বেসরকারি পর্যায়ে রিফাইনারি স্থাপন ও তেল পরিশোধন করতে পারবে ঋণ খেলাপিরা
ঋণ খেলাপি প্রতিষ্ঠান ও তার পরিচালকদের জন্য বিনিয়োগের সুযোগ উন্মুক্ত রেখে 'বেসরকারি পর্যায়ে রিফাইনারি স্থাপন, অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানিপূর্বক মজুদ, প্রক্রিয়াকরণ, পরিবহন ও বিপণন নীতিমালা ২০২৩' এর গেজেট জারি করেছে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ।
এর ফলে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ঋণ খেলাপি প্রতিষ্ঠান ও খেলাপি প্রতিষ্ঠানের পরিচালকরা রিফাইনারি স্থাপনসহ জ্বালানি তেলের ব্যবসায় সম্পৃক্ত হতে পারবেন।
এছাড়া, জাতীয় বা আন্তর্জাতিক আদালতে ঋণ খেলাপি সংক্রান্ত মামলা অনিষ্পন্ন অবস্থায় থাকলেও তারা এই ব্যবসায় সম্পৃক্ত হতে পারবেন।
গত আগস্ট মাসে 'বেসরকারি পর্যায়ে রিফাইনারি স্থাপন, অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানিপূর্বক মজুদ, প্রক্রিয়াকরণ, পরিবহন ও বিপণন নীতিমালা ২০২৩' এর খসড়া প্রণয়ন করে জ্বালানি বিভাগ।
খসড়া নীতিমালায় বেসরকারি উদ্যোক্তাদের যোগ্যতা সম্পর্কে বলা হয়েছিল, "বেসরকারি উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান অথবা তার পরিচালকবৃন্দ কোন ধরনের ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান হতে ঋণ খেলাপি হতে পারবেন না বা কোন জাতীয় বা আন্তর্জাতিক আদালতে এ সংক্রান্ত কোন মামলা অনিষ্পন্ন অবস্থায় থাকতে পারবে না।"
১৫ নভেম্বর এই নীতিমালার যে গেজেট জারি করেছে জ্বালানি বিভাগ, সেখানে এই শর্ত রাখা হয়নি। চূড়ান্ত নীতিমালায় উদ্যোক্তাদের যোগ্যতায় আরও কিছু ছাড় দেওয়া হয়েছে।
এই নীতিমালা অনুযায়ী, রিফাইনারির সক্ষমতা হতে হবে বছরে কমপক্ষে ১৫ লাখ টন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জ্বালানি বিভাগের সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে টিবিএসকে বলেন, "আন্তঃমন্ত্রণালয় সভাসহ উচ্চ পর্যায়ে একাধিক সভায় খসড়াটি চূড়ান্ত করা হয়েছে। ওই সব সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী শর্তটি বাদ দেওয়া হয়েছে। ফলে ঋণ খেলাপি প্রতিষ্ঠান বা খেলাপি প্রতিষ্ঠানের পরিচালকরাও বেসরকারি পর্যায়ে রিফাইনারি স্থাপন, অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি, মজুদ, প্রক্রিয়াকরণ, পরিবহন ও বিপণন করতে পারবেন।"
উদ্যোক্তাদের যোগ্যতার শর্ত আরও কয়েকটি ক্ষেত্রে শিথিল করেছে জ্বালানি বিভাগ।
খসড়া নীতিমালায় কোন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কনসোর্টিয়াম গঠন করে থাকলে উভয় পক্ষের জ্বালানি খাতে কোন প্রকল্প নির্মাণ, পরিচালনা বা ভারী শিল্প নির্মাণ বা পরিচালনার ক্ষেত্রে কমপক্ষে ১০ বছরের বাস্তব অভিজ্ঞতা থাকার কথা বলা হয়েছিল। চূড়ান্ত নীতিমালায় এটি কমিয়ে ৫ বছর করা হয়েছে।
খসড়া নীতিমালায় বলা হয়েছিল, বেসরকারি উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠানের গত ৫ বছরের মধ্যে যেকোন ৩ বছরের প্রতিবছর টার্নওভার কমপক্ষে ৫০০০ কোটি টাকা বা সমমূল্যের মার্কিন ডলার হতে হবে। চূড়ান্তভাবে প্রকাশিত নীতিমালায় এ শর্ত অবিকৃত রেখে বলা হয়েছে, যৌথ অংশীদারি বা কনসোর্টিয়াম গঠন করে এই ব্যবসায় সম্পৃক্ত হতে আগ্রহীদের ক্ষেত্রে কনসোর্টিয়ামের টার্নওভারের ক্ষেত্রে এ শর্ত প্রযোজ্য হবে।
অর্থাৎ, দু'টি বা তার অধিক কোম্পানির প্রতিবছর বার্ষিক টার্নওভারের সমষ্টি ৫০০০ কোটি টাকা বা তার সমমূল্যের মার্কিন ডলার হলে তারা যৌথভাবে বা কনসোর্টিয়াম গঠন করে এই ব্যবসায় সম্পৃক্ত হতে পারবে।
খসড়া নীতিমালায় বেসরকারি পর্যায়ে স্থাপিত রিফাইনারির জেটি সুবিধা রাখার বিষয়টি 'ঐচ্ছিক' রাখা হলেও গেজেটেড নীতিমালায় তা বাধ্যতামুলক করা হয়েছে।
খসড়া নীতিমালায় বেসরকারি পর্যায়ে রিফাইনারি স্থাপনের জন্য কমপক্ষে ৮০ একর জমি এবং ন্যূনতম দুই লাখ টন ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন স্টোরেজ সুবিধার শর্তারোপ করা হয়েছিল।
নীতিমালাটি চূড়ান্ত করার সময় এসব ক্ষেত্রে শর্ত শিথিল করে বলা হয়েছে, রিফাইনারি স্থাপনে প্রয়োজনীয় আদর্শ পরিমাণ জমির সংস্থান করতে হবে এবং রিফাইনিং সক্ষমতার নিরিখে পর্যাপ্ত ও প্রয়োজনীয় স্টোরেজ সুবিধা থাকতে হবে।
তবে প্রত্যেকটি রিফাইনারিতে আধুনিক ক্রুড অয়েল রিফাইনারি ইফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট স্থাপনের শর্ত নতুন করে আরোপ করেছে জ্বালানি বিভাগ।
নীতিমালায় আরও যা থাকছে
নীতিমালায় বলা হয়েছে, কার্যক্রম শুরুর পর প্রথম তিন বছর সরকার নির্ধারিত মূল্যে বেসরকারি শোধনাগারগুলোকে মোট উৎপাদনের ন্যূনতম ৬০% জ্বালানী তেল (ডিজেল, অকটেন, পেট্রোল, জেট ফুয়েল, ফার্নেস অয়েল এবং উপজাত) বিপিসির কাছে বিক্রি করতে হবে।
অবশিষ্ট ৪০% জ্বালানি তেল শোধনাগারগুলো আলাদাভাবে বিক্রি করতে পারবে। যদি কোনো বেসরকারি শোধনাগার ওই ৪০% তেল অন্য কোথাও বিক্রি করতে অসুবিধার সম্মুখীন হয় তাহলে তারা যেকোন পরিমাণে উদ্বৃত্ত তেল বিপিসির কাছে বিক্রি করতে পারবে।
পরবর্তী দুই বছরে বেসরকারি শোধনাগারগুলো তাদের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় উৎপাদিত তেলের ৫০% পর্যন্ত বিক্রি করতে পারবে।
এছাড়া, উৎপাদিত জ্বালানি তেল খুচরা পর্যায়ে বিক্রির জন্য সড়ক ও মহাসড়ক, উপজেলা ও মহানগর এলাকায় পেট্রোল পাম্প স্থাপনের অনুমতিও পাবে তারা। এই পেট্রোল পাম্পগুলোতে সরকার-নির্ধারিত খুচরা মূল্যে জ্বালানি তেল বিক্রি করা যাবে।
স্বাধীনতার পর থেকেই জ্বালানি তেলের সরবরাহ ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পালন করছে সরকার। রাষ্ট্রায়ত্ত বিপিসি এই খাতের একমাত্র প্রতিষ্ঠান।
জ্বালানি বিভাগের একটি সূত্র টিবিএসকে জানিয়েছে, বসুন্ধরা গ্রুপ, পারটেক্স গ্রুপ, টিকে গ্রুপ এবং এলিট গ্রুপ সহ বেশ কয়েকটি বিশিষ্ট বেসরকারি প্রতিষ্ঠান অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি ও পরিশোধন করার জন্য শোধনাগার স্থাপনের অনুমোদন চেয়ে মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছে।
বসুন্ধরা গ্রুপের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, "আমরা এই প্রকল্পের ব্যাপারে খুবই সিরিয়াস। তেল শোধনাগার স্থাপনের জন্য আমরা চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে ২০০ একর জমি অধিগ্রহণ করেছি, যা হবে দেশের বৃহত্তম তেল শোধনাগার।"
বাংলাদেশে একচেটিয়াভাবে তেল পরিশোধনের কাজ করে বিপিসি। ক্রুড তেল আমদানি করার পর ইস্টার্ন রিফাইনারিতে তা পরিশোধন করা হয়। ১৯৬৮ সালে প্রতিষ্ঠিত এই শোধনাগারের। এর বার্ষিক পরিশোধন ক্ষমতা ১৫ লাখ টন, যা সামগ্রিকভাবে দেশের চাহিদার প্রায় ২০% পূরণ করে। চাহিদার বাকি ৮০% মেটানো হয় পরিশোধিত তেল আমদানির মাধ্যমে।
সক্ষমতা বাড়ানোর লক্ষ্যে বিপিসি ইস্টার্ন রিফাইনারির দ্বিতীয় ইউনিট নির্মাণের জন্য একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। প্রকল্পটির আনুমানিক ব্যয় ধরা হয়েছে ২৩,০০০ কোটি টাকা এবং এটি ২০২৭ সালে শেষ হবে বলে আশা করা হচ্ছে। এ প্রকল্প সম্পন্ন হলে বিপিসি'র অপরিশোধিত তেল পরিশোধন ক্ষমতা আরও ৩০ লাখ টন বাড়বে।