ভারতের কর্মসংস্থান সংকট: কোথায় যাবে 'গন্তব্যহীন প্রজন্ম'?
আগামী পাঁচ বছরে ৬০ লাখ কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে ভারত। চলতি সপ্তাহের বাজেট ঘোষণায় ওঠে এসেছে এই তথ্য। তবে কর্মসংস্থান তৈরির এই বিষয়টি সহজ হবে না। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় ভারতের বেকারত্বের হার অন্যান্য উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোকেও ছাড়িয়েছে। ভারতের বেকারত্ব নিয়ে কাজ করেছেন ক্রেগ জেফরি এবং জেন ডাইসন। দেশটির বেকারত্বের প্রকৃতি নিয়ে বিবিসিতে তাদের লেখা প্রতিবেদনটি তুলে ধরা হলো।
২০০৫ সালের দিকে ভারতের উত্তরপ্রদেশের মিরাটে একদল তরুণ মজা করে নিজেদের নাম দিয়েছিল "গন্তব্যহীন প্রজন্ম"।
বছরের পর বছর ধরে সরকারি চাকরি লাভের ব্যর্থ চেষ্টায় হতাশ হয়ে পড়েছিল তারা। এই তরুণরা শহুরে জীবনযাপন নিয়ে দেখা স্বপ্ন আর নিজেদের গ্রামীণ বাস্তবতার মধ্যে আটকে পড়ার কথা জানায়। আধুনিক সমাজব্যবস্থা থেকে বেকারত্ব তাদের বিচ্ছিন্ন ফেলেছিল।
"আমাদের জীবন এখন শুধু 'টাইমপাসে' পরিণত হয়েছে," জানায় তারা।
গত দুই সপ্তাহে আবারও আলোচনায় এসেছে ভারতের কর্মসংস্থান সংকটের ব্যাপকতা। 'বেকার যুবসমাজ' নিয়ে গণমাধ্যম ও জনসাধারণ আবারও সরব।
এশিয়ায় কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর (ইউএনএফপি অনুসারে ১৫ থেকে ৬৪ বছর বয়সী) আধিক্য ভারতের উদীয়মান অর্থনীতির জন্য সুফল আনবে বলেই প্রচারিত হয়। তবে বেকার কিংবা নিম্নআয়ের চাকরি করা লাখ লাখ তরুণ ভারতের মোট কর্মক্ষম জনসংখ্যার আধিক্য বা ডেমোক্রাফিক ডিভিডেন্টের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে। এই তরুণদের অনেকেই উচ্চশিক্ষিত।
বেকারত্বের সমস্যা শূন্য দশকের মাঝামাঝি সময় থেকেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সময়ের সঙ্গে তা উল্লেখজনকহারে বাড়তে থাকে।
বেকারত্ব নিয়ে উদ্বেগ বাড়ার সাথে সাথে মিডিয়াতেও বিষয়টি উঠে এসেছে। কখনো বেকারত্ব নিয়ে তরুণদের ক্ষোভ, আবার কখনো নির্বাচনী প্রচারণা কিংবা সমাবেশে রাজনৈতিক নেতাদের প্রতিশ্রুতির বিষয়গুলো ঘুরেফিরে গণমাধ্যমে জায়গা করে নিয়েছে।
বেকারত্বের অভিশাপ নিয়ে আমাদের যে প্রচলিত ধারণা তা থেকে একটু বেরিয়ে এসে আমাদের আরও গভীর কিছু বিষয়ে আলোকপাত করা প্রয়োজন। যেমন, ভারতীয় তরুণদের দৈনন্দিন জীবন কেমন? কীভাবে সময় কাটায় তারা? সমাজের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক কেমন? ভারতকে বদলাতেই বা তারা কী ধরনের ভূমিকা রাখছে?
গত ২৫ বছর ধরে ভারতের উত্তর প্রদেশ এবং উত্তরাখণ্ডের ১৮ থেকে ৩৫ বছর বয়সী বেকার যুবকদের অভিজ্ঞতা ও কাজ নিয়ে গবেষণা করা হয়। উত্তর প্রদেশের মিরাট এবং উত্তরাখণ্ডের চামোলিতে বেকার যুবকদের সঙ্গে থেকে অংশগ্রহণমূলক পদ্ধতিতে গবেষণাটি পরিচালিত হয়।
এই যুবসমাজের সামাজিক ভোগান্তি লক্ষণীয়। বেকার তরুণরা হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। অর্থ অনটনের পাশাপাশি পারিবারিক প্রত্যাশা পূরণেও ব্যর্থ হয় তারা। আত্মসম্মানবোধের সঙ্গে সমঝোতা করে চলার সঙ্গে তাদের বিবাহিত জীবনেও দেখা দেয় নানা অশান্তি।
পরিবারের প্রধান উপার্জনকারী হিসেবে ছেলেদের জন্য স্থায়ী চাকরির নিশ্চয়তা গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করা হয়। পড়শোনা এবং চাকরি খোঁজায় যে সময় তারা ব্যয় করেছিল তা নিয়ে বিতৃষ্ণায় ভুগে এই তরুণরা।
নাগরিকত্বের সঙ্গেও জড়িয়ে আছে কর্মসংস্থানের সম্পর্ক। বহু তরুণ তাদের কিশোর ও অপেক্ষাকৃত তরুণ বয়সে সরকারি চাকরির মাধ্যমে দেশসেবার স্বপ্ন দেখে। কিন্তু সরকারি চাকরি পাওয়া এতটাই কঠিন হয়ে পড়েছে যে অনেকক্ষেত্রে তা হাস্যকর।
ফলস্বরূপ অনেক বেকার তরুণ বিশেষ করে ছেলেরা বিচ্ছিন্ন ও রুঢ় প্রকৃতির হয়ে পড়ে। কিছুই না করে শুধু 'টাইমপাস' করার কথা বলছে নিজেরাই। কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই যাদের, তারাই এখন সমাজের সর্বত্র।
কিন্তু এই বেকার যুবকরা কিছুই করছে না, এ ধরনের ধারণা একতরফা। একে আক্ষরিকভাবে নেওয়া উচিত নয়।
চাকরি না পাওয়া তরুণরা সাধারণত উদ্যোক্তা হিসেবে ভূমিকা রাখে। বিকল্প হিসেবে তারা এমন কাজ খুঁজে নেয় যেখানে খুব বেশি দক্ষতা দেখানোর প্রয়োজন পড়ে না, তবে ভবিষ্যতে যা থেকে ভালো কর্মসংস্থান গড়ে ওঠার সম্ভাবনা থাকে।
বেকার কিংবা নিম্নমানের কাজ করে এমন তরুণরা সমাজ সেবার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ভারতের নাগরিক সমাজের অন্যতম ভিত্তি হয়ে উঠেছে এই যুবসমাজ।
দৈনন্দিন জীবনে এই যুবকরাই সমাজ পরিবর্তনের অগ্রদূত হিসেবে কাজ করছে। স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে নিজেদের গ্রাম বা শহরের আশেপাশে অন্যদের সাহায্য করছে তারা। সাধারণ মানুষকে রাষ্ট্রীয় পরিষেবা পেতে সহায়তা করে তারা। এই তরুণরাই নতুন ধারণা প্রচার করে। নতুন প্রযুক্তি, ক্ষুদ্রঋণ, ধর্মীয় অনুশীলন, পরিবেশ সম্পর্কিত সচেতনতা এবং উন্নয়নের ধারণাগুলোও তারাই প্রচার করে।
কখনও কখনও এই তরুণরা প্রতিবাদে অংশ নেয়। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই রাজনীতির পরিবর্তে বিভিন্ন পরিষেবা এবং অবকাঠামো ঘিরে সরব থাকে তারা। তারা একটি ভাল গণিত শিক্ষক চায় কিংবা স্কুল কিংবা শিক্ষাব্যবস্থা উন্নত করার দাবি তুলে।
একটি জিনিস যা অনেক বেকার যুবক বলেছে তা হলো, নিজেদের সাহায্য করতে না পারলেও তারা পরবর্তী প্রজন্মকে সাহায্য করার আশা রাখে।
কমবয়সী টিনেজার বা আরও ছোট যারা, তারা যখন নতুন কোনো বিষয়ে পড়তে চায় বা ক্যারিয়ার হিসেবে অপ্রচলিত কোনো পেশা বেছে নিতে ইচ্ছা প্রকাশ করে তখন অভিভাবকদের সঙ্গে শুরু হয় দ্বন্দ্ব। অন্যদিকে, বেকার ও নিম্নমানের কর্মসংস্থানে যুক্ত ১৮ থেকে ৩৫ বছর বয়সী যারা কর্মসংস্থান খোঁজার যুদ্ধের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তারা হয়ে ওঠে এক মধ্যবর্তী প্রজন্ম।
এই বিষয়গুলো বেকারত্বকে উৎসাহিত করতে বলা নয়। তবে ভারতীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যকার এই শক্তিবলয়কে স্বীকৃতি দেওয়া। কিশোর, কুড়ি বা ত্রিশের কোঠার কর্মহীন যুবসমাজ সারা ভারতজুড়েই আছে। তারা শুধু ভারতের নয়, বিশ্বের ভবিষ্যতের জন্যেও গুরুত্বপূর্ণ।
এটি নীতিনির্ধারকদের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।
অন্যান্য সামাজিক সংগঠনগুলোই বা এই যুবসমাজকে কীভাবে সাহায্য করতে পারে?
এক্ষেত্রে সম্ভবত ভারতের মহাত্মা গান্ধী জাতীয় গ্রামীণ কর্মসংস্থান গ্যারান্টি স্কিমকে সম্প্রসারিত করা যেতে পারে। সমাজে তারা যে ধরনের সামাজিক সেবার নেতৃত্ব দিচ্ছে, তার স্বীকৃতির জন্য কাঠামোবদ্ধ আনুষ্ঠানিক সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। এগুলো কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা স্কিমের অন্তর্ভুক্ত হবে। বেকার বা নিম্নমানের কর্মসংস্থানে যুক্ত সক্রিয় তরুণদের দক্ষতাতে স্বীকৃতিদান ও কাজে লাগানোর আরও ভালো উপায় খুঁজে বের করতে হবে।
একটি বিষয় স্পষ্ট, যুবসমাজ নিজেরাই এধরনের সুযোগের জন্য অধিক আগ্রহে অপেক্ষা করছে।
সূত্র: বিবিসি