বেক্সিমকো সুকুক ও আইএফআইসি আমার বন্ডসহ অন্যান্য শেয়ার কারসাজি তদন্তে কমিটি গঠন
সালমান এফ রহমানের মালিকানাধীন বেক্সিমকো সুকুক ও শ্রীপুর টাউনশীপের বন্ডসহ বিগত সময়ে পুঁজিবাজারের অনিয়ম, কারসাজি ও দুর্নীতি উদঘাটনে একটি অনুসন্ধান ও তদন্ত কমিটি গঠন করেছে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।
চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের কৌশলগত বিনিয়োগকারী হিসাবে বসুন্ধরা গ্রুপের প্রতিষ্ঠান এবিজি লিমিটেডের বাছাই, স্টক এক্সচেঞ্জের শেয়ার অধিগ্রহণ ও মূল্য নির্ধারণের বিষয়ও অনুসন্ধান করবে কমিটি। এছাড়া বেস্ট হোল্ডিংস লিমিটেডসংক্রান্ত আইপিও অনুমোদন ও ইস্যু-সংক্রান্ত যাবতীয় বিষয়ও অনুসন্ধান করা হবে।
টেরা রিসোর্সেস ইন্টারন্যাশনালের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান এবং কনসালট্যান্ট জিয়া ইউ আহমেদকে তদন্ত কমিটির প্রধান করা হয়েছে। কমিটি প্রথম ধাপে ১২টি বিষয়ে অনুসন্ধান করে ৬০ দিনের মধ্যে কমিশনে প্রতিবেদন দাখিল করবে।
কমিশনের চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
অনুসন্ধান ও তদন্ত কমিটির অন্যান্য সদস্যরা হলেন—সম্পদ এইমস অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টের সাবেক এমডি ইয়াওয়ার সাইদ, সাবেক এনবিআর সদস্য শফিকুর রহমান, ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল জিশান হায়দার এবং বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক আনোয়ারুল ইসলাম।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, কমিশন এই কমিটিতে প্রয়োজনবোধে নতুন সদস্য অন্তর্ভুক্ত করতে পারবে।
বিএসইসির এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, আল-আমীন কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ, সোনালী পেপার অ্যান্ড বোর্ড মিলস, ফরচুন সুজ, একমি পেস্টিসাইডস, কোয়েস্ট বিডিসি ও এমারেল্ড অয়েল ইন্ডাস্ট্রিজ-এর পুঁজিাবাজারে অনিয়ম ও কারসাজি নিয়ে তদন্ত করবে কমিশন গঠিত অনুসন্ধান ও তদন্ত কমিটি।
এছাড়াও রিং শাইনস টেক্সটাইলসের প্রাইভেট ও পাবলিক অফারের মাধ্যমে উত্তোলন ও বার্ষিক প্রতিবেদনে অতিরঞ্জিত বিক্রি দেখানো এবং ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে অর্থ হস্তান্তর ও পাচারের বিষয়েও অনুসন্ধান করা হবে।
২০১০ সালের ধসের পর এম খায়রুল হোসেন ও শিবলী রুবাইয়াত উল ইসলাম বিএসইসির চেয়ারম্যান থাকাকালে এসব অনিয়ম ঘটে। দুজনেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স বিভাগের অধ্যাপক খায়রুল হোসেন বিএসইসিতে সবচেয়ে বেশি সময় দায়িত্ব পালন করা চেয়ারম্যান।
শিবলী রুবাইয়াত উল ইসলাম একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংকিং অ্যান্ড ইনস্যুরেন্স বিভাগের অধ্যাপক। তিনি ২০২০ সালে বিএসইসি চেয়্যারম্যান হিসাবে চার বছরের জন্য নিয়োগ পান। প্রথম দফায় মেয়াদ শেষ হওয়ার পর দ্বিতীয় মেয়াদে আবারও চার বছরের জন্য নিয়োগ পেয়েছিলেন।
তবে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত ১০ আগস্ট তিনি পদত্যাগ করেন।
এই দুই কমিশনের সময় পুঁজিবাজারের বিভিন্ন অনিয়ম হলেও কঠোর কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। দুর্বল কোম্পানির আইপিও অনুমোদনের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা মূলধন উত্তোলনের সুযোগ দেওয়া হয়েছে।
এতে পুঁজিবাজারের সার্বিক উন্নয়ন তো হয়নি, বরং শেয়ার কারসাজি ও অনিয়মের কারণে পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকারীর আস্থা নষ্ট হয়েছে বলে অভিযোগ বাজারসংশ্লিষ্টদের।
বেক্সিমকোর ৩ হাজার কোটি টাকার সুকুক বন্ড
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের বেক্সিমকো লিমিটেডকে শরিয়াহভিত্তিক সুকুক বন্ডের মাধ্যমে ৩ হাজার কোটি টাকা মূলধন উত্তোলনের সুযোগ দিয়েছে কমিশন।
দেশে প্রথমবারের মতো চালু করা নতুন আর্থিক উপকরণ সুকুক বন্ডে বিনিয়োগ করতে ব্যাংকগুলোকে বাধ্য করা হয়েছিল।
এর আগে ২০২১ সালে বেক্সিমকো তাদের দুটি সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্রে অর্থায়ন ও টেক্সটাইল বিভাগের সম্প্রসারণের জন্য ৩ হাজার কোটি টাকার সুকুক বন্ড ছাড়ে।
পরে বেক্সিমকো বাংলাদেশ ব্যাংককে ব্যবহার করে একটি সার্কুলার জারি করিয়ে নেয়। এর মাধ্যমে ব্যাংকগুলোকে পুঁজিবাজারের বিশেষ তহবিল থেকে সুকুক বন্ডে বিনিয়োগ করার অনুমতি দেওয়া হয়, যা পুঁজিবাজারের এক্সপোজার থেকে বাদ দেওয়া হবে।
ব্যাংকিং আইন অনুযায়ী, ব্যাংকগুলো তাদের মূলধনের ২৫ শতাংশ স্টকে বিনিয়োগ করতে পারে।
কিন্তু গত জাতীয় নির্বাচনের কয়েক মাস আগে সালমান এফ রহমান তার নতুন রিয়েল এস্টেট কোম্পানি শ্রীপুর টাউনশিপ লিমিটেডের (এসটিএল) অনুকূলে ১ হাজার কোটি টাকার 'আইএফআইসি আমার বন্ড' ইস্যু করিয়ে নেন। আমার বন্ডের গ্যারান্টি দিয়েছে আইএফআইসি ব্যাংক। সালমান আইএফআইসি ব্যাংকের চেয়ারম্যানও।
বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস-চেয়ারম্যান এবং পরে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়া সালমান গত ১৩ আগস্ট গ্রেপ্তার হন। ব্যক্তিগত লাভের জন্য তার সরকারি পদের ব্যবহার নিয়ে ব্যাপক বিতর্কের জন্ম দেন সালমান।
বসুন্ধরার এবিজি নিয়েও হবে তদন্ত
২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে এবিজি লিমিটেডকে কৌশলগত অংশীদার করার জন্য চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ (সিএসই) থেকে একটি প্রস্তাব অনুমোদন করে বিএসইসি।
অন্যতম শীর্ষস্থানীয় শিল্পগোষ্ঠী বসুন্ধরা গ্রুপের প্রতিষ্ঠান এবিজি লিমিটেড সিএসইর ২৫ শতাংশ শেয়ার কিনেছে, যার মূল্য ২৪০ কোটি টাকা। প্রতিটি শেয়ারের দর ১৫ টাকা।
ওই বছরের আগস্টে সিএসই এই লেনদেনের অনুমোদনের জন্য বিএসইসির কাছে আবেদন করে।
২০২২ সালের আগে ক্রিকেট তারকা সাকিব আল হাসান তার দুটি প্রতিষ্ঠান ও সহযোগীদের মাধ্যমে ওটিসি প্ল্যাটফর্মে তালিকাভুক্ত কোম্পানি আল-আমীন কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজের স্পন্সর ও পরিচালকদের কাছ থেকে ৪৮.১৭৫ শতাংশ শেয়ার অধিগ্রহণ করেছিলেন।
মোনার্ক মার্ট লিমিটেড ও মোনার্ক এক্সপ্রেস লিমিটেড যথাক্রমে ২.৪ শতাংশ ও ৪.৮ শতাংশ শেয়ার কিনে নিয়েছে।
আমিনুল ইসলাম সিকদার ও মো. খায়রুল বাশারের ইশাল কমিউনিকেশন লিমিটেড আল-আমীন কেমিক্যালের ১৪.৪ শতাংশ শেয়ার কিনেছে।
লাভা ইলেকট্রোডস ইন্ডাস্ট্রিজ ২.৪ শতাংশ, এএফএম রফিকুজ্জামান ১০ শতাংশ, মাশুক আলম ৬ শতাংশ ও মুন্সী শফিউদ্দিন ৮.১৭৫ শতাংশ শেয়ার কিনেছেন।
কোম্পানিটি বিএসইসির সম্মতি ছাড়াই বিভিন্ন আইন ও বিধি লঙ্ঘন করে ২৫ কোটি টাকা সংগ্রহ করেছে। এসব নিয়ম লঙ্ঘন চিহ্নিত হওয়ার পর কোম্পানিটির ওটিসি বোর্ড থেকে এসএমই বোর্ডে তালিকাভুক্তির আবেদন প্রত্যাখ্যান করে ডিএসই। পরে বিএসইসি মূলধন তোলার জন্য পোস্ট-ফ্যাক্টো অ্যাপ্রুভাল দেয়।
ফরচুন সুজের শেয়ার নিয়ে কারসাজি, অনিয়ম, ঘোষিত লভ্যাংশ বিতরণে ব্যর্থতা ও কৃত্রিমভাবে কোম্পানিটির শেয়ারদর বৃদ্ধিতে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধেও অনুসন্ধান করবে তদন্ত কমিটি।
কোয়েস্ট বিডিসির মালিকানা পরিবর্তন নিয়েও অনিয়ম খুঁজে পেয়েছে ডিএসই। এরপর কোম্পানিটি এসএমই বোর্ডে তালিকাভুক্তির আবেদন করলে সেটি বাতিল করে স্টক এক্সচেঞ্জ।
এমারেল্ড অয়েলের মালিকানা পরিবর্তনের পর শেয়ার নিয়ে কারসাজির ঘটনাও ঘটে। আগের মালিকদের থেকে জাপানি কোম্পানি মিনোরি বাংলাদেশ কোম্পানিটি অধিগ্রহণ করে।
স্পন্দন ব্র্যান্ডের ভোজ্য তেল উৎপাদনকারী কোম্পানির মালিকানায় পরিবর্তনের পর উৎপাদনে ফিরলেও এখন গ্যাস সংকটের কারণে উৎপাদন বন্ধ রয়েছে।
ইউনুস গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান সোনালী পেপার অ্যান্ড বোর্ড মিলস দীর্ঘদিন ওটিসি মার্কেটে থাকলেও শিবলী কমিশনের সময় কোম্পানিটির লেনদেন মূল মার্কেটে ফেরানো হয়।
এরপর থেকে কোম্পানিটির শেয়ার দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়তে থাকে। এ বিষয়ে স্টক এক্সচেঞ্জ তদন্ত করলেও কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি শিবলী কমিশন।