কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চাপে এস আলম গ্রুপের ঋণের ২,৩২০ কোটি টাকা মওকুফ করে ন্যাশনাল ব্যাংক
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাপে আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠ এস আলম গ্রুপ ও তার স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক ঋণের ২,৩১০ কোটি টাকা সুদ মওকুফ করতে বাধ্য হয় বেসরকারিখাতের ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেড।
ফলে ঋণের সুদাসলের অর্ধেকেরও কম টাকা দায়মুক্তি নিয়েছে ব্যাংকখাতে অনিয়মের জন্য আলোচিত চট্টগ্রামভিত্তিক গ্রুপটি।
এস আলম গ্রুপের ৮টি কোম্পানি ন্যাশনাল ব্যাংক থেকে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন মেয়াদে মোট ১৩টি ঋণ নিয়েছে। ২০২১ সালের ডিসেম্বর শেষে এসব ঋণের স্থিতি দাঁড়ায় ৪,৬১৯ কোটি টাকা।
২০২১ সালের ২২ ডিসেম্বর এস আলম গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নেওয়া ঋণের সুদ মওকুফ করে অবশিষ্ট ঋণ পুনঃগঠন করার পরামর্শ দিয়ে ন্যাশনাল ব্যাংকের তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) চিঠি দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। ঋণ গ্রহণকারী প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠানের জন্য পৃথক চিঠি পাঠানো। এ ধরনের প্রায় ৬টি চিঠি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের নজরে এসেছে।
চিঠিতে সুদ মওকুফের পরামর্শ দিয়ে বলা হয়েছে, 'ঋণ হিসাবগুলোর সুদ মওকুফের পর গ্রাহকের বিদ্যমান সকল ঋণ হিসাবের অবশিষ্ট বকেয়া স্থিতি ৩১ ডিসেম্বর ২০২২ তারিখের মধ্যে এককালীন সমন্বয় করতে হবে।'
এতে আরও বলা হয়, 'ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে এই সুদ মওকুফ ও অবশিষ্ট ঋণস্থিতি একালীন সমন্বয় সুবিধা অনুমোদনের পর তা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সমন্বয় না হলে আলোচ্য সুদ মওকুফ ও এককালীন সমন্বয় সুবিধা বাতিল মর্মে গণ্য হবে।'
বাংলাদেশ ব্যাংকের লিখিত পরামর্শ ও উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের মৌখিক নির্দেশনায় ন্যাশনাল ব্যাংক ২০২২ সালের ২৬ ডিসেম্বর এক অর্ডারে এস আলম গ্রুপ ও তার স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ১৩টি ঋণের সুদ বাবদ ২,৩১০ কোটি টাকা মওকুফ করে বলে জানান ন্যাশনাল ব্যাংকের কর্মকর্তারা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ন্যাশনাল ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও মো. তৌহিদুল আলম খান টিবিএসকে বলেন, "ওই সময় আমি দায়িত্বে ছিলাম না। ফলে কীভাবে গ্রুপটির এত টাকার সুদ মওকুফ হয়েছে, তা আমার জানা নেই।"
এস আলম গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নেওয়া ঋণ ও সুদ মওকুফের নথিপত্র বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, কোনো কোনো ক্ষেত্রে ঋণস্থিতির পরিমাণের চেয়েও বেশি অর্থ মওকুফ করা হয়েছে। ফলে এক প্রতিষ্ঠানের ঋণ নেগেটিভ করে অন্য প্রতিষ্ঠানের নেওয়া ঋণের পরিমাণ কমানো হয়েছে।
ন্যাশনাল ব্যাংক থেকে নেওয়া ফেইরি ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল নামের একটি প্রতিষ্ঠানের ঋণস্থিতির পরিমাণ ছিল ৩৭.৬৩ কোটি টাকা। কিন্তু ঋণ সুদ মওকুফ করা হয়েছে ৪১.৫৬ কোটি টাকা। অর্থাৎ, ঋণস্থিতির তুলনায় অতিরিক্ত ৩.৯২ কোটি টাকা মওকুফ সুবিধা পেয়েছে এস আলম গ্রুপের এই প্রতিষ্ঠান, যা অন্য ঋণ থেকে সমন্বয় করেছে গ্রুপটি।
একইভাবে এস আলম ব্রাদার্স লিমিটেড কোম্পানির ঋণ স্থিতির পরিমাণ ছিল ৩৮.১৩ কোটি টাকা। কিন্তু ন্যাশনাল ব্যাংক মওকুফ করেছে ৪০.৩২ কোটি টাকা। এক্ষেত্রেও অতিরিক্ত ২.১৯ কোটি টাকা মওকুফ করা হয়েছে।
এ বিষয়ে কথা বলতে ও বক্তব্য জানতে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মো. মেজবাউল হকের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। এসএমএস দেওয়া হলেও কোনো সাড়া পাওয়া যানি।
ন্যাশনাল ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা জানান, এই ঋণ দুটি দীর্ঘমেয়াদি ঋণ ছিল। এস আলম গ্রুপ আগে যেসব কিস্তি পরিশোধ করেছিল, সেগুলো ব্যাংক ইন্টারেস্ট হিসেবে গ্রহণ করে। ঋণস্থিতির তুলনায় ঋণের প্রিন্সিপাল অ্যামাউন্টের (মূল টাকা) পরিমাণ কমে যায়। এ কারণে পুরো সুদ মওকুফ করতে গিয়ে ঋণস্থিতির চেয়ে বেশি মওকুফ করতে হয়।
ব্যাংকটির ঊর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে টিবিএসকে বলেন, "বাংলাদেশ ব্যাংকের চাপে পড়ে ন্যাশনাল ব্যাংক এস আলম গ্রুপের ঋণের এই বিপুল পরিমাণ সুদ মওকুফ করতে বাধ্য হয়। অথচ মওকুফ করা সুদের বিপরীতে ব্যাংককে কর দিতে হয়েছে, আমানতকারীদের সুদ দিতে হয়েছে। আর বিপুল পরিমাণ সুদ মওকুফ করায় শেয়ারহোল্ডাররা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।"
তিনি বলেন, "ন্যাশনাল ব্যাংকের মতো এত বড় ব্যাংক হঠাৎ করেই অর্থ সংকটে পড়েনি। দীর্ঘদিন ধরে আওয়ামী লীগ সরকার ঘনিষ্ঠ প্রভাবশালী ব্যবসায়ী ও শিকদার পরিবার বাংলাদেশ ব্যাংকের সহায়তায় ন্যাশনাল ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ ঋণের নামে বের করে নিয়েছে। সেসব ঋণ দীর্ঘদিন ধরে ফেরত না দেওয়ার পর এভাবে পুরো সুদ মওকুফ করে নিয়েছে। এতেই ব্যাংকটি ধ্বসে পড়ে।