আমদানিতে কেজিতে ৪২ টাকা ট্যারিফই কি চিনির দাম বাড়াচ্ছে?
মূল্য স্থিতিশীল রাখার জন্য সরকার সম্প্রতি নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্য চিনি আমদানিতে নির্ধারিত শুল্ক কমিয়েছে। কিন্তু সরকারের এ পদক্ষেপকে ব্যর্থ করে দিয়ে দাম বেড়েছে চিনির।
নির্ধারিত শুল্ক প্রতি কেজিতে ৫০ পয়সা কমানোকে ন্যূনতম বলে উল্লেখ করে আমদানিকারকেরা বলছেন, তাদের এখনও ৪২ টাকা শুল্ক দিতে হয়।
২২ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন কর্তৃক উৎপাদিত লাল চিনির (ব্রাউন সুগার) দাম প্রতি কেজি ২০ টাকা বাড়ানোর ঘোষণার কয়েক ঘণ্টা পর শিল্প মন্ত্রণালয় সে সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে। দাম না বাড়ানো হলেও এ ঘোষণা এবং সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের দোলাচলে চিনির দাম কেজিতে ৪–৫ টাকা বেড়ে গেছে।
ব্যবসায়ীদের তথ্যমতে, গত সপ্তাহে দেশের বৃহত্তম পাইকারি বাজার চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে প্রতি মণ চিনির দাম (৩৭ দশমিক ৩২ কেজি) ১২০ থেকে ১৪০ টাকা বেড়েছে। প্রতি মণ চিনির গড় দাম গতকাল (২ মার্চ) ছিল পাঁচ হাজার থেকে পাঁচ হাজার ২০ টাকা। একই পরিমাণ চিনি গত এক সপ্তাহ আগে চার হাজার ৮৮০ থেকে চার হাজার ৯০০ টাকায় বিক্রি হয়েছিল।
এর প্রভাবে খুচরা পর্যায়ে চিনির দাম বেড়েছে কেজিতে পাঁচ টাকা। চট্টগ্রাম নগরীর কাজীর দেউড়ি এলাকার দোকানদার এনাম উদ্দিন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, গত সপ্তাহে বাজারে চিনির দাম ১৪০–১৪৫ টাকা থেকে বেড়ে বর্তমানে ১৪৫–১৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
এর আগে ৮ ফেব্রুয়ারি সরকার চিনি আমদানির ওপর নির্ধারিত শুল্ক টনপ্রতি দেড় হাজার টাকা থেকে কমিয়ে এক হাজার টাকা করে। অর্থাৎ প্রতি কেজিতে ৫০ পয়সা কমানো হয়েছে।
আমদানিকারকেরা বলছেন, প্রতি কেজিতে ৫০ পয়সা করে নির্ধারিত শুল্ক কমানোর ফলে চিনির দামে তেমন প্রভাব পড়েনি। তারা বলছেন, সরকারের অতিরিক্ত শুল্ক আদায়ের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ দামে স্থানীয় বাজারে চিনি বিক্রি করতে হচ্ছে।
চিনি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান সিটি গ্রুপের ডিজিএম (বিক্রয়) প্রদীপ করণ বলেন, 'সাম্প্রতিক শুল্ক কমানোয় প্রতি কেজির দাম কমেছে মাত্র ৫০ পয়সা। তবে আমদানি করা চিনির প্রতি কেজিতে এখনও ৪২ টাকা শুল্ক নেওয়া হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে ১৫ শতাংশ ভ্যাট, ৩০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক ও ২ শতাংশ অগ্রিম আয়কর।'
অতিরিক্ত শুল্ক এবং আমদানিতে ডলারের বাড়তি মূল্য পরিশোধের কারণে দেশীয় বাজারে চিনির দাম কমছে না, ব্যাখ্যা করেন তিনি।
তথ্যপোর্টাল ইনডেক্সমুন্ডি অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি কেজি চিনির বর্তমান বুকিং দর গড়ে ৫৭ দশমিক ৭৫ সেন্ট (৬৯ টাকা)।
চিনি শিল্প বিষয়ক একটি পোর্টাল চিনিমান্ডি অনুসারে, এমনকি প্রতিবেশী ভারতের বিভিন্ন রাজ্যেও চিনি বিক্রি হচ্ছে ৩৮–৪৩ টাকায় (৫০–৫৭ টাকার সমতুল্য)। তবে বাংলাদেশের বাজারে চিনি বিক্রি হচ্ছে ১৪৫ থেকে ১৫০ টাকায়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ব্যবসায়ী টিবিএসকে বলেন, 'আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি কেজি চিনির ক্রয়মূল্য ৬৯ টাকা। কিন্তু ৪২ টাকা শুল্ক আরোপ এবং পরিবহন ও পরিশোধন ব্যয় ১২ টাকা মিলিয়ে পাইকারি বাজারে চিনি পৌঁছাতে আমাদের খরচ হচ্ছে ১২৩ টাকা। তাহলে আন্তর্জাতিক বাজার কিংবা পাশের দেশের সঙ্গে দেশীয় বাজারের চিনির দামের তুলনা কীভাবে হবে?'
চিনি আমদানিতে চোরাচালানের ধাক্কা
ভোগ্যপণ্য আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান মেঘনা গ্রুপের ডিজিএম তাসলিম শাহরিয়ার বলেন, প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে চিনির দামের তফাৎ দ্বিগুণ হওয়ায় বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন আমদানিকারকেরা।
'এ সুযোগে সীমান্ত দিয়ে অবৈধভাবে দেশে চিনি পাচার হচ্ছে। ফলে আমদানিকৃত চিনির বিক্রি কমেছে,' বলেন তিনি।
এমনকি আমদানি খরচের সঙ্গে দামের সমন্বয় না হলেও চোরাই চিনির চাপে আমদানিকৃত চিনির দাম কমে যাচ্ছে বলে জানান তিনি। 'এতে ডলারের বাড়তি মূল্য দিয়ে চিনি আমদানি করে লোকসানের ঝুঁকিতে রয়েছে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো,' বলেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, সীমান্ত এলাকা দিয়ে প্রতিদিন ৩০০ থেকে ৪০০ ট্রাক চিনি দেশে প্রবেশ করছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি চিনি সিলেট, মৌলভীবাজার, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নেত্রকোনা, ময়মনসিংহ, জামালপুর ও ফেনী সীমান্ত দিয়ে প্রবেশ করে বলে জানান তসলিম শাহরিয়ার।
স্বাভাবিক সময়ে মেঘনা গ্রুপ প্রতিদিন ৬০–৭০ হাজার বস্তা চিনি বিক্রি করলেও চোরাই চিনির প্রভাবে বর্তমানে তা ৪০ হাজারে নেমে এসেছে বলে দাবি করেন এ কর্মকর্তা।
সীমান্ত দিয়ে দেশে চোরাই চিনি প্রবেশ বাড়ার প্রমাণ মিলেছে পুলিশের তথ্যেও। গত সপ্তাহে বাজার অস্থির হওয়ার পরপরই সিলেটের তেমুখী এলাকা থেকে ১৪০ বস্তা ভারতীয় চিনি জব্দ করেছে পুলিশ।
বিষয়টি নিশ্চিত করে সিলেট মহানগর পুলিশের মিডিয়া কর্মকর্তা মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, 'সম্প্রতি সীমান্ত দিয়ে অবৈধ চিনির সরবরাহ বেড়েছে। তাই আমরা বিষয়টি নিয়ে খুব সতর্ক আছি।'
২০২৩ সালের আগস্টে অবৈধ পথে চিনি সরবরাহ বন্ধের অনুরোধ জানিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রীসহ সরকারের বিভিন্ন বিভাগে চিঠি দেয় বাংলাদেশ সুগার রিফাইনার্স অ্যাসোসিয়েশন।
চিঠিতে বলা হয়, সম্প্রতি ভারত থেকে অবৈধভাবে নিম্নমানের চিনি দেশে প্রবেশ করছে। এতে একদিকে সরকার রাজস্ব হারাচ্ছে, অন্যদিকে দেশীয় চিনি শিল্পের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে।
কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অভ বাংলাদেশের (ক্যাব) সহ-সভাপতি এসএম নাজের হোসাইন বলেন, দেশে রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি চিনি কারখানায় উৎপাদন কম। 'এর ফলে চিনি এখন আমদানি নির্ভর খাত। তাই এ প্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের দাম কমাতে সরকারকে যৌক্তিক শুল্ক নির্ধারণ করতে হবে,' বলেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, '৭০ টাকা আমদানি মূল্যের এক কেজি চিনিতে ৪২ টাকা শুল্ক আদায় ভোক্তাদের ওপর জুলুমের শামিল।' বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের নেওয়া পদক্ষেপগুলো বাস্তবতার চেয়ে বেশি লোক দেখানো বলে মন্তব্য করেন তিনি।
তবে নাজের হোসাইন বলেন, 'চিনির চোরাচালান বন্ধ করতে হলে আমদানিকারকদেরও অতিরিক্ত মুনাফা থেকে বেরিয়ে এসে যৌক্তিক মূল্যে পণ্য বিক্রি করতে হবে।'
খাদ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে চিনির বার্ষিক চাহিদা প্রায় ১৮–২০ লাখ টন। এর মধ্যে সরকারি মিলগুলো একসময় দেড়–দুই লাখ টন চিনি উৎপাদন করত। তবে ১৫টি সরকারি চিনিকলের মধ্যে ৬টির উৎপাদন বন্ধ থাকায় বর্তমানে উৎপাদন ৫০ হাজার টনের নিচে নেমে এসেছে। এ কারণে দেশের চিনি খাতের প্রায় পুরোটাই বেসরকারি মিলগুলোর ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে।