ব্যবসার চুক্তি হিসেবে দেখে বলেও বাংলাদেশ এক্ষেত্রে পিছিয়ে রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।