চট্টগ্রামকে বাণিজ্যিক কেন্দ্রে পরিণত করতে প্রয়োজন প্রকল্পের যথাযথ বাস্তবায়ন
চট্টগ্রামকে ঘিরে এক লাখ কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ চলছে। মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর, মিরসরাই ইকোনমিক জোন, কর্ণফুলী টানেল, কক্সবাজার রেল লাইন, চট্টগ্রাম বন্দরের বে টার্মিনাল, পতেঙ্গা কন্টেইনার টার্মিনাল প্রভৃতির কাজ হচ্ছে। বিনিয়োগবান্ধব নগরী হিসেবে প্রস্তুত চট্টগ্রাম। যেটি হবে আগামীর দক্ষিণ এশিয়ার বিজনেস হাব।
বৃহস্পতিবার দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড আয়োজিত এক ওয়েবিনারে চট্টগ্রামের বিভিন্ন খাত ও সংস্থার প্রতিনিধিরা এসব কথা বলেন।
চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, "চট্টগ্রাম ইজ এ কমার্শিয়াল হাব কান্ট্রি। চট্টগ্রামে যে প্রকল্পগুলো হচ্ছে সেগুলো অন টাইমে শেষ হওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ।"
তিনি বলেন, "বন্দরের বে টার্মিনাল, নতুন জেটি করতে হবে। এগুলো না করলে বাণিজ্য নগরীর যে সুফল তা পাওয়া যাবে না। চট্টগ্রামে বিভাগীয় যে অফিস আছে সেগুলো এমপাওয়ার্ড করতে হবে। প্রতিষ্ঠানগুলোর সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা চট্টগ্রামে নিয়ে আসতে হবে।"
বড়দারোগারহাটের ওজন স্কেলের কারণে চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অন্যান্য সড়কে ২০-২২ টন পণ্য পরিবহন করলেও চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা ১৩ টনের বেশি পরিবহন করতে পারে না।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রাম চ্যাপ্টারের সভাপতি অ্যাডভোকেট আক্তার কবির চৌধুরী বলেন, "চট্টগ্রাম বাণিজ্যিক রাজধানী ঘোষিত হয়েছে প্রায় কয়েক যুগ হয়। আমি বলি সেটাকে কানা ছেলের নাম পদ্মলোচন। এখানে বাণিজ্যিক রাজধানী হিসেবে যে উন্নয়নের কথা ছিলো, প্রত্যাশা ছিলো সেটি একেবারেই হয়নি। না হওয়ার পেছনে কারণ রাষ্ট্রযন্ত্র। সমাজ চালান রাজনীতিকরা; ওই সময়ে চট্টগ্রাম থেকে যারা নেতৃত্বে ছিলেন, মন্ত্রী কিংবা জনপ্রতিনিধি, এমপি, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান, সিটি কর্পোরেশন- এই জনপদের প্রতি কারো কোনো দায়বোধ আছে, আমরা তা খুব একটা লক্ষ্য করিনি।"
চট্টগ্রাম চেম্বারের সহসভাপতি সৈয়দ মোহাম্মদ তানভীর বলেন, "চট্টগ্রামের বড় সমস্যা জলাবদ্ধতা। প্রতিবছর আমরা চট্টগ্রামবাসী ভুগে থাকি। এই জলাবদ্ধতা নিরসনের দায়িত্ব যেমন সিটি কর্পোরেশন, সিডিএরত, তেমনি জলাবদ্ধতার জন্য নাগরিকরাও দায়ী।"
তিনি বলেন, "এখানে যে ফরেন ইনভেস্টমেন্টগুলো হবে, তার জন্য যে দক্ষ জনশক্তি দরকার, এবং সে দক্ষ জনশক্তির জন্য যে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র দরকার, তার কিছুই নেই। এজন্য প্রাইভেট সেক্টরকে এগিয়ে আসতে হবে।
"জাপান ডেস্ক দেশে প্রথমবার কোন ট্রেড বডির সাথে সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সাইন হলো। এটি খুবই ফাংশনাল ডেস্ক। যেখানে যে কোন জাপানি বিনিয়োগকারী বাংলাদেশে এসে যদি বাংলাদেশ সম্পর্কে যে কোন তথ্য চায় জানতে পারবে। বাংলাদেশ ইজ অব ডুয়িং বিজনেসে পিছিয়ে আছে। এই জায়গায় আমরা ওয়ান স্টপ সল্যুশন, ওয়ান স্টপ সার্ভিস দেওয়ার জন্য জাপান ডেস্কটি স্থাপন করেছি। কোম্পানি ফরমেশন, ট্যাক্স এডভাইজরি, কর্পোরেট ফরমেশন, রিক্রু- প্রতিটি সেবা জাপানি বিনিয়োগকারীদের সরবরাহ করছি।"
মেগা খরচের মেগা লাভ নেই
পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরামের সহসভাপতি প্রকৌশলী সুভাষ বড়ুয়া বলেন, "চট্টগ্রামের জলজট ও যানজট নিয়ে গুণগত কোনো আলোচনা নেই। হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে, কিন্তু যানজট বা আর জলজট রয়েই গেছে। এতসব আয়োজনের কোথাও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নেই।"
"আমরা যানজট নিরসনে মেট্রোরেলের কথা বলছি। এটি ঘণ্টায় ৬০ হাজার যাত্রী পরিবহন করতে পারবে। অথচ এই শহরে নিয়মিত যাতায়াত করার মত ৫ থেকে ৬ হাজারের বেশি যাত্রী নেই। মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে মেগা খরচ হলেও মেগা লাভ নেই। ১ হাজার টাকায় যে কাজ হচ্ছে, সেটা ১ টাকায় করা যেতো," যোগ করেন সুভাষ বড়ুয়া।
"আমরা কখনোই সমস্যার গভীরে যাচ্ছি না। ১৯৯৫ সারে মাস্টারপ্ল্যান প্রণীত হয়েছিলো, কিন্তু সেটা বাস্তবায়নের জন্য কোনো প্ল্যানিং ডিপার্টমেন্ট নাই। সেই মাস্টার প্ল্যানের প্রথম পর্যায়ের কাজও গত ২৬ বছরে শুরু করা যায়নি! তাই এই পরিস্থিতিকে বদলাতে হলে আমাদের নতুন করে পরিকল্পনার প্রয়োজন।"
'ব্যবসায়ীরা ফ্লাইওভারে চড়বে, রিকশাওয়ালার কথা ভাববে কে'
পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরামের সাধারণ সম্পাদক স্থপতি জেরিনা হোসেন বলেন, "দুঃখের সাথে বলতে হয় যখন উন্নয়নের শিখরে যাওয়ার চিন্তা করছি, তখন নিশ্চয় একটি রোডম্যাপ ধরে আগাতে হবে। কিন্তু আমাদের কোনো পরিকল্পনা নাই।"
"চট্টগ্রামে একের পর এক উড়ালসড়ক হচ্ছে কিন্তু পথচারীদের জন্য ফুটপাত কোথায়?", এমন প্রশ্ন রাখেন স্থপতি জেরিন হোসাইন।
তিনি বলেন, "৪ হাজার কোটি টাকা খরচ করেযে ফ্লাইওভার তৈরী করে বলা হচ্ছে ইনভেস্টররা বা ব্যবসায়ীরা এতে নির্বিঘ্নে চলাফেরা করতে পারবেন। কিন্তু ফ্লাইওভারের নিচের রিকশাওয়ালাদের কথা কে ভাববে?"
"এখন শহরের বাইরে হাটহাজারী, পটিয়া, বোয়ালখালীতে স্যাটেলাইট টাউনের কথা বলা হচ্ছে। অথচ '৯৫ এর মাস্টার প্ল্যানে সব পরিকল্পনাই ছিলো। সারা বিশ্বে ইউনিভার্সিটি টাউন একটি জনপ্রিয় ধারণা। শুধুমাত্র চট্টগ্রাম বিদ্যালয়কে কেন্দ্র করেই একটি ইউনিভার্সিটি টাউন হতে পারতো," যোগ করেন স্থপতি জেরিন হোসাইন।
সিঙ্গাপুর নয়, চট্টগ্রামকে নিয়ে চট্টগ্রামের মতো করেই ভাবতে হবে
চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ড. মোহাম্মদ রাশিদুল হাসান বলেন, "চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন বা চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ নিয়ে ভাববার সুযোগ এখন আর নেই। এখন থেকে বৃহত্তর চট্টগ্রামের আঞ্চলিক পরিকল্পনা নিয়ে ভাবতে হবে।"
তিনি বলেন, "কথায় কথায় চট্টগ্রামকে সিঙ্গাপুর বানানোর প্রতিশ্রুতি না দিয়ে চট্টগ্রাম নিয়ে চট্টগ্রামের মতো করেই ভাবতে হবে। এই চট্টগ্রামের ১২০০ বছরের ইতিহাস রয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর ১০০ বছরের ডেল্টাপ্ল্যানের সঙ্গে সংগতি রেখে চট্টগ্রামকে গড়ে তুলতে হবে।"
"সরকার ইতোমধ্যেই মাতারবাড়ি নিয়ে মহাপরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। মিরসরাই, সীতাকুণ্ড ও আনোয়ারা ইকোনোমিক জোন হচ্ছে। সেখানে কয়েক লাখ মানুয়ের কর্মসংস্থান হবে। তাদের আবাসন কিভাবে হবে সে পরিকল্পনা এখনই নিতে হবে," যোগ করেন রাশিদুল।
বিনিয়োগবান্ধব যোগযোগ ব্যবস্থা
চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ স্থপতি শাহিনুল ইসলাম খান বলেন, "বিনিয়োগবান্ধব দেশ হিসেবে বাংলাদেশ আগের চেয়ে দশ ধাপ এগিয়ে এখন ১৬৮তম। বিনিয়োগবান্ধব যোগাযোগ ব্যবস্থার ক্ষেত্রে আমরা যে বিশাল উদ্যোগ নিয়েছি তা তো আপনারা জানেন। আমরা সড়ক যোগাযোগ বৃদ্ধি করতে সড়ক নির্মাণ করছি। ফ্লাইওভার নির্মাণ করছি। টানেলের মাধ্যমে চট্টগ্রাম ওয়ান সিটি টু টাউনে রূপান্তরের অপেক্ষায় রয়েছে।
পাশাপাশি জনবহুল শহর হিসেবে যানজট নিরসন করতে গণপরিবহন বাড়াতে হবে। ডেডিকেটেড বাস লেন চালু করতে হবে।"
সড়কপথের পাশাপাশি নৌপথ এবং রেলপথের গুরুত্ব বাড়াতে হবে
জলবায়ু বিশেষজ্ঞ এবং চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সাবেক প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ স্থপতি রেজাউল করিম বলেন, "চট্টগ্রাম একটি উপকূলীয় শহর এবং এই অঞ্চলের সবচেয়ে বড় শহর। এখানে প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৪০-৪৫ হাজার লোক বাস করে। উপকূলীয় শহর হিসেবে আমরা পরিবেশগত ঝুঁকিতে রয়েছি।"
তিনি বলেন, জনসংখ্যার ঘনত্বের সাথে যেসব অবকাঠামো সুবিধা রয়েছে সেসব সুবিধা নিশ্চিত করা গেলে ঘনত্ব কোন বিষয় না।
"জলবায়ু পরিবর্তন দিন দিন বাড়ছে এবং বাড়বে। চট্টগ্রামে এলার্মিং হলো এটা উপকূল ও পাহাড়ের সমন্বয়ে গঠিত। এই পাহাড়গুলো আবার বালুর পাহাড়। এখানে নদীভাঙ্গন, বন্যা, খরা ও ঘূর্ণিঝড়ের কারণে মানুষ শহরে এসে পাহাড়ে বসবাস করছে। পাহাড়ে বসবাস করতে গিয়ে এরা পাহাড় কাটছে। ফলে এই বালিগুলো বৃষ্টিতে মিশে গিয়ে বর্ষায় জলাবদ্ধতা তৈরি করছে।"
নগরীর পাশাপাশি আশপাশের উপজেলাগুলোকে স্যাটালাইট টাউন হিসেবে গড়ে তোলা গেলে শহরের উপর চাপ কমবে বলে জানান তিনি।
তাছাড়া বন্দরের কন্টেইনার হ্যান্ডেলিংশুধু ট্রাকে কিংবা লরিতে না করে ট্রেনের মাধ্যমে করা গেলে সড়কপথে যানবাহনের চাপ অনেক কমবে বলে মনে করেন রেজাউল করিম।