খাদ্যশস্য আমদানির বাজেট ৩৪ শতাংশ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত সরকারের
আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বিদেশ থেকে খাদ্যশস্য আমদানির বাজেট ৩৪ শতাংশ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। একইসঙ্গে, দেশের ভেতর থেকে খাদ্য সংগ্রহ বাবদ বাজেটে ১৮ শতাংশ বরাদ্দ কমানো হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলছেন, বিশ্বব্যাপী খাদ্য উৎপাদন কমে যাওয়া এবং টাকার বিপরীতে ডলারের দর বৃদ্ধির মধ্যে সরকার খাদ্যশস্য আমদানিতে বরাদ্দ বাড়ানো সিদ্ধান্ত নিয়েছে। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে যেন প্রয়োজনীয় তহবিল ব্যবহার করা যায়, সেজন্যই এ সিদ্ধান্ত।
সরকার বিদেশ থেকে চাল ও গম আমদানির জন্য চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটের বরাদ্দের তুলনায় ১,৭০৬ কোটি টাকা বেশি বরাদ্দ রাখছে। আর অভ্যন্তরীণ সংগ্রহের বরাদ্দ কমানো হচ্ছে ১,৬২৩ কোটি টাকা। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের বাজেট ব্যবস্থাপনা কমিটির সভার কার্যপত্র থেকে এ তথ্য জানা গেছে।
ওই সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছে, আগামী অর্থবছরে সরকার বিদেশ থেকে ৩,৮৬২ কোটি টাকার চাল আমদানি করবে। যেখানে চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটে বরাদ্দ ছিল ২,৫৯২ কোটি টাকা। অপরদিকে, বিদেশ থেকে আগামী অর্থবছরে গম আমদানিতে ২,৮৩৪ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হচ্ছে। চলতি অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ রয়েছে ২,৩৯৮ কোটি টাকা।
এদিকে, দেশের ভেতর থেকে চাল কেনার জন্য ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৭,৪৪১ কোটি টাকা বরাদ্দ প্রস্তাব করা হয়েছে। যেখানে চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৮,৭৫০ কোটি টাকা। আর আগামী অর্থবছরে দেশের ভেতর থেকে গম সংগ্রহ বাবদ নামমাত্র ৩৬ কোটি টাকার বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। যেখানে চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ ছিল ৩৫০ কোটি টাকা।
এ বিষয়ে খাদ্য সচিব মো. ইসমাইল হোসেন বলেন, বাজেটে খাদ্য সংগ্রহ বাবদ বরাদ্দের ক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ সংগ্রহ ও বৈদেশিক সংগ্রহ— এই দুটো খাত উল্লেখ করে বরাদ্দ রাখা হয়। কিন্তু সবসময় বিদেশ থেকে আমদানি করা হয় তা নয়।
"যেমন চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বিদেশ থেকে সরকার কোনো চাল আমদানি করেনি। কিন্তু বাজেটে বরাদ্দ রয়েছে। সেই বরাদ্দ দিয়ে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে সংগ্রহ করা হচ্ছে। আগামী অর্থবছরেও বিদেশ থেকে চাল সংগ্রহের বিশেষ পরিকল্পনা নেই। তবে প্রস্তুতি রাখার জন্য এই বরাদ্দ প্রস্তাব করা হয়েছে। কারণ বিশ্বব্যাপী খাদ্য উৎপাদন প্রায় ২০ শতাংশ কম হয়েছে। দাম বৃদ্ধিরও আশঙ্কা রয়েছে।"
"অন্যদিকে, ডলারের বিনিময় হার বেড়েছে। প্রয়োজন হলে যাতে ব্যয় করার সুযোগ থাকে, সেজন্য এই বরাদ্দ প্রস্তাব করা হয়েছে।"
"দেশে খাদ্য সরবরাহের কোনো ঘাটতি হবে না। অভ্যন্তরীণ উৎপাদন ভালো হয়েছে। এরপরও যদি প্রয়োজন হয়, সরকার সরবরাহ নিশ্চিত করবে," যোগ করেন তিনি।
স্থানীয় উৎস থেকে খাদ্য সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা
৬ মে খাদ্য মন্ত্রণালয় চলতি বোরো মৌসুম থেকে ৫ লাখ টন ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ঘোষণা করেছে। প্রতি কেজি বোরো ধান সরকার ৩২ টাকা দরে সংগ্রহ করবে। গত ৭ মে থেকে শুরু হয়ে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত চলবে ধান সংগ্রহ।
একইসময়ে প্রতিকেজি ৩৪ টাকা দরে সরকার সারাদেশ থেকে ৫০,০০০ টন গম সংগ্রহের পরিকল্পনা ঘোষণা করেছে। এছাড়া, প্রতিকেজি ৪৫ টাকা দরে বোরো মৌসুমে ১১ লাখ টন সিদ্ধ চাল সংগ্রহ করবে সরকার। প্রতি কেজি ৪৪ টাকা দামে এক লাখ টন আতপ চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে বোরো মৌসুমে সরকার সবচেয়ে বেশি ধান-চাল সংগ্রহ করে থাকে। এ বছর বোরো মৌসুমে সারাদেশে ৩.২০ কোটি টন ধান উৎপাদন হবে বলে আশা করছে খাদ্য মন্ত্রণালয়। আমন মৌসুম থেকেও সরকার ধান চাল সংগ্রহ করে, তবে পরিমাণ বোরো মৌসুমের অর্ধেকের কম হয়।
২০২৩ সালের বোরো মৌসুমে সরকারের দেশ থেকে ৪ লাখ টন ধান, ১৪ লাখ ৫০ হাজার টন সিদ্ধ চাল ও ১ লাখ টন গম সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ছিল। ৫ মে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী— সরকারের গুদামগুলোতে ১১,০৪,২৭৬ টন খাদ্য মজুদ রয়েছে। এরমধ্যে ৭,৪৯,৭৬৯ টন চাল বাকি ৩,৫৪,৫০৭ টন ধান।
কমবে খাদ্য সংগ্রহ ব্যবস্থাপনার পরিচালন ব্যয়
এদিকে, আগামী অর্থবছরে খাদ্য সংগ্রহ ব্যবস্থাপনায় পরিচালন ব্যয় কম হবে বলে প্রাক্কলন করেছে খাদ্য মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয় এ খাতে আগামী অর্থবছরে ১,২৪৫ কোটি টাকা বরাদ্দ প্রস্তাব করেছে। চলতি বছরে যেখানে এ খাতে ১,৪৮৩ কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে।
তবে আগামী অর্থবছরে খোলাবাজারে খাদ্যশস্য বিক্রির (ওএমএস) জন্য খাদ্য মন্ত্রণালয়ের বাজেট বরাদ্দ ৩০৮ কোটি টাকা বাড়ছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ওএমএসের মাধ্যমে স্বল্প মূল্যে চাল ও আটা বিক্রির জন্য ৫,৩১৬ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হচ্ছে, যা চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে ছিল ৫,০০৮ কোটি টাকা।
সারাদেশে ওএমএস কার্যক্রম সম্প্রসারণ করা হচ্ছে। বর্তমানে বিভিন্ন শহরে ৪০০ কেন্দ্রে ওএমএস কার্ডের মাধ্যমে পণ্য বিক্রি হচ্ছে। ওএমএস এবং খাদ্যবান্ধব কর্মসূচিতে সরকার কম দামে চাল ও আটা সরবরাহ করে থাকে।
খাদ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, এ পর্যন্ত সারাদেশে প্রায় ১০ লাখ ওএমএস কার্ড ইস্যু করা হয়েছে। সচিবালয় থেকে যারা ওএসএমের পণ্য কেনেন, তাদের জন্য স্মার্ট ওএমএস কার্ড চালু করা হচ্ছে। প্রাথমিকভাবে ৬,০০০ স্মার্ট কার্ড ইস্যু করা হবে বলে খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে। তবে ধাপে ধাপে সচিবালয় ওএমএস সেন্টারের জন্য ১৫,০০০ কার্ড ইস্যু করবে।
এই কার্ডে একজন গ্রাহক সপ্তাহে একবার প্রতিকেজি ৩০ টাকা দরে ৫ কেজি চাল ও প্রতিকেজি ২৪ টাকা দরে ৪ কেজি আটা কিনতে পারবেন।
আর খাদ্য বান্ধব কর্মসূচিতে সরকার সারা দেশে ৫০ লাখ পরিবারকে ছয় মাস ৩০ কেজি করে চাল ১৫ টাকা দরে দিয়ে থাকে। এতে সরকারকে ভর্তূকি দিতে হয়। অর্থ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, আগামী অর্থবছরে খাদ্য ভর্তূকি বাবদ প্রায় ৭,০০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হতে পারে।
খাদ্য সচিব বলেন, ওএমএস সকলের জন্য উন্মুক্ত। তবে এই কর্মসূচিকে একটি নিয়মের মধ্যে আনার জন্য কার্ড প্রচলন করা হয়েছে। ধীরে ধীরে সবক্ষেত্রেই স্মার্ট কার্ড চালু করা হবে।
তিনি বলেন, "একটি কার্ড থেকে একটি পরিবার সপ্তাহে একবার চাল ও আটা নিতে পারবে। সাথে খাদ্য বান্ধব কর্মসূচিতে যারা আছেন, তারা যাতে সম পর্যায়ের অন্য কর্মসূচিতে না থাকেন– সেই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এ উদ্যোগের ফলে প্রায় তিন লাখ সুবিধাভোগী কমে গেছে। পরে যে এলাকা থেকে যতজন কর্মসূচি থেকে বের হয়ে গেছেন, সেই এলাকা থেকে ততজনকে অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে।"
খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার উদ্যোগে জোর দেওয়ার আহ্বান
অর্থনৈতিক রিপোর্টারদের সংগঠন ইকোনোমিক রিপোর্টার্স ফোরাম আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে ৭ মে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য চলমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার উদ্যোগে সবচেয়ে জোর দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।
তিনি বলেছেন, "এ বছর ফসল ভালো হয়েছে। সরকারকে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। মজুদ বাড়াতে হবে। খোলা বাজারে বিক্রি বাড়াতে হবে। এই কর্মসূচি মফস্বলে নিয়ে যেতে হবে। ফ্যামিলি কার্ডের মাধ্যমে যাদের সুবিধা দেওয়া হচ্ছে তাদের তালিকা প্রকাশ করতে হবে– যাতে যারা এ সুবিধা পাচ্ছে, তারা উপযুক্ত কিনা তা স্থানীয় মানুষ যাচাই করতে পারে।"