কোমর তাঁতে বোনা পোশাকপণ্যে ভাগ্যবদল রাঙ্গামাটির ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর নারীদের
দোকানে শোভা পাচ্ছে কোমর তাঁতে বোনা শাড়ি, থ্রিপিস, ফতুয়া, ব্যাগসহ নানা ধরনের বাহারি পণ্য। দোকানের এক কোণে বসে কোমর তাঁতে পাহাড়ি পোশাক বুনছেন স্থানীয় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর নারী অমিতা চাকমা। পর্যটক আসতেই পোশাক বোনা রেখে পণ্য বিক্রিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন তিনি।
রাঙ্গামাটি সদর উপজেলার বালুখালী ইউনিয়নের নির্বাণ নগর বৌদ্ধ মন্দির মার্কেটের চিত্র এটি। এই মার্কেটের প্রায় ৫০টি দোকানের মালিক সবাই ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর নারী। কোমর তাঁতে নিজেদের বানানো পোশাকপণ্যের পাশাপাশি বিভিন্ন পাড়া থেকে সংগ্রহ করা পোশাক বিক্রি করা হয় এই মার্কেটে।
পণ্য তৈরি করতে কোমর তাঁত ব্যবহার করেন নারীরা। ঐতিহ্যবাহী কোমর তাঁত সাধারণত পার্বত্য অঞ্চলের জাতিগোষ্ঠীরা ব্যবহার করে। কোমর তাঁত বাঁশের লাঠি দিয়ে তাঁতির কোমরে বাঁধা হয়।
বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরাও এই মার্কেটে পণ্যের পসরা সাজিয়েছেন। পড়ালেখার পাশাপাশি অবসর সময়ে পণ্য বেচাকেনা করে সংসারে বাড়তি আয়ে ভূমিকা রাখছেন তারা।
এই কাজকে পেশায় পরিণত করে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হচ্ছেন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর নারীরা। অনেক নারী পেশা বদল করে এখন রীতিমতো ব্যবসায়ীতে পরিণত হয়েছেন।
রাঙ্গামাটি সদর উপজেলার বালুখালী ইউনিয়নের কাপ্তাই লেকের পাশে পাহাড়ের পাদদেশ নির্বাণ নগর বৌদ্ধ মন্দির। এই মন্দিরে আসা পুণ্যার্থী ও পর্যটকদের চাহিদার ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে এই মার্কেট।
ছুটির দিনগুলোতে প্রতিটি দোকানে ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়।
সরেজমিনে গত ২৮ জানুয়ারি নির্বাণ নগর বৌদ্ধ মন্দির এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, পাহাড়ের ঢালে সারি সারি দোকান। পাহাড়ি নারীরা দোকানে কোমর তাঁতে বানানো পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসেছেন। প্রতিটি দোকানে শোভা পাচ্ছে গায়ের চাদর, বিছানা চাদর, ওড়না, শাড়ি, থ্রি পিস, লুঙ্গি, ফতুয়া, বিভিন্ন আকার ও ডিজাইনের হাত ব্যাগসহ পরিধেয় নানা পোশাক। পণ্য বিক্রির পাশাপাশি নারীরা দোকানে বসেই কোমর তাাঁতে কাপড় বুনছেন। কাপড়ের দোকান ছাড়াও পাহাড়ি আনারসসহ বিভিন্ন ফলমূল বেচাকেনা হচ্ছে এই বাজারে।
বালুখালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান অমর কুমার চাকমা বলেন, বনবিহার কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে জায়গা ও অনুমতি নিয়ে পাহাড়ি নারীরা নিজেরাই এসব দোকান তৈরি করেছেন।
'২০১১ সালের মাঝামাঝি সময়ে চালু হওয়া এই মার্কেটে এখন ৪৬টি দোকান আছে। ক্রমেই বাড়ছে দোকানের সংখ্যা। এই দোকানের জন্য কোনো ভাড়া দিতে হয় না। শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি অনেক নারী তাদের কৃষিকাজ, মাছ ধরা পেশা বদল করে ব্যবসা করছেন। এই মার্কেটটির কারণে নরীদের বাড়তি আয়ের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে,' বলেন তিনি।
রাঙ্গামাটি শহর থেকে এসব পর্যটন এলাকায় ঘুরতে আসা পর্যটকেরা এই মার্কেট থেকে পণ্য কেনেন।
বান্দরবান কলেজের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী বিশাখা চাকমা বলেন, 'ছুটির দিনগুলোতে এখন পর্যটকরা বেশি আসেন। তখন আমাদের বিক্রি ভালো হয়। ছুটির দিনের বিক্রি ২০ হাজার থেকে ২৫ হাজার টাকা ছাড়িয়ে যায়। পড়াশোনার পাশাপাশি কাপড়ের এই ব্যবসা করি। এতে বাড়তি আয়ের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।'
বালুখালি ইউনিয়নের বাসিন্দা রেশমি চাকমা টিবিএসকে বলেন, 'এখানে যেসব পণ্য বিক্রি হয়, সবগুলোই কোমর তাঁতে তৈরি করা। সুন্দর ডিজাইন এবং মান ভালো হওয়ায় রাঙ্গামাটি বেড়াতে আসা পর্যটকরা এখানে নিয়মিত আসেন। শহরের মার্কেটগুলো থেকে তুলনামুলক কম দাম হওয়ায় বিক্রিও আশানুরূপ।'
এছাড়া বালুখালী ইউনিয়নসহ আশপাশের বিভিন্ন প্রান্তিক এলাকার নারীদের কাছ থেকেও কোমর তাঁতে বোনা কাপড় সংগ্রহ করে এই মার্কেটে নিয়ে আসা হয়। সকাল থেকেই শুরু হয় পণ্যের বেচাকেনা। সন্ধ্যার আগেই বিক্রি শেষ করে নারীরা নৌকায় করে ফিরে যান নিজ নিজ গ্রামে।
রাঙ্গামাটি সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী নিরতা চাকমা বলেন, 'ঐতিহ্যগতভাবে পারিবারের সব নারীসদস্য এই কাজের সঙ্গে যুক্ত। আমরা বিভিন্ন পাড়া থেকে এসব পোশাকপণ্য সংগ্রহ করে নির্বাণ নগর পর্যটন মার্কেটে নিয়ে আসি। এই মার্কেটটিকে ঘিরে আমাদের বাড়তি আয়ের পথ তৈরি হয়েছে।'
রাঙ্গামাটির রিজার্ভ বাজার ঘাট থেকে বোটে করে নির্বাণ নগর বৌদ্ধ বিহারে যেতে এক থেকে সোয়া এক ঘণ্টা লাগে। নির্বাণ নগর বন বিহারে ২৯ ফুট ৮ ইঞ্চি উচ্চতার বৌদ্ধ মন্দিরটি এই পথে যাওয়া পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণে পরিনত হয়েছে। এই মার্কেটের কাছাকাছি দূরত্বে রয়েছে রাঙ্গামাটির অন্যতম পর্যটন স্পট শুভলং ঝরনা। কাছেই আছে পেদা টিংটিং ও চাংপাং রেস্টুরেন্ট।
চট্টগ্রাম থেকে আসা পর্যটক তাছলিমা আক্তার বলেন, পাহাড় ও লেকের নান্দনিক সৌন্দর্য উপভোগ করার পাশাপাশি নির্বাণ নগরের এই মার্কেট যে-কাউকেই আকৃষ্ট করবে। 'শুভলং বেড়াতে এলেই আমরা এখান থেকে প্রয়োজনীয় কাপড় কিনতে আসি। রাঙ্গামাটি শহরের অন্যান্য শোরুমের তুলনায় এখানে কম দামে পণ্য পাওয়া যায়,' বলেন তিনি।