খাওয়া কমছে, লাভ কমছে, বাড়ছে শুধু দাম
বাচ্চার জন্য দুধ, ডিম বা ফল কেনা বন্ধ করে দিয়েছেন মেহেদি হাসান। নিত্যপণ্যের ক্রমবর্ধমান দামের চাপ সামলাতে দৈনন্দিন খরচের বাজেট কমিয়ে এনেছেন। আর কোথাও খরচ কমানোর উপায় না থাকায় বাধ্য হয়ে মে মাসে সবজি কেনাও কমিয়েছেন।
মেহেদি, তার স্ত্রী ও সন্তানসহ ৩ সদস্যের পরিবারের জন্য সবজি ও সাবান, টুথপেস্ট ও ডিটারজেন্ট পাউডারের মতো প্রয়োজনীয় পণ্য কেনার মাসিক বাজেট ৮ হাজার টাকা। কিন্তু গত মাসে তাদের এসব নিত্যপণ্য কেনার জন্য বাকি ছিল মাত্র ৫ হাজার টাকা।
"আমি এমনকি মহামারির সময়ও এতো বিপাকে পড়িনি", বলেন ঢাকার রামপুরার বাসিন্দা একটি বেসরকারি সংস্থার কর্মী মেহেদি।
তার অনুমান, গত দুই বছরে নিত্যপণ্যের দাম ৩০ শতাংশের বেশি বেড়েছে। শুধুমাত্র মে মাসে দাম বেড়েছে ২০%, কিন্তু আয় বাড়েনি একদমই।
একটি জরিপের তথ্যানুযায়ী, নিত্যপণ্যের ক্রমবর্ধমান দামের কারণে মেহেদির মতো দেশজুড়ে প্রায় ৬৭% পরিবার মে মাসে তাদের দৈনন্দিন খরচ কমাতে বাধ্য হয়েছেন।
সারা দেশের ৪ হাজার পরিবারের ওপর জরিপ চালিয়ে, পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) এবং ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্নেন্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি) জানিয়েছে, ৩৮% পরিবার জানিয়েছে তাদের শুধু খাদ্য সামগ্রীর কিনতেই আরও অর্থের প্রয়োজন। কিন্তু নগদ অর্থের অভাবে পরিবারগুলো খাওয়া কমিয়ে দিয়েছে।
"মে মাসে প্রতি পাঁচটি পরিবারের অন্তত একটি পরিবার দিনে এক বেলা কম খেয়েছে," বলা হয় জরিপটির প্রতিবেদনে।
পিপিআরসি'র নির্বাহী চেয়ারম্যান হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, মানুষ মাছ, মাংস, দুধ ও ফল খাওয়া কমিয়ে দিয়েছে।
"খাবার ও শিক্ষার খরচ কমানোর কারণে মানুষের জীবন যাত্রার মান কমে যাচ্ছে। এছাড়া, এসব পণ্য উৎপাদক ও বিতরণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে"।
একই দামে কম পণ্য
আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের দাম বৃদ্ধির মুখে শুরুর দিকে দাম না বাড়িয়ে প্যাকেটে পণ্যের পরিমাণ কমিয়ে সমন্বয়ের চেষ্টা করেন ব্যবসায়ী ও বড় কোম্পানিগুলো।
পণ্যের পরিমাণ কমা ও একই দামে কম বিক্রি হওয়া মূল্যস্ফীতির লক্ষণ। এটি নতুন কিছু না হলেও বর্তমান সময়ের মতো উচ্চ মূল্যস্ফীতির সময়ে বেশি দেখা যায়।
উৎপাদক ও বিক্রেতারা জানিয়েছেন, গত এক মাসেই নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে ১০-২০ শতাংশ।
ঢাকার বিভিন্ন এলাকার দোকানীরা জানিয়েছেন, ঈদের পর মে মাসের প্রথম সপ্তাহে কোম্পানিগুলো আলু ও অন্যান্য চিপস ও চানাচুরের নিট ওজন কমিয়েছে।
ঢাকার ফার্মগেট এলাকার দোকানী আরিফ হোসেন জানান, গত সপ্তাহে কোম্পানিগুলোর সরবরাহ করা চিপস, চানাচুর, বিস্কুট ও অন্যান্য প্যাকেটজাত নাস্তার পরিমাণ কম ছিল। তবে গ্রাহকরা খুব বেশি খেয়াল করে না দেখতে তা বোঝার উপায় নেই।
বেশি আলু, কম মাংস
ঢাকার সাধারণ মানের হোটেল-রেস্টুরেন্টে এখন এক বাটি মুরগির দাম এখনো ৭০-৯০ টাকা। তবে মুরগির মাংসের পরিমাণ কমিয়ে বাড়ছে আলুর আধিক্য।
গরুর মাংসের দাম বেড়েছে বাটিপ্রতি ১০ থেকে ২০ টাকা। তবুও কমেছে বাটি প্রতি মাংসের পরিমাণও। মাছের বিভিন্ন পদে বাড়তি গুনতে হচ্ছে ১০-১৫ টাকা।
রাজধানীর মগবাজারে রাবেয়া হোটেলে দুই সপ্তাহ আগেও প্রতিটি রুটি-পরোটা বিক্রি হতো ৫ টাকায়। সেটা এখন ১০ টাকা। এর সঙ্গে এক বাটি ডাল-ভাজির দাম ১০ টাকা থেকে বাড়িয়ে রাখা হচ্ছে ২০ টাকা।
হোটেলটির মালিক রফিক হাওলাদার বলেন, 'গত কয়েক মাসে দাম বাড়াইনি। লোকসান থেকে বাঁচতে খাবারের পরিমাণ কমিয়েছিলাম। আর কমানো সম্ভব নয়, তাই বাধ্য হয়েই দাম বাড়িয়েছি। তবে দাম বাড়িয়ে রুটি-পরোটা ও সবজির পরিমাণ কিছুটা বড় করেছেন বলেও জানান তিনি।
দুপুরের খাবারে ভাত ও অন্যান্য অনুসঙ্গের পরিমাণ ছোট হয়েছে জানিয়ে রফিক হাওলাদার বলেন, এক কেজি মাছ ১৫-১৬ পিস করেন, এক কেজি গরুর মাংসে আগে ১০-১১ বাটি হতো এখন ১৫-১৬ বাটি বিক্রি করেন।
মগবাজারের ভর্তা-ভাত রেস্টুরেন্টের বিক্রয় কর্মী ছায়েদুর রহমান বলেন, এক কেজি মাংস রোজার আগে ১১-১২ ভাগ করে ১০০ টাকা করে বিক্রি হতো। এখন ১২০ টাকা, আর এক কেজিতে ১৪-১৫ বাটি করতে হচ্ছে।
ব্যবসায় মার্জিন কমছে রিটেইলারের
রাজধানীর ইস্কাটনে ভাই ভাই স্টোরে একটি শীর্ষ ব্র্যান্ডের সাবান, শ্যাম্পু, বিউটি ক্রিমসহ কনজিউমার প্রোডাক্ট বিক্রি করেন আমজাদ হোসেন।
ঈদের পর পণ্যের গায়ে দেওয়া দাম থেকে রিটেইলারের প্রফিট মার্জিন ৩ শতাংশ কমিয়ে দিয়েছে কোম্পানি।
নুডুলস, চানাচুর, পাউরুটি, পাস্তা, গুড়ো দুধ, প্লাস্টিক, হোম অ্যাপ্লায়েন্সের মতো পণ্যেও কমিশন কমছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
আমজাদ হোসেন বলেন, "ঈদের আগে পণ্যের গায়ের দামের ওপর ১২ শতাংশ কমিশন দিয়েছে। এখন তা কমিয়ে ৯ শতাংশ দিচ্ছে। ফলে ব্যবসা কমে গেছে।"
দাম না কমিয়ে পণ্য কমিয়েও চলছে না
প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের পরিচালক (মার্কেটিং) কামরুজ্জামান কামাল বলেন, ২০২২ সালের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত উৎপাদন ব্যয় ৩০-৩৫ শতাংশ বেড়েছে। এতোদিন ধরে প্রফিট মার্জিন কমিয়ে পন্য সরবরাহ করছি। প্যাকেটে পণ্যের পরিমাণও কমিয়েছে। তবে এখন দাম বৃদ্ধি ছাড়া আর উপায় নেই।
ইতোমধ্যে বেশ কিছু পণ্যের দাম বাড়িয়েছে গ্রুপটি।
বাংলাদেশ অটো বিস্কুট অ্যান্ড ব্রেড ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোঃ শফিকুর রহমান ভূঁইয়া বলেন, কয়েকটি বড় প্রতিষ্ঠান ১০-১২ শতাংশ দাম বাড়িয়েছে। তবুও তাদের প্রফিট মার্জিন অনেক কমেছে।
"ছোট প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে প্যাকেটে বিস্কুটের পরিমাণ কমিয়েছেন। বাধ্য হয়ে তারাও এখন বেকারি আইটেমের দাম ১০%পর্যন্ত বাড়িয়েছে। কিন্তু দাম বাড়ানোয় বিক্রি কমে গেছে"।
ফেয়ার গ্রুপের প্রধান মার্কেটিং কর্মকর্তা মেসবাহ উদ্দিন বলেন, গত ছয় মাসে সব ধরণের কাঁচামালের গড় দাম বেড়েছে ৩০ শতাংশ। ফ্রেইড চার্জ, ট্রান্সপোর্ট চার্জসহ অপারেশন চার্জ বেড়েছে কমপক্ষে ২৩ শতাংশ। কিন্তু এ সময় কোম্পানিটি পণ্যের দাম বাড়ায়নি।
"দীর্ঘমেয়াদে বাজারে টিকে থাকার জন্যই এখন উৎপাদন অব্যাহত রাখতে হচ্ছে। লোকসান দিয়ে বাজারে টিকে আছি। এখন দাম বড়ানো ছাড়া কোনো উপায় নেই", বলেন তিনি।