মার্চ পর্যন্ত সার সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন রাখতে লাগবে ১.৭২ বিলিয়ন ডলার
চলতি আমন ও রবি মওসুমের চাহিদা মেটাতে নিরবচ্ছিন্ন সার সরবরাহ নিশ্চিত করতে আগামী মার্চের মধ্যে ১.৫২ বিলিয়ন ডলারের সার আমদানি করতে হবে বলে অর্থ মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছে শিল্প ও কৃষি মন্ত্রণালয়, যারা চাহিদা অনুযাযী ইউরিয়া ও নন-ইউরিয়া সারের জোগান নিশ্চিত করে থাকে।
এছাড়া সার আমদানির বকেয়া বিল পরিশোধ করতে আরও ১৭৯ মিলিয়ন ডলার জরুরি ভিত্তিতে চেয়েছে মন্ত্রণালয় দুটি।
বকেয়া বিল পরিশোধ না করলে বিদেশি সরবরাহকারীরা বাংলাদেশকে সার সরবরাহ করতে রাজি হচ্ছে না বলে গত ৫ সেপ্টেম্বর এক আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় জানিয়েছেন দুই মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।
সার আমদানির ক্ষেত্রে এলসি খোলা-সংক্রান্ত জটিলতা নিরসনে অর্থ সচিব ড. মো. খায়েরুজ্জামান মজুমদারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় এ তথ্য জানানো হয়েছে।
সভার কার্যবিবরণী অনুসারে, ডলার সংকটের কারণে একদিকে ব্যাংকগুলো সার আমদানির এলসি খুলছে না, অন্যদিকে বকেয়া বিল পরিশোধ না করায় বিদেশি সরবরাহকারীরাও বাংলাদেশকে সার সরবরাহ করতে রাজি হচ্ছে না।
আবার ব্যাংকে ডলার সংকটের পাশাপাশি বিদেশি ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে এলসি কনফার্মেশন না পাওয়ায় বেসরকারি খাতের সার আমদানিকারকরাও এবার সার আমদানি করতে পারছেন না।
এমন পরিস্থিতি তুলে ধরে গত মাসে অর্থ মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়ে অক্টোবর থেকে সার সরবরাহে সংকট দেখা দেওয়ার আশঙ্কা তুলে ধরেছে কৃষি মন্ত্রণালয়। তার পরিপ্রেক্ষিতে সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নেয় অর্থ মন্ত্রণালয়।
সভায় নিরবচ্ছিন্ন সার সরবরাহ নিশ্চিত করতে আগের আমদানির বকেয়া বিল পরিশোধ এবং আগামী মার্চ পর্যন্ত সার আমদানি অব্যাহত রাখতে বাংলাদেশ ব্যাংককে নির্দেশনা দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এতে বলা হয়েছে, সার আমদানির জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার সরবরাহ নিশ্চিত করতে লিকুইডিটি সাপোর্ট বা অনুরূপ পন্থায় সার বাবদ এলসি দায় পরিশোধের ব্যবস্থা করবে।
এছাড়া, সার আমদানির এলসি খোলার জন্য ইসলামী ব্যাংকসহ অন্যান্য ব্যাংকগুলোর এলসি মার্জিন কমিয়ে সহনীয় পর্যায়ে নির্ধারণের বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংক বিবেচনা করবে বলে জানিয়েছে।
গত সপ্তাহে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদকে পাঠানো সারসংক্ষেপে অর্থবিভাগ বলেছে, 'বর্তমানে সৌদি আরব, মরক্কো, চীন ও কানাডা হতে বাংলাদেশ এগ্রিকালচার ডেভেলপমেন্ট করপোরেশনের আমদানি করা ডিএপি ও এমওপি সারের বিলমূল্য ও জাহাজভাড়া বাবদ ৮০ মিলিয়ন ডলার বকেয়া রয়েছে।'
এতে আরও বলা হয়েছে, 'সময়মতো সারের আমদানিমূল্য পরিশোধে ব্যর্থ হওয়ায় রপ্তানিকারক সংস্থাগুলো প্রতিশ্রুতিবদ্ধ শিপমেন্ট শিডিউলগুলো বাতিল করে সার সরবরাহ বন্ধ রেখেছে। ফলে গত তিন মাসে ৬ লাখ টন সার আমদানি সম্ভব হয়নি। এর মধ্যে সার আমদানির জন্য জাহাজভাড়া বাবদ বকেয়া অর্থ পরিশোধ না করায় সার আমদানির জন্য জাহাজ ভাড়া পাওয়ার বিষয়টিও অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।'
কৃষি মন্ত্রণালয়ের চাহিদা অনুযায়ী নন-ইউরিয়া সারের জোগান নিশ্চিত করে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি) ও ইউরিয়া সারের যোগান দিয়ে থাকে বাংলাদেশ কেমিকেল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন (বিসিআইসি)।
দুই করপোরেশনের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের ইউরিয়া সারের চাহিদা ২৭ লাখ টন, আর বর্তমানে মজুত রয়েছে ৫ লাখ ৭০ হাজার টন। নন-ইউরিয়া সারের (টিএসপি, ডিএপি, এমওপি) চাহিদা ৩২ লাখ টন, যার বর্তমান মজুত ১১.২৩ লাখ টন।
ডলার সংকটের ধাক্কা সারের সবরাহে
শেখ হাসিনার সরকার দায়িত্বে থাকার সময় বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভ থেকে ডলার সরবরাহ বন্ধ করার পরপরই সার আমদানিতে জটিলতা দেখা দেয়। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পরই এ সমস্যা সমাধানে নির্দেশনা দেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ।
সভায় বিএডিসি চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ সাজ্জাদ বলেন, সার আমদানির বকেয়া পাওনা পরিশোধ না করায় সরবরাহকারী বিভিন্ন দেশ সার সরবরাহে অপরাগতা প্রকাশ করছে।
'এলসি দায় মেটাতে ডলার সংকটের কারণে বেসরকারি পর্যায়েও সার আমদানিতে সমস্যা হচ্ছে। ডলার সংকটের কারণে সোনালী ব্যাংক এলসি খোলা স্থগিত রেখেছে, শতভাগ মার্জিন ছাড়া ইসলামী ব্যাংক এলসি খুলবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে,' বলেন তিনি।
তিনি আরও জানান, জনতা ব্যাংক ও বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকে এলসি খোলার উদ্যোগ নিলেও ব্যাংকগুলোর এলসির এডিশনাল কনফার্মেশন পাওয়া যায় না।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব নুরুন্নাহার চৌধুরী জানান, সার আমদানির ক্ষেত্রে ডলার সংকট নিরসনে সব ব্যাংকের সঙ্গে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ সভা করেছিল। তখন সব ব্যাংকই ডলার সরবরাহের আশ্বাস দিলেও তারা কেউই এগিয়ে আসেনি।
বিএডিসির তথ্যানুসারে, সার আমদানি বাবদ বিএডিসির কাছে বকেয়া পাওনা ১১৭ মিলিয়ন ডলার। আগামী মার্চ পর্যন্ত সার আমদানি করতে বিএডিসির আরও ৭০০ মিলিয়ন ডলার লাগবে।
বিসিআইসির পরিচালক মো. শাহীন কামাল বলেন, ইউরিয়া সার আমদানি বাবদ প্রতিষ্ঠানটির বকেয়ার পরিমাণ ৬২ মিলিয়ন ডরার। তাছাড়া, ঘোড়াশাল-পলাশ ইউরিয়া সার কারখানার বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ বাবদ ৪৩ মিলিয়ন ডলার বকেয়া রয়েছে।
আগামী মার্চ পর্যন্ত ইউরিয়া সার আমদানির জন্য ৬৭২ মিলিয়ন ডলার প্রয়োজন। এছাড়া টিএসপি ও ডিএপি সার উৎপাদনের জন্য কাঁচামাল আমদানি বাবদ আরও ১৫০ মিলিয়ন ডলার দরকার হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের অতিরিক্ত পরিচালক কাজী শৈবাল সিদ্দিকী বলেন, সার আমদানির ক্ষেত্রে ইসলামী ব্যাংকে শতভাগ মার্জিনে এলসি খোলার বাধ্যবাধকতার বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংক আরোপ করেছে।
তবে সাম্প্রতিক সময়ে ডলারের স্থিতি ও সরবরাহ পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে বলে মার্জিনের বিষয়টি শিথিল করার জন্য ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংককে অনুরোধ করতে পারে।
সার আমদানির এলসি খোলার জন্য শুধু সোনালী ব্যাংকের ওপর নির্ভরশীল না থেকে যেসব ব্যাংকে ডলারের প্রবাহ ভালো রয়েছে, সেসব সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকে এলসি খোলার পরার্মশ দেন তিনি।