বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোর জন্য কর অবকাশের সুবিধা বহাল থাকতে পারে
বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগকারীদের জন্য কর অবকাশ সুবিধা বাতিলের আগের সিদ্ধান্ত থেকে পিছিয়ে আসতে পারে সরকার। ইজেডগুলোয় স্থানীয় ও বিদেশী বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতেই এমনটা করার সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানান জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর্মকর্তারা।
তাঁরা বলেছেন, চলতি মাসের শুরুতে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে কর অবকাশ সুবিধা প্রত্যাহার করে নেওয়ার ঘোষণা দিলে – ইজেডের বিনিয়োগকারীরা ব্যাপকভাবে হতাশা ও ক্ষোভ ব্যক্ত করেছেন; সেই পরিপ্রেক্ষিতে এই সিদ্ধান্তটি এখন পুনর্বিবেচনা করা হচ্ছে।
তবে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে এনবিআর চেয়ারম্যানের সাক্ষাতের পর এবিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
কর অব্যাহতির সুবিধা বাতিলের সিদ্ধান্ত থেকে সরকারের সম্ভাব্য পিছিয়ে আসার পরিকল্পনাকে স্বাগত জানিয়েছেন বিনিয়োগকারীরা। তাঁরা বলেছেন, নাহলে বিনিয়োগকারীদের আস্থার ক্ষতি হবে।
বর্তমানে কার্যক্রম শুরুর প্রথম বছর থেকে শুরু করে এক দশক ধরে ২০ থেকে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত কর অব্যাহতির সুবিধা পাচ্ছেন অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোর (ইজেড) বিনিয়োগকারীরা। প্রস্তাবিত বাজেটে সরকারি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত ইজেডগুলোর জন্য এসব সুবিধা অব্যাহত রাখা হলেও, বেসরকারি ইজেডের জন্য বাতিল করার কথা বলা হয়েছে।
কর্মকর্তারা ইঙ্গিত দিয়েছেন যে প্রস্তাবিত বাজেটে অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং হাইটেক পার্কগুলোর জন্য মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির উপর আরোপিত নতুন শুল্ক বাতিল হওয়ার সম্ভাবনা কম। একইসঙ্গে অর্থনৈতিক অঞ্চলের বিনিয়োগকারীদের জন্য আরও কিছু সুবিধা, যা প্রস্তাবিত বাজেটে বাতিল করা হয়েছিল, তাও পুনর্বহাল হওয়ার সম্ভাবনা কম।
টিবিএসের সাথে আলাপকালে নাম না প্রকাশের শর্তে এনবিআরের একজন কর্মকর্তা বলেন, "সরকারি ইকোনমিক জোনের বিনিয়োগকারীদের মত প্রাইভেট ইকোনমিক জোনের বিনিয়োগকারীরাও সমান সুবিধা পেতে পারেন। সেক্ষেত্রে তারা বর্তমানে যে ধরণের ট্যাক্স হলিডে (কর অবকাশের) সুবিধা পাচ্ছেন, একই সুবিধা বহাল থাকতে পারে – যার উদ্দেশ্য হলো বিনিয়োগ ত্বরান্বিত করা।"
"তবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে চেয়ারম্যানের (এনবিআর চেয়ারম্যান) সাক্ষাতের পর এটি চূড়ান্ত হবে" – বলেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে এনবিআর চেয়ারম্যানের সাক্ষাতের দিনক্ষণ এখনো চূড়ান্ত হয়নি বলে সূত্রগুলো জানিয়েছে।
এদিকে বেসরকারি ইজেডগুলোয় কর অব্যাহতির সুবিধা বাতিলের সিদ্ধান্ত থেকে সরকারের পিছিয়ে আসার পরিকল্পনাকে স্বাগত জানালেও– বিনিয়োগকারীরা প্রস্তাবিত বাজেটে বাতিল হওয়া অন্যান্য সুবিধা পুনর্বহালের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন।
অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং হাইটেক পার্কের জন্য মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানিতে শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত বাতিলের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তাঁরা।
বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং অর্থনৈতিক অঞ্চলের একজন বিনিয়োগকারী– রূপালী চৌধুরী টিবিএসকে বলেন, বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে বিনিয়োগের সময় ইনভেস্টরদের আশ্বস্ত করা হয়েছিল যে, তাঁরা কর অবকাশের সুবিধা পাবেন। এখন যদি হঠাৎ করে ট্যাক্স আরোপ করা হয়, তাহলে তা বিনিয়োগকারীদের কনফিডেন্স কমিয়ে দিবে।"
রুপালী চৌধুরী, বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সংগঠন– ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফআইসিসিআই বা ফিকি) এর-ও সাবেক সভাপতি। তিনি মনে করেন, একই কোম্পানির নতুন ইউনিটের বিনিয়োগে কর সুবিধা প্রত্যাহার এবং মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানিতে শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত থেকেও সরে আসা উচিত।
দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন– ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফবিসিসিআই) এর পক্ষ থেকেও ইজেডের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর উপর করারোপ বাতিলের অনুরোধ জানিয়ে রোববার (২৩ জুন) অর্থমন্ত্রীকে একটি চিঠি পাঠানো হয়েছে।
এছাড়া সংসদে প্রস্তাবিত বাজেট পেশের পর অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগকারীদের সংগঠন– বাংলাদেশ ইকোনমিক জোন ইনভেস্টরস অ্যাসোসিয়েশন (বেজিয়া) অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে বিদ্যমান কর-সুবিধাগুলো বহাল রাখার দাবি জানিয়েছিল।
এফবিসিসিআই সভাপতি মো. মাহবুবুল আলম বলেন, "নতুন কর আরোপ থেকে সরে আসার পরিকল্পনা একটি গুড মুভ। একই সঙ্গে ক্যাপিটাল মেশিনারি ইমপোর্টে বিদ্যমান শূন্য শুল্ক হারের সুবিধাও অব্যাহত থাকা উচিত।"
"আমরা বিদেশী বিনিয়োগকারীদের এখানে (বাংলাদেশে) বিনিয়োগ করতে বলি। কিন্তু, এসব সুবিধা না থাকলে তো স্থানীয় বা বিদেশী বিনিয়োগ আসতে চাইবে না" – বলেন তিনি।
দেশে সরকার ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল (ইজেড) প্রতিষ্ঠার কার্যক্রম হাতে নিয়েছে, যার মধ্যে ইতোমধ্যে ৯৭টি ইজেড অনুমোদন পেয়েছে। এগুলোর মধ্যে ৬৮টি সরকারি এবং ২৯টি বেসরকারি মালিকানাধীন। এসব অর্থনৈতিক অঞ্চলে প্রায় ২৯ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার আশা করছে সরকার।
বর্তমানে ১১টি ইজেড উৎপাদনে এসেছে, যার মধ্যে তিনটি সরকারি এবং ৮টি বেসরকারি। এর বাইরে, দেশে হাইটেক পার্ক রয়েছে ১৩টি।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা) এর তথ্য অনুযায়ী, ইতোমধ্যে অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে বিনিয়োগ এসেছে ৬০০ কোটি ডলারের উপরে, এবং কর্মসংস্থান হয়েছে ৬০ হাজার মানুষের।
প্রস্তাবিত বাজেটে যেসব সুবিধা বাতিল করা হয়
বর্তমানে কার্যক্রম শুরুর প্রথম বছর থেকে শুরু করে এক দশক ধরে কর অব্যাহতির সুবিধা পাচ্ছেন ইজেডগুলোর বিনিয়োগকারীরা। এরমধ্যে প্রথম তিন বছর তাঁরা সম্পূর্ণ কর মওকুফ পান, এরপর চতুর্থ বছরে ৮০ শতাংশ, পঞ্চম বছরে ৭০ শতাংশ এবং ষষ্ঠ বছরে ৬০ শতাংশ হারে এই সুবিধা পান। কর মওকুফের এই হার প্রতিবছর ১০ শতাংশ হারে কমে দশম বছরে ২০ শতাংশ নেমে আসে।
তবে বেসরকারি ইজেড এর ক্ষেত্রে এ সুবিধা বাতিলের প্রস্তাবের ফলে, কোম্পানিগুলোর আয়ের উপর সাধারণ কর হার ২০ শতাংশ থেকে ২৭.৫ শতাংশ বা তারও বেশি প্রযোজ্য হওয়ার কথা।
এছাড়া, অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোয় কারিগরি সহায়তাকারী হিসেবে কর্মরত বিদেশীরা, চাকুরিতে নিযুক্ত হওয়ার পর থেকে প্রথম তিন বছর তাঁদের বেতনের ওপর ৫০ শতাংশ আয়কর ছাড় পান। কিন্তু, আগামী অর্থবছর থেকে আর এ সুবিধাটিও বাতিলের কথা বলা হয়েছে প্রস্তাবিত বাজেটে।
এছাড়া, প্রস্তাবিত বাজেটে সরকারি ইজেডগুলোতে কেবল একই প্রতিষ্ঠানের একাধিক ইউনিট স্থাপনে কর অবকাশের সুবিধাও বাতিল করা হয়। অর্থনৈতিক অঞ্চলে অবস্থিত শিল্পের মূলধনী যন্ত্রপাতি, খুচরা যন্ত্রাংশ আমদানিতে শুল্ক অব্যাহতির সুবিধা বাতিল করে কমপক্ষে ১ শতাংশ বা তারও বেশি শুল্ক আরোপের প্রস্তাবও করা হয়।
অর্থনৈতিক অঞ্চল নির্মাণ বা উন্নয়নের যন্ত্রপাতি আমদানির শুল্ক সুবিধাও বাতিল করা হয়। এছাড়া ইজেড এ বিদেশী বিনিয়োগকারীদের জন্য শুল্কমুক্ত গাড়ি আমদানির সুবিধা বাতিল করা হয়। এসব অঞ্চলে স্থাপিত কোম্পানির ১০ বছরের জন্য লভ্যাংশ, মূলধনী আয়, রয়্যালটি, টেকনিক্যাল নো-হাউ এবং কারিগরি সহায়তা ফি'র উপরও ১০ বছরের কর অব্যাহতি ছিল, এগুলোও আগামী অর্থবছরের বাজেটে বাতিল হওয়ার প্রস্তাব রয়েছে।
দেশের একটি শীর্ষ শিল্পগোষ্ঠী মেঘনা গ্রুপ চারটি বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চল (ইজেড) প্রতিষ্ঠা করেছে। মেঘনা গ্রুপের মহাব্যবস্থাপক (অ্যাকাউন্টস) সুমন ভৌমিক টিবিএসকে বলেন, "ট্যাক্সের অনেক সুবিধা বাতিলের পর কিছু সুবিধা ফিরিয়ে আনা হলে তা ইতিবাচক উদ্যোগ বটে, তবে এতে বিনিয়োগকারীদের আস্থা আগের মত ফিরবে না।"
"যেসব সুবিধা রয়েছে, তা বহাল রাখা এবং ভবিষ্যতে যে থাকবে– সেবিষয়ে এনবিআরকে গ্যারান্টি দিতে হবে। এ ধরনের নিশ্চয়তা ছাড়া আস্থা ফিরবে না। বাজেটে ঢালাওভাবে সব সুবিধা তুলে নেওয়ার পর আমাদের বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আর মুখ দেখাতে পারি না" –বলেন তিনি।
সুবিধা প্রত্যাহারের কারণ
বাংলাদেশকে দেওয়া ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের একটি শর্ত হিসেবে কর অব্যাহতি কমিয়ে কমিয়ে আনতে বলেছিল আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। এরপর থেকে গত দেড় বছর ধরে নিয়মিত এসব শর্ত পরিপালন মনিটরিং করে আসছে সংস্থাটি।
আইএমএফের শর্তের সাথে সামঞ্জস্য রেখে, বেশকিছু খাতে গত দুই বছর ধরে পর্যায়ক্রমে কর অব্যাহতি কমিয়ে আসছে এনবিআর।
এনবিআরের তথ্যমতে, ২০২১-২২ অর্থবছরে ইজেড ও হাইটেক পার্কগুলো সামষ্টিকভাবে প্রায় ৪ হাজার ২২ কোটি টাকার কর অব্যাহতি পেয়েছে।
এনবিআরের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা টিবিএসকে বলেন, "বাংলাদেশের এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের প্রস্তুতির অংশ হিসেবে কর অব্যাহতি কমানোর চাপ রয়েছে। আবার আইএমএফ টিমও কর অব্যাহতি কমিয়ে আনার পরামর্শ দিয়েছে। এসব কারনে এবার কিছু খাতের অব্যাহতি যৌক্তিক করা হয়েছে।"
"তবে ঢালাওভাবে সব অব্যাহতি কমানো বা বাতিল করা হয়নি"- বলে জানান তিনি।