ভ্যাকসিনের জন্য যখন হাহাকার, তখন মঙ্গোলিয়া একাই বিশাল সংগ্রহ নিয়ে বসে আছে
তৃণ আবৃত পাহাড়, বিশাল মরুভূমি আর দিগন্ত বিস্তৃত সমভূমির দেশখ্যাত মঙ্গোলিয়া। কিন্তু, এত বড় দেশের মোট জনসংখ্যা যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের চাইতেও কম। মঙ্গোলিয়ার চেয়েও সুবিশাল- দুই প্রতিবেশী রাশিয়া ও চীনের সীমান্তের মাঝামাঝি অবস্থান গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রটির। মঙ্গোলিয়ার ওপর দুই প্রতিবেশীর প্রভাবও অনেক। দীর্ঘকাল ধরে তাদের প্রভাবের মাঝে ভারসাম্য রক্ষা করতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে দেশটি।
রাশিয়া ও চীনের অভিলাষ বিশ্বব্যাপী পশ্চিমা প্রভাবে চিড় ধরানো এবং নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করা। বিশ্বশক্তি দুটি করোনাভাইরাস ভ্যাকসিন উৎপাদন ও রপ্তানি করছে। আর এই দুই দেশের মাঝে অবস্থান হওয়ার সুবিধাই ভোগ করছে মঙ্গোলিয়া।
বেশিরভাগ উন্নয়নশীল দেশের সরকার যখন নিজ জনসংখ্যার জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে ভ্যাকসিন সংগ্রহে ব্যতিব্যস্ত, ঠিক তখনই এই মুহূর্তে মঙ্গোলিয়ার কাছে নিজের সম্পূর্ণ প্রাপ্তবয়স্ক জনসংখ্যাকে দেওয়ার মতো টিকার ডোজ আছে। চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে করা চুক্তির সুবাদেই এই অর্জন দেশটির। প্রতিষেধকের যথেষ্ট যোগান নিয়ে উৎফুল্ল সরকারি কর্মকর্তারা দৃঢ় আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে জনগণকে দিয়েছেন কোভিডমুক্ত গ্রীষ্মকালের আশ্বাস।
স্বল্প আয়ের এবং উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার পরও, মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই প্রয়োজনীয় সংখ্যক প্রতিষেধক ডোজ সংগ্রহে মঙ্গোলিয়ার সফলতা বড় রকমের জয়। কারণ, অনেক দরিদ্র দেশ টিকা পাওয়ার জন্য সাড়ি বেধে অপেক্ষা করছে, আশা করছে অন্যদের সহায়তার ওপর। মঙ্গোলিয়ায় প্রভাব বিস্তার নিয়ে রাশিয়া ও চীনের মধ্যে যে প্রতিযোগিতা আছে, তারই সুবাদে ভূ-রাজনীতির এ খেলায় মঙ্গোলিয়া নিজেও এক খেলোয়াড়। সেই সুযোগকেই কাজে লাগিয়ে ধনী দেশগুলোর মতোই যথেষ্ট পরিমাণ ডোজ আয়ত্ত করেছে উলানবাটোর।
ব্রাসেলস ভিত্তিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক সেন্টার ফর রাশিয়া ইউরোপ এশিয়া স্টাডিজের পরিচালক থেরেসা ফ্যালন বলেন, "এ ঘটনায় রাশিয়া ও চীনের দড়ি টানাটানির মধ্যে থেকেও উভয়পক্ষের কাছ থেকে সুবিধা আদায়ে মঙ্গোলিয়ার সক্ষমতা প্রকাশ পাচ্ছে।"
তবে একা মঙ্গোলিয়া জেতেনি, জিতেছে চীন ও রাশিয়াও। মঙ্গোলিয়ার বিপুল খনিজ সম্পদের দিকে নজর আছে তাদের। তাছাড়া, মহামারি মোকাবিলায় এগিয়ে এসে বৈশ্বিক প্রতিপত্তি বাড়ানোর লক্ষ্য তো আছেই। দেশ দুটির স্থানীয়ভাবে উদ্ভাবিত টিকা নিয়ে পশ্চিমা দুনিয়া ঘোর সন্দেহ প্রকাশ করলেও, তাতে তাদের উচ্চাকাঙ্ক্ষী লক্ষ্যে ভাটা পড়েনি। আবার, উন্নয়নশীল দেশের প্রয়োজনও মস্কো ও বেইজিংয়ের সামনে নতুন সুযোগ এনে দিয়েছে।
রাশিয়ার নিজস্ব সীমানা নিরাপত্তার জন্য মঙ্গোলিয়া অতি-গুরুত্বপূর্ণ। মঙ্গোলিয়ার সাথে রাশিয়ার পূর্ব সীমান্ত প্রদেশগুলো জনবিরল অথচ প্রাকৃতিক সম্পদে পরিপূর্ণ। চেঙ্গিস খানের জন্মভূমিই রাশিয়া ও চীনের মধ্যে বাফার জোন। চীনের ক্রমবর্ধমান অর্থনীতির জন্য বিপুল খনিজ আহরণের প্রয়োজনীয়তা এবং বিশাল জনসংখ্যার অনুপ্রবেশ ঠেকাতে মস্কো-উলানবাটোর সম্পর্ক নতুন মাত্রা পেয়েছে পুতিনের আমলে।
বিশ্বমঞ্চে রাশিয়া ও চীন ঐক্যবধ্য হলেও তাদের মধ্যে সংঘাত এবং একে-অপরের সম্পর্কে সন্দেহের ইতিহাস দীর্ঘদিনের। মঙ্গোলিয়া ঘিরেও এসব পার্থক্য দৃশ্যমান তাদের ভ্যাকসিন কূটনীতিতে। অর্থাৎ, কেউই প্রভাব হ্রাস করতে আগ্রহী নয়।
ফ্যালন বলেন, "পাশের দেশে চীন কী করছে তা নিয়ে পুতিন সবসময়েই উদ্বিগ্ন।"
সেই সুবাদে রাশিয়ায় তৈরি স্পুটনিক ফাইভ টিকার ১০ লাখ ডোজ আগেভাগে কিনতে পেরেছে মঙ্গল সরকার। অন্যদিকে, চীন পাঠায় ৪০ লাখ ডোজ, শেষ চালানটি এসেছে চলতি সপ্তাহেই। বেইজিং এতটাই অগ্রাধিকার দেয় যে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদনের আগেই চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত সিনোফার্ম গ্রুপ মঙ্গোলিয়ার সঙ্গে চুক্তি করে।
এতে করে মোট সাড়ে ৩২ লাখ জনসংখ্যার দেশটি ৫০ লাখ টিকা ডোজের মালিক এখন। ইতোমধ্যেই রাজধানী উলানবাটোরের ৯৭ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ককে টিকার প্রথম ডোজ দেওয়া হয়েছে। আর অর্ধেকের বেশি নগরবাসী সম্পূর্ণরূপে বা দুই ডোজ টিকা পেয়েছেন বলে দেশটির সরকারি পরিসংখ্যানে সূত্রে জানা গেছে। আর সাড়া দেশজুড়ে তিন-চতুর্থাংশের বেশি মঙ্গোল টিকার অন্তত এক ডোজ পেয়েছেন, এই সফলতাকে বিস্ময়কর বলেই মনে করছেন জনস্বাস্থ্য বিশারদরা।
- সূত্র: দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস