গাজীপুরে শ্রমিক বিক্ষোভ ও ভাঙচুরের পেছনে ইন্ধনের অভিযোগ মালিকপক্ষের
গাজীপুরের বিভিন্ন শিল্প কারখানায় সাম্প্রতিক শ্রমিক অসন্তোষের কারণে কারখানার কর্মপরিবেশ নষ্ট হচ্ছে, ব্যাহত হচ্ছে উৎপাদন। ফলে রপ্তানিমুখী এসব কারখানার রপ্তানি কাজেও বিঘ্ন ঘটছে। এসব অসন্তোষের পেছনে কারখানার ভেতরের শ্রমিকদের চেয়ে বহিরাগত লোকদের ইন্ধন বেশী দায়ী বলে মনে করছেন মালিক ও কারখানা সংশ্লিষ্টরা।
তাদের অভিযোগ, সম্প্রতি শ্রমিক অসন্তোষের পেছনে ঝুট ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ ও শ্রমিক সংগঠনের সুবিধা প্রাপ্তি মূল উদ্দেশ্য। শ্রমিকদের ন্যায্য দাবি মেনে নিতে মালিকপক্ষ প্রস্তুত, কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে শ্রমিকদের দাবি মেনে নিলেও তারা শান্ত হচ্ছে না। তাদেরকে বাইরে থেকে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে।
সর্বশেষ গতকাল সোমবার গাজীপুর মহানগরীর টঙ্গী, কোনাবাড়ী ও কালিয়াকৈর এলাকায় বিভিন্ন শিল্প কারখানায় বিভিন্ন দাবিতে শ্রমিক বিক্ষোভ ও ভাংচুরের কারণে অর্ধশত শিল্প কারখানা ছুটি ঘোষণা করতে বাধ্য হয়েছিল কর্তৃপক্ষ।
শিল্প পুলিশ, কারখানা মালিক ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত ২১ আগস্ট থেকে গাজীপুরের বিভিন্ন এলাকায় শিল্প কারখানায় কখনো ১১ দফা, আবার কখনো ২১ দফা দাবি আদায়ের জন্য আন্দোলন করছেন শ্রমিকরা। এসব কারখানার মধ্যে তৈরি পোশাক কারখানা, ঔষধ কারখানা ও চামড়াজাত দ্রব্য উৎপাদনকারী কারখানা রয়েছে।
পোশাক কারখানা মালিকরা দাবি করেন, গেল বছরের ৮ নভেম্বরে পোশাক শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করা হয়। নিম্নতম মজুরি বোর্ড তখন সর্বনিম্ন শ্রমিক মজুরি ৮ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ১২ হাজার ৫০০ টাকা নির্ধারণ করে।
অর্থাৎ ১২ হাজার ৫০০ টাকা মজুরির মধ্যে মূল বেতন হবে ৬ হাজার ৭০০ টাকা। আর মূল বেতনের অর্ধেক হচ্ছে বাড়িভাড়া। এ ছাড়া খাদ্যভাতা ১ হাজার ২৫০ টাকা, চিকিৎসাভাতা ৭৫০ টাকা ও যাতায়াতভাতা ৪৫০ টাকা। প্রতিবছর মূল বেতনের ৫ শতাংশ হারে মজুরি বাড়বে। নতুন মজুরিকাঠামোতে সাতটি গ্রেডের বদলে পাঁচটি গ্রেড থাকবে। গত ১ ডিসেম্বর থেকে নতুন মজুরি কার্যকর হয়েছে এবং শ্রমিকরা তখন এসব সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছিল।
স্প্যারো অ্যাপারেলস লিমিটেড কারখানার ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বিজিএমইএ পরিচালক শোভন ইসলাম বলেন, "বৈষম্য বিরোধী আন্দোলন চলার সময় ইন্টারনেট বন্ধ থাকাসহ নানা কারণে আমাদের শিপমেন্ট নিয়ে সৃষ্ট জটিলতা কেটে গেছে। আমাদের বর্তমান প্রধান উপদেষ্টা নোবেল বিজয়ী ড. ইউনূসের ইমেজ কাজে লাগিয়ে গার্মেন্টস শিল্পে বিশ্বে ১ নম্বরে চলে যাব, কোনো শঙ্কা নেই। আমরা এখন পর্যন্ত কোনো অর্ডার বাতিলের খবর পাইনি। বিদেশি ক্রেতারা সবাই পজিটিভ। এমন সময়ে এ ধরনের আন্দোলন আমাদের এ শিল্পর জন্য খুবই ক্ষতিকর।"
২১ আগস্ট গাজীপুর মহানগরীর টঙ্গীতে বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড, টঙ্গীর সাতাইশ এলাকার প্রিন্স জ্যাকার্ড সোয়েটার লিমিটেড, টঙ্গীর বড় দেওড়া এলাকার মাইশা মীম এ্যাপারেলস লিমিটেড, মালেকের বাড়ি এলাকার টিএনজেড অ্যাপারেলস লিমিটেডে, গাজীপুরের চন্দ্রা এলাকার মাহমুদ জিন্স লিমিটেড, নাওজোড় এলাকায় মাস্টার চ্যান ইন্ডাস্ট্রিজের শ্রমিকরা বিভিন্ন দাবিতে কর্মবিরতি, বিক্ষোভ ও মহাসড়ক অবরোধ করেছিল।
পরে বিভিন্ন সময়ে আরো কয়েকটি কারখানায় আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। আরো যে সব কারখানায় আন্দোলন হয়েছিল সেসবের মধ্যে মহানগরীর গাছা থানা এলাকার ফুল ইভার বিডি লিমিটেড, দক্ষিণ সালনার ক্লোটেক্স এ্যাপারেল্স লিমিটেড, কোনাবাড়ী বিসিক এলাকার একতা নীট লিমিটেড, গাজীপুরের কালিয়াকৈরের ইবনে সিনা ফার্মাসিটিক্যালস, টঙ্গীর নুভিস্তা ফার্মা লিমিটেড, কালিয়াকৈর উপজেলার সূত্রাপুর এলাকার স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড, ইউনিহেলথ ফার্মাসিউটিক্যালসের শ্রমিকরা আন্দোলন করে।
মহানগরীর টঙ্গি এলাকায় পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, গত সোমবার সকালে নিজ নিজ কারখানায় কাজে যোগ দেন টঙ্গীর বিসিক এলাকার সব পোশাক কারখানার শ্রমিকেরা। সকাল সাড়ে নয়টার দিকে চাকরিচ্যুত কয়েকশ শ্রমিক কয়েক ধাপে ১১টি পোশাক কারখানার গেটে অবস্থান নেয়। কারখানায় কর্মরত শ্রমিকদের তাদের সঙ্গে আন্দোলনে যোগ দিতে আহ্বান জানায় তারা। এ সময় কারখানায় কর্মরত শ্রমিকেরা তাদের ডাকে সাড়া দিতে অস্বীকৃতি জানায়। এতে চাকরিচ্যুত শ্রমিকেরা ওই ১১টি কারখানায় ভাঙচুর চালায়। পরে ভাঙচুর এড়াতে ওই কারখানাগুলোতে ছুটি ঘোষণা করে কারখানা কর্তৃপক্ষ। এ সময় চাকরিচ্যুত অন্তত দুজন শ্রমিক আহত হয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে।
ছুটি ঘোষণা করা কারখানা গুলো হচ্ছে- টঙ্গীর বিসিক এলাকার লিমিটেড টসি নিট ফেব্রিক্স লিমিটেড, ন্যাশনাল কম্পোজিট লিমিটেড, পেট্রিয়ট ইকো এ্যাপারেল লিমিটেড, বেলিসিমা এ্যাপারেল্স লিমিটেড, জিন্স এন্ড পোলো লিমিটেড, টেঙ্গন গার্মেন্টস লিমিটেড, রেডিসন গার্মেন্টস লিমিটেড, সুমি এ্যাপারেলস লিমিটেড, আরবিএস গার্মেন্টস লিমিটেড, গার্ডেন টেক্সটাইল লিমিটেড ও তাজকিয়া এ্যাপারেলস লিমিটেড।
চাকরিচ্যুত শ্রমিক মো. রমজান হোসেন বলেন, "কারখানাগুলোতে চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে নারী শ্রমিকদের অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। বিভিন্ন কারখানার চাকরিতে থাকা শ্রমিকদের আমাদের আন্দোলনের যোগ দেওয়ার আহ্বান জানালেও আমাদের সঙ্গে যোগ দেয়নি। আমরা সড়কে বসে অবস্থান করছি। দাবি না মেনে নিলে কোনো গার্মেন্টসে শ্রমিকদের ঢুকতে দেওয়া হবে না।"
তাজকিয়া এ্যাপারেলস লিমিটেড কারখানার ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার (মানবসম্পদ) হেমায়েত উদ্দিন বলেন, সকালে বহিরাগতরা কারখানার সামনে জড়ো হয়ে কারখানার প্রধান ফটকে ভাঙচুর চালায়। ভাঙচুর ও ক্ষতি এড়াতে কারখানা ছুটি ঘোষণা করেছি।
কারখানার শ্রমিকরা জানায়, দীর্ঘদিন ধরে কারখানা কর্তৃপক্ষ তাদের বেতন ভাতাসহ বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা নিয়ে বৈষম্য করে আসছে। এসব বৈষম্যের প্রতিবাদে এবং ২১ দফা দাবিতে তারা আন্দোলন কর্মসূচির ঘোষণা দেন। ২১ দফার মধ্যে কয়েকটি দাবির মিল থাকলেও বিভিন্ন কারখানার শ্রমিকদের দাবি ভিন্ন ভিন্ন।
এসব দাবির মধ্যে রয়েছে, শ্রমিকরা নিজ নিজ কারখানার কয়েকজন কর্মকর্তার অপসারণ,পূর্বে ছাঁটাই করা শ্রমিককে চাকরিতে পুনর্বহাল করা, শ্রমিক ইউনিয়ন গঠন করা, ডিউটি টাইম ৮ঘন্টা নির্ধারণ, সর্বনিম্ন বেতন ২০ হাজার টাকা নির্ধারণ, যাদের বেতন ২০ হাজারের বেশী তাদের ২৫% ইনক্রিমেন্ট প্রদান, আন্দোলনরত শ্রমিকদের চাকরিচ্যুত না করা, সকল শ্রমিকের ফ্যামিলির মেডিকেল ভাতা প্রদান, সাপ্তাহিক ছুটি ২ দিন করা, হাজিরা বোনাস ১ হাজার টাকা চালু, দুই বছর পর চাকরি স্থায়ী কর, খাবারের মান উন্নত করা এবং খাবারের বিল ফ্রি করা, সকালের নাস্তা ও বিকেলের নাস্তা বিস্কুটের পরিবর্তে ভারি নাস্তা দেয়া, রমজান মাসে দুপুরের খাবার ও ইফতারি বিল দেয়া, দুই ঈদের ছুটি ৭ দিন করা, তিন বছর পর পর পদোন্নতি দেওয়া, কর্মরত অবস্থায় কোনো শ্রমিক আহত হলে তার চিকিৎসার সকল খরচ কোম্পানির বহন করা বাসা ভাড়া বাড়ানো, মোবাইল পাশ করতে হবে, অতিরিক্ত ছুটির টাকা দিতে হবে, লভ্যাংশ প্রতি বছর দিতে হবে।
শিল্প মালিকদের অনেকে শ্রমিকদের এসব দাবিকে অযৌক্তিক দাবি করে বলছেন, এসব তাদের আসল উদ্দেশ্য নয়। এসবের পেছনে অন্য কারণ আছে। গত ৫ আগস্ট হাসিনা সরকার পতনের পর গাজীপুরের বিভিন্ন এলাকার কারখানার ঝুট ব্যবসা নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের স্থানীয় নেতাকর্মীরা উঠেপড়ে লাগে। তারা বিভিন্ন কারখানার নিয়ন্ত্রণ নিতে মরিয়া হয়ে উঠে। এ নিয়ে অনেক কারখানায় হামলা ভাংচুরের ঘটনাও ঘটে। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদেরকে হটিয়ে ঝুট ব্যবসার একক নিয়ন্ত্রণ নিতে চায় তারা। এজন্যও কোথাও কোথাও শ্রমিক বিক্ষোভে উসকানি দেওয়া হচ্ছে।
গাজীপুরের কালিয়াকৈর এলাকার অবস্থিত দেশের একটি প্রথম সারির ঔষধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের মালিক পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, "দেশের ঔষধ শিল্পকে ধ্বংস করার জন্য একটি স্বার্থান্বেষী মহল এ শিল্পে অস্থিরতা সৃষ্টির জন্য ষড়যন্ত্র করছে। শ্রমিকরা যে সব দাবি করছে, তার অনেকগুলো আগে থেকেই পূরণ করা হয়েছে। অন্য দাবি গুলো অযৌক্তিক হওয়া সত্ত্বেও মেনে নেয়ার আশ্বাস দিলেও শ্রমিকরা শান্ত হচ্ছে না। তারা চাচ্ছে কারখানাগুলো বন্ধ হয়ে যাক। প্রশাসন ও সরকার যদি ঔষধ শিল্পের এ অস্থিরতা দুর করতে সহযোগিতা না করে তাহলে প্রতিষ্ঠান চালু রাখা কঠিন হয়ে পড়বে।"
তিনি আরো বলেন, "আপনি যদি আমার পরিচয় প্রকাশ করে দেন, তাহলে এমন হতে পারে আমার কারখানায় আগুন ধরিয়ে দেয়া হবে। তাহলে আমি আপনাকে দায়ী করবো।"
এসব বিষয়ে বিজিএমইএর সহ-সভাপতি নাসির উদ্দিন বলেন, "পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বিভিন্নজন নানা রকম স্বার্থ এবং সুযোগ নেওয়ার জন্য মালিকপক্ষের উপর চাপ সৃষ্টি করার জন্য এই শিল্পে অস্থিরতা সৃষ্টির চেষ্টা করছে। অনেকে জুট ব্যবসা নিয়ন্ত্রণের জন্য কারখানা মালিকের উপর চাপ সৃষ্টি করতে শ্রমিকদের আন্দোলনে উসকানি দিচ্ছে। আবার কোন কোন ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে যে শ্রমিক সংগঠন সুবিধা নেওয়ার জন্য শ্রমিকদের আন্দোলনের জন্য উসকানি দিচ্ছে। ফলে যেখানে যে উদ্দেশ্যে আন্দোলন হোক শ্রমিকদের দাবি মেনে নেওয়ার পরও দেখা যাচ্ছে শ্রমিকরা শান্ত হচ্ছে না। অনেক ক্ষেত্রে শ্রমিকরা দাবি আদায়ের শান্তিপূর্ণ পথ অবলম্বন না করে সরাসরি ভাঙচুর এর মত কাজ করছে। এসব কারণে এখন আমাদের দাবি হলো সরকার বা প্রশাসন শ্রমিকদের ন্যায্য দাবি নির্ধারণ করে আলোচনার মাধ্যমে জাতীয় দ্রুত নিষ্পত্তি করা যায় সেই ব্যবস্থা করা।
গাজীপুর শিল্প পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বলেন, "নানা রকম স্বার্থের কারণে সম্প্রতি শ্রমিক অসন্তোষের পেছনে বহিরাগতরা কাজ করছে। যারা আন্দোলন করছে, তারা শ্রমিকের বয়সী, কিন্তু তাদের অধিকাংশ শ্রমিক নয়। এসব বহিরাগতরা কেন কি উদ্দেশ্যে উসকানি দিচ্ছে, কারখানা ভাঙচুর করছে, এসব আপনারা মালিকদের সাথে কথা বলেন, জানতে পারবেন।"
তিনি আরো বলেন, "আজ মঙ্গলবারেও কয়েক স্থানে শ্রমিকদের বেশে সমস্যা সৃষ্টির চেষ্টা করা হয়েছে। তবে আমরা সমস্যা গুলো শুরুতেই নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছি।
গাজীপুর মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (অপরাধ) আহমার উজ্জামান বলেন, "মহানগরীর বিভিন্ন শিল্প কারখানার নিরাপত্তা অন্যান্য বাহিনীর সাথে পুলিশও কাজ করছে। এখন একটি বিশেষ সময়। তাই বিভিন্ন মহল তাদের স্বার্থ আদায়ের জন্য নানা কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামছে। শিল্প কারখানা গুলোতে শ্রমিকরা তাদের দাবি দাওয়া নিয়ে মাঠে নামে। আমরা তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করছি।"