ইউরোপ না নিলে রাশিয়ার তেল-গ্যাস কিনবে কারা?
বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের বৃহত্তম রপ্তানিকারক রাশিয়া। ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এজেন্সির মতে, ২০২১ সালে রাশিয়ার ফেডারেল বাজেটের ৪৫ শতাংশ এসেছে দেশটির তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের খাত থেকে।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) দীর্ঘসময় ধরে রাশিয়ার তেল ও গাসের প্রধান গ্রাহক। ২০২১ সালের অক্টোবরে যুক্তরাষ্ট্রের এনার্জি ইনফরমেশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (ইআইএ) জানায়, রাশিয়ার অপরিশোধিত তেল ও কনডেনসেট রপ্তানির ৪৯ শতাংশ অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও উন্নয়ন সংস্থা (ওইসিডি)-র ইউরোপীয় দেশগুলোতে গেছে।
অন্যদিকে, প্রাকৃতিক গ্যাসের জন্য ইউরোপ নিঃসন্দেহে রাশিয়ার মুখ্য বাজার। ইআইএ-র মতে, ২০২১ সালে রাশিয়ার প্রাকৃতিক গ্যাস রপ্তানির তিন-চতুর্থাংশ ইউরোপীয় দেশগুলোতে যায়।
তবে ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন ও রাশিয়ার বিভিন্ন বাহিনীর সংঘটিত যুদ্ধাপরাধের ঘটনা বাড়তে থাকায় ইইউ-কে নাটকীয়ভাবে রাশিয়ার জীবাশ্ম জ্বালানি নির্ভরতা থেকে সরে আসার সিদ্ধান্ত নিতে হয়।
এদিকে প্রাকৃতিক গ্যাসের ক্ষেত্রে জার্মানি ও ইতালির মতো ইউরোপীয় দেশগুলো কত দ্রুত এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হবে তা এখনও প্রশ্নবিদ্ধ।
কিন্তু ইউরোপ যদি সত্যিকার অর্থেই '২০৩০ সালের আগেই' রাশিয়ার সব ধরনের জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে সরে আসার সিদ্ধান্তে অটল থাকে, তাহলে শিগগিরই রাশিয়ার জরুরিভিত্তিতে নতুন কিছু গ্রাহকের প্রয়োজন হবে।
প্রাচ্যের দিকে নজর?
কিন্তু কারা হতে পারে রাশিয়ার তেল-গ্যাসের নতুন গ্রাহক? সম্ভবত রাশিয়া প্রথমেই চীনের মতো বর্তমান গ্রাহকদের কাছে বিক্রি বাড়াতে চাইবে যারা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেনি। তেলের ক্ষেত্রে চীন রাশিয়ার সবচেয়ে বড় অ-ইউরোপীয় ক্রেতা। ২০২১ সালে এশিয়া ও ওশেনিয়া অঞ্চলে বিক্রি করা রাশিয়ার তেলের ৩৮ শতাংশের গ্রাহক ছিল চীন।
রাশিয়া বর্তমানে সৌদি আরবের পর চীনের দ্বিতীয় বৃহত্তম তেল সরবরাহকারী। তবে বিশেষজ্ঞদের বিশ্বাস, আগামী বছরগুলোয় মধ্যপ্রাচ্যের প্রতিদ্বন্দ্বীদের ছাড়িয়ে চীনের প্রধান তেল সরবরাহকারী হয়ে উঠাই ক্রেমলিনের মূল লক্ষ্য।
মস্কোর আরেকটি বড় লক্ষ্য হবে ভারতের কাছে বিক্রির পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি করা। ১.৩৮ বিলিয়ন জনসংখ্যার দেশটি বিশ্বে জ্বালানি তেলের তৃতীয় বৃহত্তম ভোক্তা, যার বেশিরভাগই ভারতকে আমদানি করতে হয়।
ইরাক, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত হলো ভারতের বৃহত্তম সরবরাহকারী। ২০২১ সালে রাশিয়া ভারতের আমদানিকৃত তেলের মাত্র ২ শতাংশ সরবরাহ করে। কিন্তু এরই মধ্যে পরিবর্তন শুরুর লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। ভারত ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের নিন্দা জানায়নি। অন্যদিকে মার্চ ও এপ্রিলে দেশটির রাশিয়ান তেল কেনা নাটকীয়ভাবে বেড়েছে।
পশ্চিমা দেশগুলো রাশিয়ার অপরিশোধিত তেল এড়িয়ে যাওয়ায়, ভারতীয় তেল পরিশোধনকারীরা ছাড়সহ তেল কিনতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে।
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভিস সেন্টার ফর রাশিয়ান অ্যান্ড ইউরেশিয়ান স্টাডিজের সহযোগী মার্গারিটা বালমাসেদা বলেন, বহু দেশ ও প্রতিষ্ঠান এড়িয়ে গেলেও দুটি বড় ভারতীয় তেল শোধনাগার সম্প্রতি সাখালিন দ্বীপ থেকে আসা রাশিয়ার সোকোল তেলের বড় একটি কার্গো কিনেছে।
তবে, চীন ও ভারতের মতো দেশগুলো ইউরোপীয় বাজারকে পুরোপুরি প্রতিস্থাপন করতে পারবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।
র্যাপিডান এনার্জি কনসাল্টেন্সি ফার্মের ভূরাজনৈতিক ঝুঁকি বিশ্লেষক ফার্নান্দো ফেরেরা বলেন, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গে চীন ও ভারতের তেলনির্ভর বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপনে কয়েক দশক সময় লেগেছে।
"আমি মনে করি উভয় দেশই রাশিয়ার জ্বালানির জন্য মধ্যপ্রাচ্যের সরবরাহকারী দেশগুলোকে ফিরিয়ে দেওয়ার আগে সতর্কভাবে চিন্তা করবে," তিনি বলেছিলেন।
এছাড়া, পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার ফলে রাশিয়া কীভাবে তেল উৎপাদনের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম ও প্রযুক্তি কিনবে তাও বাড়তি সমস্যার সৃষ্টি করবে বলে তিনি মনে করেন।
"পশ্চিমা প্রযুক্তির সাহায্য ছাড়াই সরবরাহ ঠিক রাখতে রাশিয়াকে বহু কাঠখড় পুড়াতে হবে," বলেন তিনি।
রাশিয়ার সামনে কঠিন দিন
তবে গ্যাসের চেয়ে রাশিয়ার জন্য তেলের নতুন বাজার খুঁজে পাওয়া সহজ হবে। পাইপলাইনের মাধ্যমে প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহ সুবিধাজনক নয়। একই সঙ্গে রাশিয়া এলএনজি (তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) উৎপাদন সক্ষমতাতেও প্রতিদ্বন্দ্বীদের থেকে পিছিয়ে রয়েছে। সেক্ষেত্রে তেলের বাজারে তেল সরবরাহ করা অপেক্ষাকৃত সহজ হবে।
রাশিয়া যদি গ্যাসের ইউরোপীয় বাজার প্রতিস্থাপন করতে চায়, তবে সবচেয়ে বড় বাজি হবে সম্ভবত চীন। ফেব্রুয়ারিতে বেইজিং ও মস্কো একটি নতুন পাইপলাইনের মাধ্যমে চীনে গ্যাস সরবরাহের জন্য রাশিয়ার সঙ্গে ৩০ বছরের চুক্তি ঘোষণা করেছে। ইউরোর মাধ্যমে লেনদেন হবে বলেও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
পাকিস্তানের সঙ্গেও জ্বালানি গ্যাস নিয়ে রাশিয়ার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। রাশিয়া দুই বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে পাকিস্তানে পাইপলাইন স্থাপনে সম্মত হয়েছে যা দেশটির দক্ষিণের বন্দর নগর করাচি থেকে উত্তরাঞ্চলে এলএনজি পরিবহন করবে। প্রতিবেশী ভারতের মতো পাকিস্তানও রাশিয়ার ইউক্রেন আগ্রাসনের নিন্দা করেনি।
তবে বিশ্লেষকদের মতে, পশ্চিমা বিশ্ব থেকে সরে এসে প্রাচ্যে গ্যাস সরবরাহ বাড়ানোর যে স্বপ্ন রাশিয়া দেখছে তা সফল হওয়ার সম্ভাবনা কম। "বাস্তবতা হলো এই প্রকল্পগুলোর জন্য ব্যাপক অর্থায়নের প্রয়োজন এবং অর্থায়ন ছাড়া এগুলো সম্ভব নয়," বলেন বালমাসেদা।
তিনি আরও বলেন, তাত্ত্বিকভাবে ভবিষ্যতে চীন ও ভারতে গ্যাস সরবরাহে রাশিয়ার নতুন অবকাঠামো তৈরির সম্ভাবনা থাকলেও এর জন্য "ব্যাপক বিনিয়োগ" প্রয়োজন, যা রাশিয়ার অর্থনৈতিক অবস্থা দেখে বাস্তবসম্মত বলে মনে হয় না।
ফেরেইরা বলেন, এশিয়ায় গ্যাস সরবরাহে রাশিয়ার একমাত্র বাস্তবসম্মত পথ হবে চীন ও পশ্চিম সাইবেরিয়ার মধ্যে পুরোনো বা নতুন পাইপলাইন স্থাপন।
"এর জন্য সময় লাগবে। রাশিয়ার গ্যাসের জন্য কোনো স্বল্পমেয়াদী সমাধান নেই," বলেন তিনি।
জ্বালানি খাতে প্রাধান্য হারাবে রাশিয়া?
দীর্ঘমেয়াদী ফলাফল বিচার করলে বৈশ্বিক জ্বালানি খাতে রাশিয়া প্রাধান্য হারাবে।
"বর্তমানে তারা জ্বালানির পাওয়ার হাউজ হিসেবে যে ভূমিকা পালন করছে, স্বাভাবিকভাবেই তা হারাবে। এর কারণ এই নয় যে তাদের কাছে জ্বালানি থাকবে না। বরং এই কারণে যে, জ্বালানি উত্তোলনের সরঞ্জামাদি বা বিক্রির বাজার কোনোটাই পাবে না রাশিয়া," বলেন ফেরেইরা।
"রাশিয়ান এনার্জি চেইনস: দ্য রিমেকিং অব টেকনোপলিটিক্স ফ্রম সাইবেরিয়া টু ইউক্রেন টু ইউরোপীয় ইউনিয়ন" শিরোনামে রাশিয়ার জ্বালানির ওপর প্রকাশিত বইয়ের লেখিকা বালমাসেদা অবশ্য বিষয়টি নিয়ে সন্দিহান।
তিনি বলেন, "ইউরোপের বাজারে রাশিয়া আবারও গ্রহণযোগ্য হবে, যদি না রুশ বিরোধী গোষ্ঠীগুলো কয়লা উৎপাদনকারী, নবায়নযোগ্য জ্বালানি বা এলএনজি উৎপাদনকারীদের সমন্বয়ে শক্তিশালী জোট গঠনের মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদে নীতিনির্ধারকদের রাশিয়া থেকে দূরে থাকতে রাজি করাতে সক্ষম হয়।"
তিনি সাঙ্ক কস্ট বা বিসর্জিত ব্যয়ের উদাহরণ দিয়ে বলেন - অর্থ বিনিয়োগ করা হয়েছে কিন্তু পুনরুদ্ধার সম্ভব নয়, এমন বিবেচনায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান রাশিয়া থেকে আসা বিদ্যমান পাইপলাইনগুলো সচল রাখতে উদ্যোগী হতে পারে।
তিনি সতর্ক করে বলেন, ইউরোপীয় সরকার ও প্রতিষ্ঠানগুলোকে সিদ্ধান্তে অটল থাকতে চাইলে বিকল্প জ্বালানি ব্যবস্থাতেও যত তাড়াতাড়ি সম্ভব প্রচুর পরিমাণে বিনিয়োগ করতে হবে।
হাঙ্গেরি ও সার্বিয়ার মতো কেন্দ্রীয় ও পূর্ব ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশ ভবিষ্যতে রাশিয়ান গ্যাস কিনতে ইচ্ছুক, যা ইতোমধ্যেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
হাঙ্গেরি গত বছর ইউক্রেনের ওপর দিয়ে যাওয়া পাইপলাইনের মাধ্যমে রাশিয়ান গ্যাস নিতে মস্কোর সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করে। বুধবার হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর অরবান জানান, গ্যাসের জন্য ভ্লাদিমির পুতিনের শর্ত মোতাবেক মে মাসে সময় অনুযায়ী রাশিয়ান জ্বালানি সংস্থা গ্যাজপ্রমের অর্থ পরিশোধ করা হবে।
তুলনামূলক ছোট দেশ হলেও বিষয়গুলো ঘটছে।
- সূত্র: ডয়চে ভেলে