জ্বালানি আমদানির জন্য আইটিএফসি থেকে ২.১ বিলিয়ন ডলার ঋণ পাচ্ছে বাংলাদেশ
জ্বালানি আমদানির প্রয়োজনীয়তা মেটাতে ২০২৪–২৫ অর্থবছরের জন্য জেদ্দাভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ট্রেড ফাইন্যান্স কর্পোরেশন (আইটিএফসি) থেকে ২.১ বিলিয়ন ডলার ঋণ পেয়েছে বাংলাদেশ। এ ঋণ চলতি অর্থবছরে পাওয়া ১.৪ বিলিয়ন ডলার থেকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেশি।
ঋণ সহায়তা চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, আইটিএফসি পেট্রোলিয়ামজাতীয় পণ্য আমদানির জন্য রাষ্ট্রায়ত্ত বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি) এবং তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানির জন্য পেট্রোবাংলাকে অর্থায়ন করবে।
বুধবার (৭ ফেব্রুয়ারি) আইটিএফসি এবং জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের মধ্যে এ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সচিব মো. নূরুল আলম এবং আইটিএফসি প্রতিনিধিদলের প্রধান অপারেশন কর্মকর্তা নাজিম নূরদালী নিজেদের পক্ষে চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন।
মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ উপস্থিত ছিলেন।
আইটিএফসি বিভিন্ন সংস্থার কাছ থেকে তহবিল সংগ্রহের পর ঋণ বিতরণ করবে। এর মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক দেবে ৮০০ মিলিয়ন ডলার।
বুধবার সরকার সিঙ্গাপুরভিত্তিক একাধিক কোম্পানি থেকেও ৩টি এলএনজি কার্গো আমদানির অনুমোদন দিয়েছে।
প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকার বদ্ধপরিকর। তিনি বলেন, বিশ্বব্যাপী তেল ও গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির কারণে জ্বালানি নিরাপত্তা বজায় রাখা বেশ চ্যালেঞ্জিং হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তিনি বলেন, 'তেল ও গ্যাস সমৃদ্ধ দেশগুলোর সঙ্গে সহযোগিতা বাড়ানোর উদ্যোগের পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ প্রাকৃতিক গ্যাস ও তেল অনুসন্ধান এবং উৎপাদন বাড়ানোর প্রচেষ্টা চলছে।'
এ ঋণ সহায়তা সরকারকে সহজে পেট্রোলিয়াম জ্বালানি ও এলএনজি আমদানিতে সহায়তা করবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, ১.৬ বিলিয়ন ডলার পেট্রোলিয়ামজাত জ্বালানি আমদানিতে ব্যবহার করা হবে। বাকি ৫০০ মিলিয়ন ডলার দিয়ে এলএনজি আমদানি করা হবে।
জ্বালানি সচিব নূরুল আলম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, জ্বালানির দাম ওঠানামা করে বিধায় ভবিষ্যতে আমদানির পরিমাণ বাড়তে পারে।
সে অনুযায়ী জ্বালানি তেল আমদানিতে গত বছরের চেয়ে বেশি ঋণ নেওয়া হবে। পাশাপাশি দেশে ডলারের ঘাটতি বিবেচনায় এলএনজি আমদানির জন্যও ঋণ নেওয়া হয়।
জ্বালানি তেল ও এলএনজিসহ দেশের জ্বালানি আমদানির ব্যয় ২০২২–২৩ অর্থবছরে প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার ছিল। আগামী জুনে শেষ হওয়া চলতি অর্থবছরেও একই পরিমাণ বিল হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা পূর্বাভাস দিয়ে বলছেন, বাংলাদেশ এভাবে আমদানির ওপর নির্ভর করতে থাকলে ২০৩০ সালের মধ্যে জ্বালানি বিল দ্বিগুণ হতে পারে।
তারা বলছেন, চলতি বছরের মার্চ থেকে জ্বালানি তেলের জন্য স্বয়ংক্রিয় মূল্য নির্ধারণের ব্যবস্থা চালু করার কথা ভাবছে সরকার। উচ্চ সুদে এই ঋণ ব্যবহার করে জ্বালানি তেল আমদানি করার পর এর দামও স্বয়ংক্রিয় মূল্য পদ্ধতির আওতায় বাড়বে। অর্থাৎ উচ্চ মূল্য এবং পুঞ্জীভূত সুদ ভোক্তাদের ওপর চাপবে।
বাড়তি আর্থিক চ্যালেঞ্জ
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম টিবিএসকে বলেন, সরকার স্বাভাবিক জ্বালানি সরবরাহ বজায় রাখতে প্রচুর পরিমাণে ঋণ নিচ্ছে।
'এটি আপাতত জ্বালানি তেল ও গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করবে। তবে আর্থিক চ্যালেঞ্জও বাড়বে। পাশাপাশি বিপিসি এবং পেট্রোবাংলার ঋণ পরিশোধের ক্ষমতা না বাড়লে এবং দেশের বৈদেশিক মুদ্রা সরবরাহ পরিস্থিতির উন্নতি না হলে এ স্বল্পমেয়াদী ঋণ মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়াবে,' তিনি বলেন।
তিনি আরও বলেন, এই ঋণ-নির্ভর জ্বালানি সরবরাহ বৈদেশিক বাণিজ্যকে ভঙ্গুর করে তোলে। জ্বালানি আমদানির উচ্চ ব্যয়ের কারণে অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ আমদানি সংকুচিত হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, জ্বালানি খাতের প্রধান সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া উচিত। অভ্যন্তরীণ গ্যাস উৎপাদনকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। এছাড়া সেচের জন্য সৌর শক্তির ব্যবহারকে উৎসাহিত করার উদ্যোগ প্রয়োজন।
এ প্রথমবারের মতো এলএনজি আমদানির জন্য আইটিএফসি থেকে ঋণ নেওয়া হচ্ছে। গত বছর সরকার জ্বালানি তেল আমদানির জন্য আইটিএফসি থেকে ১.৪ বিলিয়ন ডলার ঋণ নেওয়ার জন্য চুক্তি করেছিল।
এর মধ্যে ৮০০ মিলিয়ন ডলার ঋণ নিয়েছে বিপিসি। বাকি ৬০০ মিলিয়ন ডলার আগামী জুনের মধ্যে পাওয়ার কথা রয়েছে। ডলার সংকটের কারণে এ ঋণের কিস্তি সময়মতো পরিশোধ করা যাচ্ছে না। পরে আইটিএফসি থেকে সময় বাড়িয়ে নেওয়া হয়েছে।
জ্বালানি খাতে বাংলাদেশ আইটিএফসি-এর শীর্ষ সহায়তাভোগী দেশ। আইটিএফসি-এর ওয়েবসাইট অনুসারে, এটি ২০২২ সালে বাংলাদেশকে সর্বোচ্চ ১.১৬ বিলিয়ন ডলার অর্থায়ন করেছে, যা তার এক বছর আগের ৬০০ মিলিয়ন ডলার থেকে বেশি।
২০০৮ সালে চালু হওয়ার পর থেকে আইটিএফসি বাংলাদেশের জন্য প্রায় সাড়ে ১৬ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য সহায়তা প্রস্তাব অনুমোদন করেছে। ব্যাংকসহ বেসরকারি খাত আইটিএফসি থেকে বাণিজ্যিক আর্থিক সহায়তা নেয়।
এ ঋণ পরিশোধের সময়কাল ধরা হয়েছে এক বছর। সিকিউরড ওভারনাইট ফাইন্যান্সিং রেটসহ (এসওএফআর) ২ শতাংশ হারে এ ঋণের সুদহার গণনা করা হবে। এই ২ শতাংশের মধ্যে ১.৮০ শতাংশ সুদহার এবং শূন্য দশমিক ২০ শতাংশ প্রশাসনিক চার্জ।
ঋণ পাওয়ার আগেই প্রশাসনিক চার্জ পরিশোধ করতে হবে। ৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত, প্রত্যাশিত ওঠানামাসহ এসওএফআর ছিল ৫ দশমিক ৩১ শতাংশ। তবে বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পূর্বাভাস অনুযায়ী, আগামী মাসগুলোতে এসওএফআর বাড়বে।
এ ঋণ ছয় মাসের ব্যবধানে দুই কিস্তিতে পরিশোধ করা হবে। এখন জ্বালানি বিভাগ অনাপত্তির জন্য অর্থমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন নন-কনসেশনাল লোন কমিটির কাছে চুক্তিটি পাঠাবে। এর অনুমোদনের পর বিভাগটি ঋণছাড়ের জন্য আইটিএফসি'র কাছে আবেদন করবে।
প্রাথমিকভাবে জ্বালানি বিভাগ এলএনজি আমদানিতে এ তহবিল ব্যবহার করবে। এ বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, তারা ফেব্রুয়ারি বা মার্চের প্রথম সপ্তাহে এলএনজি আমদানির জন্য অর্থ পরিশোধ করতে পারবেন। এরপর বিপিসি জুন বা জুলাই মাসের দিকে জ্বালানি আমদানির জন্য অর্থ পাবে।
দেশে বৈদেশিক মুদ্রা সংকটের কারণে বিপিসি ও পেট্রোবাংলা এক বছরেরও বেশি সময় ধরে বিদেশি সরবরাহকারীদের কাছে থাকা তাদের বকেয়া পরিশোধ করতে পারছে না। বিভিন্ন বিদেশি প্রতিষ্ঠানের কাছে এ দুটি প্রতিষ্ঠানের বর্তমানে ৫০০ মিলিয়নেরও বেশি বকেয়া রয়েছে। এক পর্যায়ে এ বকেয়া এক বিলিয়ন ডলারও ছাড়িয়ে গিয়েছিল।
এমনকি আন্তর্জাতিক সরবরাহকারীরা বকেয়া পরিশোধ না করার কারণে জ্বালানি, তেল এবং গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়ার কথা বলেছিল।
ডিসেম্বরের পর থেকে আমদানি কমানোয় করায় বিপিসির বকেয়াও কমেছে। রাষ্ট্র পরিচালিত সংস্থাটির বর্তমানে ১০০ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি ঋণ রয়েছে।
এলএনজি আমদানির অনুমোদন
সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি জ্বালানি বিভাগের উপস্থাপিত পৃথক তিনটি প্রস্তাব অনুমোদন করেছে। পেট্রোবাংলা স্পট মার্কেট থেকে এসব জ্বালানি কার্গো ক্রয় করবে।
পেট্রোবাংলা গোলবার সিঙ্গাপুর লিমিটেড থেকে দুটি এলএনজি কার্গো আমদানি করবে। প্রতিটি কার্গোতে ৩৩.৬০ লাখ এমএমবিটিইউ [মিলিয়ন মেট্রিক ব্রিটিশ থার্মাল ইউনিট] এলএনজি থাকবে। প্রতি ইউনিট ৯.৮৪৭ ডলার দরে প্রতিটি কার্গোয় খরচ হবে ৪২৫ কোটি ৮১ লাখ টাকা।
রাষ্ট্র পরিচালিত সংস্থা ভিটল এশিয়া (প্রা.) লিমিটেড সিঙ্গাপুর থেকে তৃতীয় কার্গোটি আনবে। প্রতি ইউনিট ৯.৭৭০ ডলার ভিত্তিতে এ কার্গোর খরচ পড়বে ৪২২ কোটি ৪৯ লাখ টাকা।
জ্বালানি বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে মোট ১৩টি এলএনজি কার্গো আমদানির পরিকল্পনা রয়েছে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর এলএনজির দাম আকাশচুম্বী হয়ে ওঠে। এরপর সরকার ২০২২ সালের জুলাই থেকে প্রায় সাত মাসের জন্য স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানি স্থগিত রেখেছিল।