মূল্যস্ফীতি নিয়ে সমস্যায় আছি, এখন আর নতুন ফান্ড নয়: কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর
"বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে এখন আর নতুন ফান্ড বা তহবিল দেওয়া যাবে না। কারণ এই মুহূর্তে মূল্যস্ফীতি নিয়ে খুব সমস্যায় আছি। তাছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংক কাউকে টাকা দিলে মানি ক্রিয়েশন হয়। ফলে মূল্যস্ফীতি বাড়ে।"
বৃহস্পতিবার (৮ ফেব্রুয়ারি) রাজধানীর মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে আয়োজিত মাইক্রো-ফাইন্যান্স ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরোর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে একথা বলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার।
তিনি আরো বলেন, আমরা ধীরে ধীরে ক্যাশলেস সোসাইটির দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। ২০২৬ সালের মধ্যে আমাদের ৭৫ শতাংশ লেনদেন ক্যাশলেস-ভিত্তিক হয়ে যাবে। তাই তথ্যের জন্য অনলাইন-ভিত্তিক ব্যবস্থায় যাওয়া খুবই জরুরি।
এসময় ক্ষুদ্র ঋণদাতা একটি প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহীর অনুরোধের ভিত্তিতে গভর্নর বলেন, "এই মুহূর্তে ক্ষুদ্র ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানকে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে আলাদা কোনো তহবিল দেওয়া সম্ভব নয়। কারণ, আমরা এখন মূল্যস্ফীতি নিয়ে ঝামেলায় আছি। বাংলাদেশ ব্যাংক কাউকে টাকা দিলে মার্কেটে মানি-ক্রিয়েশন হয়। এর ফলে মূল্যস্ফীতি বাড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়। কোন সিস্টেমকে ডিজিটাল করলেই, তার কাজ শেষ হয়ে যায় না। সিস্টেমকে মেইনটেন্যান্স করাটা প্রধান সমস্যা" বলে উল্লেখ করেন গভর্নর।
ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের ঋণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকর্তাদের প্রতি সর্বজনীন পেনশনে যুক্ত হওয়ার আহ্বান জানান আব্দুর রউফ তালুকদার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক এবং আইসিটি বিভাগের প্রধান দেবদুলাল রয় বলেন, "এই পুরো সিস্টেমটি এনআইডি-ভিত্তিক। এই মুহূর্তে ৫০টি প্রতিষ্ঠানে ডাটা আপলোড করা আছে। কাল থেকে সবগুলো প্রতিষ্ঠান এনআইডি ভিত্তিক বোরোয়ারদের ডেটা ইনপুট দিতে পারবেন।" তবে কাজ সহজ করার জন্য নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষিত করে তোলার আহ্বান জানান তিনি।
মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি বা এমআরএ ক্ষুদ্র ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ।
পিপলস ওরিয়েন্টেড প্রোগ্রাম ইমপ্লিমেন্টেশনের (পিওপিআই বা পপি) নির্বাহী পরিচালক মোরশেদ আলম সরকার বলেন, "বিভিন্ন ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান যাদেরকে ঋণ দিতে চায় না, আমরা তাদের নিয়েই কাজ করি। আমরা তাদেরকে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলছি। আমরা নতুন উদ্যোক্তা তৈরিতে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা পালন করছি। আমাদের ঋণে ৯৬ শতাংশই ফেরত এসেছে। আমাদের গ্রাহকরা অর্থ পাচারের সাথে জড়িত নয়। সুতরাং এমআরএ'র আওতাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম আরো বৃদ্ধি করতে এর জন্য গভর্নরের কাছে আলাদা তহবিল দাবি করলেন পপির এই শীর্ষকর্তা।
তিনি আরো বলেন, যেসব গ্রাহক ব্যাংকের সাথে সংযুক্ত হওয়ার সম্ভাবনাই রাখে না তাদেরকেই আমরা গ্রাহক হিসেবে গড়ে তুলছি। কিন্তু, আমানত সংগ্রহ করার ক্ষেত্রে আমাদের বিভিন্ন শর্ত দেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে সব ধরনের শর্ত প্রত্যাহারের দাবি জানান তিনি। এছাড়া এমআরএ আওতাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোতে কীভাবে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ আনা যায় সে বিষয়ে নীতিমালা দাবি জানিয়েছেন তিনি।
সাজেদা ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক জাহেদা ফিজ্জা কবির বলেন, এমআরএ আওতাধীন প্রতিষ্ঠানগুলো দেশের আর্থিক খাতের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। কিন্তু, আমাদের এখানে তথ্যের ব্যাপক অভাব রয়েছে। এজন্য আমাদের তথ্য আরো সমৃদ্ধ করা দরকার। বর্তমানে এমআরএ আওতাধীন শীর্ষ ১০ প্রতিষ্ঠান ক্ষুদ্রঋণ বাজারের ৮০ শতাংশই নিয়ন্ত্রণ করছে। এক্ষেত্রে অন্ততপক্ষে এই ১০ প্রতিষ্ঠানের তথ্যকে আরো বেশি সমৃদ্ধ করা দরকার। এছাড়া ক্ষুদ্রঋণের বিতরণের ক্ষেত্রে এবং টেকসই উন্নয়নের ক্ষেত্রে আমাদের কোনো গবেষণা নেই। এজন্য গবেষণার প্রতিও গুরুত্ব দেয়ার আহ্বান জানান তিনি।
মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটির (এমআরএ) পক্ষ থেকে জানানো হয়, গ্রাহক/ঋণগ্রহীতার জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) যাচাই করে এমএফ-সিআইবি প্রস্তুত করা হচ্ছে। অ্যাপ্লিকেশন প্রোগ্রামিং ইন্টারফেস বা এপিআই এর মাধ্যমে এনআইডি তথ্য ভাণ্ডার থেকে লিংক নিয়ে গ্রাহকের তথ্য যাচাই করা হবে। এজন্য এমআরএ এবং এনআইডি কর্তৃপক্ষের মধ্যে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করা হয়েছে।
এমএফ-সিআইবি বাস্তবায়নের ফলে যথাযথ গ্রাহক নির্বাচন, গ্রাহকের ঋণ যোগ্যতা যাচাই ও ইতিহাস জানা সম্ভব হবে।
একইসাথে, গ্রাহকের আর্থিক সেবাভুক্তি সহজতর করা, মাইক্রোফাইন্যান্স খাতে স্বচ্ছতা আনা এবং গ্রাহকের ঋণ প্রাপ্তির প্রতিবন্ধকতা দূর করা সহজ হবে। উদ্যোক্তা সৃষ্টির পথ সুগম করা তথা প্রাতিষ্ঠানিক আর্থিক খাতের সাথে ক্ষুদ্র উদ্যোগ ঋণের সংযোগে সামনের পথ আরো সুগম হবে।
স্বচ্ছতা, জবাবদিহি নিশ্চিত করে টেকসই জনবান্ধব ক্ষুদ্রঋণ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এমআরএ প্রতিষ্ঠা করা হয়। জুন ২০২৩ পর্যন্ত এমআরএ থেকে সনদপ্রাপ্ত ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৭৩১টি, যাদের গ্রাহক সংখ্যা ৪ কোটি ৮ লাখ। বিতরণকৃত মোট ঋণ ১ লাখ ৯১ হাজার কোটি টাকা; ঋণস্থিতি ২ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকা এবং শাখার সংখ্যা ২৫ হাজার ৩৩৬টি।
বর্তমানে এ খাতে ২ লাখ ৬ হাজার কর্মকর্তা/কর্মচারীর অংশগ্রহণের মাধ্যমে সরাসরি কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।
দেশের ৪ কোটি ৮০ লাখের বেশি পরিবার ক্ষুদ্রঋণ পরিষেবার আওতায় রয়েছে। গ্রামীণ অর্থায়নের প্রায় ৭৩ শতাংশ যোগান আসে ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে। বিতরণকৃত ঋণের প্রায় ৫০ শতাংশ কৃষি এবং ৩০ শতাংশ বিনিয়োগ হয় ক্ষুদ্র উদ্যোগ খাতে।