অবরোধের একশো বছর
উত্তর কোরিয়া এবং ইরানের বিরুদ্ধে অবরোধ আঁটোসাঁটো করেছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প; ভেনেজুয়েলিয় নেতৃবৃন্দের সম্পদ জব্দ করেছেন, এবং কিউবা, রাশিয়া ও সিরিয়ার কর্মকর্তাদের দিকে শ্যান দৃষ্টি দিয়েছেন। অবরোধ তালিকায় এক হাজারেরও বেশি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নাম যোগ করেছে ট্রাম্প প্রশাসন। নিজের আপাত সীমাহীন ক্ষমতায় প্রেসিডেন্ট ভীষণ গর্বিত। ২০১৯ সালের অক্টোবরে 'তুর্কী অর্থনীতি সম্পূর্ণ ধ্বংস, নিশ্চিহ্ন' ('আমি আগেও একাজ করেছি!') করার হুমকি দিয়ে সিরিয় কুর্দিদের বিরুদ্ধে তুর্কী হুমকির প্রতি প্রতিক্রিয়ায় দেখিয়েছেন ট্রাম্প।
বিদেশীদের বাণিজ্যিক নেটওয়ার্ক এবং বৈশ্বিক আর্থিক ব্যবস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন করা নজীরবিহীন মাত্রায় ওয়াশিংটনের বিদেশ নীতির পছন্দনীয় কৌশল হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাস্তবিক ক্ষেত্রে রাশিয়ার মতো অল্প কয়েকটি ক্ষেত্রে প্রশাসন অবরোধ আরোপ থেকে বিরত থাকলেও সেসব বিতর্কেরই জন্ম দিয়েছে।
বাকি দুনিয়ার সাথে আমেরিকার সম্পর্কের ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক অবরোধ কেন এত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়াল? বৈশ্বিক অর্থনীতির সাম্প্রতিক অবস্থা এবং ওয়াশিংটনকে বাকি বিশ্বের উপর অর্থনৈতিক কর্তৃত্ব আরোপের ক্ষমতা দেওয়া মার্কিন আইনেই রয়েছে এর উত্তর ।
তবে একটি গভীরতর জবাব পেতে শত বছরের পরিক্রমায় অবরোধের ধারণা ও রেওয়াজ কিভাবে দেখা দিল তার একটা ধারণা থাকা প্রয়োজন। ঐতিহাসিকভাবে অবরোধ একাধারে আদর্শবাদীর স্বপ্ন এবং বাস্তববাদী অস্ত্রের ভূমিকা পালন করে এসেছে। ক্ষমতাহীনকে যুদ্ধ ও বৈষম্যমুক্ত একটি পৃথিবী উপহারের প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পাশাপাশি অবরোধ শক্তিমানকে যুগিয়েছে আধিপত্য বিস্তারের উপায়। অবরোধের বৈধতা এবং আবেদন দুটোই পরিণতির অস্পষ্ট সীমারেখায় অবস্থান করে। ওয়াশিংটন যত বেশি একতরফা অবরোধের দিকে ঝুঁকবে, এই রীতির বৈধতা হয়তো ততই কমতে থাকবে।
অবরোধের সূচনা
অর্থনৈতিক রাজনীতি-রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলে আর্থিক কিংবা বাণিজ্যিক চাপ প্রয়োগ-খোদ বাণিজ্যের মতোই প্রাচীন বিষয়। তবে বিশ শতকের আগে অধুনিক অবরোধের ধারণা, অর্থাৎ, বৈশ্বিক শৃঙ্খলা আরোপের লক্ষ্যে সমন্বিতভাবে অর্থনীতিতে প্রবেশাধিকারের অস্বীকৃতি-লক্ষণীয় হয়ে ওঠেনি।
কূটনীতিক এবং সমরবিদরা অর্থনৈতিক স্বাধীনতাকে ভিন্ন চোখে অর্থাৎ সম্পূরক যুদ্ধের কৌশল হিসাবে দেখেছেন। ব্রিটিশ নৌবাহিনী বাণিজ্যিক জাহাজ পরিচালনায় ব্রিটেনের দাপট বাড়িয়ে এবং লন্ডনের অর্থবাজারে বৈশ্বিক বাণিজ্যের নির্ভরতাকে কাজে লাগিয়ে জার্মানিকে পরাস্ত করার পরিকল্পনা নিয়েছিল। এখানে সহিংসতা এড়াতে নয়, বরং জনৈক ব্রিটিশ অ্যাডমিরালের ভাষ্যে, 'আপনার প্রতিপক্ষের গোটা জনগণের চোখে যুদ্ধকে নিন্দনীয় করে' তুলতে সেটিকে আরও বাড়ানোর উপায় হিসাবেই অর্থনৈতিক লড়াইকে কাজে লাগানোর পরিকল্পনা করা হয়।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শুরুর দিকে বাষ্প শক্তি ও টেলিগ্রাফির মতো নতুন প্রযুক্তি বিশ্বের বিভিন্ন দেশকে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা দেয়। নরম্যান আনজেলের মতো যুদ্ধ বিরোধী লেখকদের চোখে এই বাস্তবতা যুদ্ধকে নির্বুদ্ধিতা, এমনকি অসম্ভব বলে প্রমাণ করেছিল। উল্লেখ করা যেতে পারে, ১৯১০ থেকে ১৯১৩ মেয়াদে এই লেখকের দ্য গ্রেট ইল্যুশন ২ মিলিয়ন কপিরও বেশি বিক্রি হয়েছিল। যেকোনও বড় ধরনের বিরোধ এত ব্যয়বহুল হবে যে বিজয়ী পক্ষ কিছুতেই লাভবান হতে পারবে না।
যুদ্ধের পর ব্রিটিশ অবরোধ ভিন্ন অর্থ গ্রহণ করে। ব্রিটেন জার্মান অর্থনীতির টুটি চেপে ধরার কারণে দেখা দিয়েছিল ব্যাপক পুষ্টিহীনতা, কোনো কোনো অনুমান মতে তাতে কয়েক লক্ষ বেসামরিক মানুষ প্রাণ হারায়। বৈশ্বিক নিরাপত্তার নতুন যুদ্ধোত্তর ব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে ১৯১৯ সালে বিশ্ব নেতারা প্যারিসে একত্রিত হন। 'অর্থনৈতিক অস্ত্র-কে আগ্রাসীকে বাাগে আনার সবল অস্ত্র হিসাবেই দেখেছেন তারা।
লীগ অভ নেশন্স সনদের ১৬ নম্বর ধারা আগ্রাসী যুদ্ধের সূচনা ঘটানো যেকোনও দেশের বিরদ্ধে স্বয়ংক্রিয় এবং সমন্বিত অবরোধ আরোপের ক্ষমতা দিয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন বলেছিলেন, 'এটা ভয়ঙ্কর প্রতিকার হয়ে দাঁড়াবে।' 'অর্থনৈতিক, বণিজ্যিক অথবা ব্যক্তিগত সম্পর্ক' থেকে বিচ্ছিন্নতার মুখে, যুক্তি দেখানো হয়, বিভিন্ন দেশ প্রতিবেশীদের ত্রস্ত করার আগে দ্বিতীয়বার ভাববে।
অবরোধ এভাবে বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় বহুস্তরীয় প্রয়োগ কৌশলের কেন্দ্রবিন্দুর কাজ দিয়েছে।
জাতিসংঘের ব্যর্থতা
১৯২০ দশকের গোড়ার দিকে অর্থনৈতিক অবরোধের ভয় কিছু ছোট ছোট দেশকে তাদের প্রতিবেশী দেশের উপর আক্রমণ চালানো থেকে বিরত রাখে। কিন্তু লীগের বৃহত্তম অবরোধ শোচনীয়ভাবে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। ১৯৩৫ সালে ইতালি লীগের সদস্য এবং ইউরোপিয় উপনিবেশবাদ থেকে রক্ষা পাওয়া হাতে গোণা কয়েকটি আফ্রিকান দেশের অন্যতম ইথিওপিয়া আক্রমণ করে। ইথিওপিও নেতা হাইলে সেলাসি সাহয্য চেয়ে লীগের কাছে আবেদন জানান।
লীগ ৫০-৪ ভোটে ইতালির বিরুদ্ধে অবরোধ আরোপের সিদ্ধান্ত নেয়, ঋণ ও ইতালি থেকে অস্ত্রশস্ত্র ও ধাতব আকরসহ বিভিন্ন ধরনের পণ্য আমদানীর উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। কিন্তু লক্ষণীয়ভাবে তেলকে এই নিষেধাজ্ঞার বাইরে রাখে। ইতালির নিজস্ব পেট্রোলিয়াম সম্পদের অভাব থাকায় তেলের উপর নিষেধাজ্ঞা হয়তো যুদ্ধের ক্ষমতা নষ্ট করে দিতে পারতো। কিন্তু ব্রিটেন ও ফ্রান্স অবরোধে সমর্থন দিলেও সামগ্রিক অবরোধ ইতালির ফ্যাসিস্ট নেতা বেনিতো মুসোলিনিকে নাৎসি জার্মানির সাথে সখ্য গড়ে তুলতে প্ররোচিত করবে বলে ভয় পেয়েছিল।
সেলাসি 'ইতালিয় সরকারের হাতে ইথিওপিও স্বাধীনতা জলাঞ্জলি দেওয়ার' নিন্দা জানান, কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। ১৯৩৬ সালে ইতালিয় বাহিনী দখলদারি সম্পন্ন করে। লীগের এই ব্যর্থতা অবরোধের সীমাবদ্ধতার চেয়ে বরং অবরোধ আরোপের সমস্যাকেই তুলে ধরে। কিন্তু ব্যাপারটা আগ্রাসন প্রতিরোধের ক্ষেত্রে অর্থনেতিক অবরোধের শক্তিকে ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছিল।
যুদ্ধ মধ্যবর্তী অগ্রগতি
লীগের ব্যর্থতা সত্ত্বেও পেছনে তাকিয়ে মনে হয় যে মধ্যবর্তী সময় অবরোধের বিকাশে উর্বর মুহূর্ত হিসাবে প্রমাণিত হয়েছে।
প্রথমত, ইথিওপিয়ার পক্ষে সংগ্রাম বর্ণবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে জনমত ও অর্থনৈতিক শক্তি গড়ে তোলায় অঙ্গীকারাবদ্ধ একটি আন্তর্জাতিক আন্দোলনের জন্ম দেয়। অন্যান্য এলাকার পাশাপাশি নিউ ইয়র্ক, ঘানা, এবং ভারতে ধর্মঘট ও বিক্ষোভ মিছিল হয়। বুদ্ধিজীবীরা সংহতি ও ঐকবদ্ধ তৎপরতার উপর নিবন্ধ রচনা করেছেন। কিছু আমেরিকান ইথিওপিও বাহিনীর সাথে মিলে স্বেচ্ছায় যুদ্ধ করেছেন। অ্যাক্টিভিস্টরা জাতীয় সরকার ও লীগে লবিং করেছেন। সাংবাদিক রোয় অটলি বলেছেন, ইথিওপিয়ার অবস্থা 'কৃষ্ণ আমেরিকানদের সকল স্তরকে' তার স্মৃতির অন্য যেকোনো ঘটনার চেয়ে ঢের বেশি আলোড়িত করেছে।
এইসব প্রয়াস ইথিওপিয়াকে রক্ষায় ব্যর্থ হলেও দীর্ঘস্থায়ী আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে এবং অর্থনৈতিক তৎপরতা দুর্বলের অস্ত্র হতে পারার একধরনের ধারণা গড়ে তুলতে সাহায্য করেছে। এই ধারণাটিকে বিভিন্ন কমিউনিস্ট সংগঠক আরও সামনে নিয়ে গেছেন। এইসব আন্দোলনের বেশ কয়েকটিরই সমর্থক ছিলেন এরা। ১৯৪৫ সালে যুক্তরাজ্যের ম্যানচেস্টারে অনুষ্ঠিত প্যান আফ্রিকান কংগ্রেসের মূল সিদ্ধান্ত হিসাবে শ্রমিকদের স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়, 'আপনাদের অস্ত্র-ধর্মঘট এবং বয়কট-দুর্জয়।'
এই সময়ে শান্তির সময়ে একতরফাভাবে অর্থনৈতিক যুদ্ধ পরিচালনার নতুন ক্ষমতা পেয়ে আমেরিকান সরকারও বদলে গেছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় কংগ্রেস 'শত্রুপক্ষের সাথে বাণিজ্য আইন' পাস করে। এই আইন জার্মানির সাথে বাণিজ্যই শুধু রুদ্ধ করেনি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থিত জার্মান সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার কর্তৃত্বও দিয়েছিল।
ভবিষ্যৎ অ্যাটর্নি জেনারেল এ. মিচেল পামার অ্যালিয়েন প্রপার্টি কাস্টোডিয়ান পদে এইসব সম্পদ ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে ছিলেন। নিউ ইয়র্ক টাইমস তার ক্ষমতার পরিধিতে বিস্ময় প্রকাশ করে। যুগপৎ 'বিশ্বের বৃহত্তম ট্রাস্ট সংস্থা, বিভিন্ন ধরনের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের পরিচালক, ডিটেক্টিভ এজেন্সি এবং কোর্ট অভ ইক্যুইটি' হিসাবে কাজ করেছে তার এই দপ্তর।
যুদ্ধের সময় মার্কিন সরকার রেলপথের উপর কর্তৃত্ব এবং সমনের মাধ্যমে সেনাবহিনীতে নিয়োগের কর্তৃত্বসহ বিভিন্ন ক্ষমতা পায়। কিন্তু এইসব আইন যুদ্ধকালীন ব্যবস্থা হিসাবেই বিবেচিত ছিল এবং ১৯১৮ সালে যুদ্ধ শেষ হলে বেশিরভাগ রদ হয়ে যায়।
শত্রুপক্ষের সাথে বাণিজ্য আইনের একটি বিধি অবশ্য বহাল থেকে গেছে। এই আইনের ধারা ৫(খ) প্রেসিডেন্টকে বিদেশী জাতির সাথে সম্পর্কিত সকল আর্থিক লেনদেন 'তদন্ত, নিয়ন্ত্রণ এবং বাতিল' করার ক্ষমতা দিয়েছে। এর কোমল ভাষা বিপুল ক্ষমতা দেওয়ার বাস্তবতা আড়াল করেছে।
মহামন্দাকালে সরকারী আইনজীবীরা অর্থনৈতিক সঙ্কট মোকাবিলায় প্রেসিডেন্টের ক্ষমতার খোঁজে যুদ্ধকালীন বিভিন্ন আইনে নজর চালাতে গিয়ে শত্রুপক্ষের সাথে বাণিজ্য আইনের হদিস পান।
১৯৩৩ সালে ফ্র্যাংকলিন রুজভেল্ট 'ব্যাংক হলিডে' ঘোষণা করে সাময়িকভাবে সকল ব্যাংকিং লেনদেন নিষিদ্ধ করার সময় ৫(খ) ধারার কথা উল্লেখ করেছেন। কংগ্রেস এরপর প্রেসিডেন্টের পদক্ষেপে সমর্থন জানিয়ে আইন পাস করে ধারা ৫(খ) সংশোধনের মাধ্যমে 'যুদ্ধের সময় অথবা প্রেসিডেন্ট ঘোষিত যেকোনও জাতীয় জরুরি অবস্থায়' এই আইনের আশ্রয় গ্রহণের বিষয়টি খোলাসা করে। ইউরোপে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে এই ব্যাপক কর্তৃত্বের তাৎপর্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
১৯৪০ সালে নাৎসি জার্মানি ডেনমার্ক ও নরওয়েতে হামলা চালালে নির্বাহী আদেশ জারির মাধ্যমে রুজভেল্ট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ড্যানিশ ও নরওয়েজিয় সম্পদ জব্দ করেন। নাৎসি দখলদারি বিস্তার লাভ করার সাথে সাথে আমেরিকান এই জব্দের বিষয়টিও বিস্তৃত হয়। ১৯৪১ সাল নাগাদ গোটা ইউরোপ মহাদেশই এর আওতায় এসে পড়ে। ট্রেজারি ডিপার্টমেন্টে ফরেইন ফান্ড কন্ট্রোল নামে একটি নতুন বিভাগের মাধ্যমে সমন্বিত এইসব তৎপরতা মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার অর্থ নাৎসিদের নাগালের বাইরে রেখে দিয়েছে।
গুরুত্বপূর্ণ একটি নজীরও সৃষ্টি করেন তারা: যুক্তরাষ্ট্রে শান্তি বিরাজ করলেও শত্রুপক্ষের সাথে বাণিজ্য আইন প্রয়োগ করে কংগ্রেসের অনুমোদন ছাড়াই মার্কিন প্রেসিডেন্ট যেকোনো মুহূর্তে বিদেশী সম্পদ জব্দ করতে পারবেন।
১৯৪১ সালের জুলাই মাসে জাপান ইন্দোনেশিয়ায় হামলা চালানোর পর যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থিত জাপানি সম্পদ জব্দ করা হয়। এর ফলে জাপানের পক্ষে তেল ও অন্যান্য কৌশলগত সরঞ্জাম কেনা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। এই পদক্ষেপ জাপানি কট্টরপন্থীদের সরকারকে পার্ল হারবারের আক্রমণ চালাতে সম্মত করতে সহায়ক হয়েছিল। রুজভেল্ট স্বাধীনতার প্রতি হুমকির বিরুদ্ধে তার এই পদক্ষেপের পক্ষে সাফাই গাইলেও জাপানিরা সম্পদ বাজেয়াপ্তির সিদ্ধান্তকে আমেরিকান শক্তির আগ্রাসী প্রয়োগ বলে তর্জমা করে।
ঠাণ্ডা লড়াইয়ের সহায়তায় অবরোধ
ঠাণ্ডা লড়াইয়ের সময় কংগ্রেস বেশ কিছু প্রতিদ্বন্দ্বী দেশের বিরুদ্ধে প্রেসিডেন্টকে অবরোধ আরোপের জরুরি ক্ষমতা দিয়ে আইন জারি করে।
১৯৪৯ সালে রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ আইন শত্রুপক্ষের সাথে মার্কিন বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণের কর্তৃত্ব আরও বাড়িয়ে তোলে। ওয়াশিংটন পশ্চিম ইউরোপিয় দেশগুলোকে সোভিয়েত ব্লকভুক্ত দেশে রণকৌশলগত বিভিন্ন সামগ্রী রপ্তানি সীমিত করতে সহযোগিতায় সম্মত করতে সফল হয়, যদিও শেষমেশ সোভিয়েত অস্ত্র ভাণ্ডার বৃদ্ধি ব্যাহত করার স্বপ্ন অপূর্ণই থেকে গেছে। উত্তর কোরিয়া এবং চীন প্রায় পূর্ণাঙ্গ বাণিজ্য অবরোধের মোকাবিলা করে। তৃতীয় কোনও দেশের ভেতর দিয়ে চোরাচালান হতে পারে ভেবে ১৯৫০-র দশকে সয়া সস এবং লিচুর মতো পণ্যসহ সব ধরনের 'চীনা ধরনের' আমদানী পণ্য মার্কিন বাণিজ্য কর্মকর্তাদের তল্লাশির শিকার হয়।
এইসব অবরোধ পরিচালনার লক্ষ্যে ট্রেজারি ডিপার্টমেন্টে অফিস অভ ফরেইন অ্যাসেট কন্ট্রোল নামে একটি নতুন আমলাতান্ত্রিক দপ্তরের উদয় ঘটে। সময় পরিক্রমায় আইনী কর্তৃত্ব অনেক সময় প্রতিষ্ঠা লগ্নের প্রাথমিক কারণকে অতিক্রম করে গেছে।
হ্যারি ট্রুম্যান কোরিয় যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর শত্রুপক্ষের সাথে বাণিজ্য আইন সক্রিয় করার লক্ষ্যে 'জাতীয় জরুরি অবস্থা' ঘোষণা করেন। প্রায় পোয়া শতক স্থায়ী সেই জরুরি অবস্থা ট্রুম্যানের উত্তরসুরিদের ভিয়েতনাম, ক্যাম্বোডিয়া ও কিউবার বিরুদ্ধে অবরোধ বিস্তারে আইনী কর্তৃত্ব যুগিয়েছে।
কিউবার বিরুদ্ধে আরোপিত অবরোধগুলোর মতো অবরোধ এখনও জারি রয়েছে। একতরফাভাবে অথবা মিত্রদের সহায়তায় আরোপিত এইসব অবরোধ কর্মসূচি মার্কিন কৌশলগত স্বার্থই রক্ষা করেছে।
আত্মনির্ভরতার লক্ষ্যে অবরোধ
১৬৬০-র দশকে আবার বৈশ্বিক আদর্শ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অবরোধ প্রয়োগের আশা দেখা দেয়। আফ্রিকা ও এশিয়ায় ইউরোপিয় সাম্রাজ্যগুলোর অবসানে কয়েক ডজন নতুন দেশ জাতি সংঘের সাধারণ অধিবেশনে আসন গ্রহণ করে। এই দেশগুলো জাতিগত সাম্য ও আত্মনির্ভরতা অর্জনে তাদের ক্রমবর্ধমান প্রভাব কাজে লাগায়।
দক্ষিণ আফ্রিকার সংখ্যালঘু শ্বেতাঙ্গ সরকারের বর্ণবাদী নীতি পরিণত হয় প্রাথমিক লক্ষ্যে। আফ্রিকান ডায়াস্পোরা, শ্বেতাঙ্গ উদারবাদী এবং বিভিন্ন ট্রেড ইউনিয়নের সমন্বয়ে একটি আন্তর্জাতিক আন্দোলনের চোখে অবরোধ পরিবর্তনে বাধ্য করার অহিংস উপায় মনে হয়েছে। বর্ণবাদের অবসান, বলেছেন আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট অ্যালবার্ট লুতুলি, 'শ্বেতাঙ্গদের তরফ থেকে কখনওই আপসে আসবে না। তারপরেও শান্তিপূর্ণভাবেই এর আগমন ঘটানো যেতে পারে।' ১৯৬২ সালে সাধারণ পরিষদ দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপের পক্ষে বিপুল অনুমোদন দেয়।
৪১ ধারার অধীনে জাতিসংঘ 'পূর্ণাঙ্গ বা আংশিক অর্থনৈতিক সম্পর্ক এবং রেল, সমুদ্র, বিমান, ডাক, টেলিগ্রাফিক, বেতার ও অন্যান্য যোগাযোগ ব্যবস্থা ব্যাহত এবং কূটনৈতিক সম্পর্কচ্ছেদ' আরোপ করতে পারে। অবশ্য কেবল নিরাপত্তা পরিষদই জাতি সংঘের সকল সদস্যের অবশ্য পালনীয় বাধ্যতামূলক অবরোধ আরোপের কর্তৃত্ব রাখে। নিরাপত্তা পরিষদের আশীর্বাদ ছাড়া সাধারণ পরিষদের অবরোধ আরোপের আহ্বান স্বেচ্ছামূলক থেকে যাবে।
যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্র বর্ণবাদ বিরোধী অ্যাক্টিভিস্টদের পক্ষে সমস্যা ছিল। নিরাপত্তা পরিষদের ভেটো দেওয়ার ক্ষমতা বিশিষ্ট পাঁচটি দেশের ভেতর এদুটি দেশই অবরোধের বিরোধিতা করে।
ব্রিটেন একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য সহযোগীর বিরুদ্ধে অবরোধ আরোপের ফলে তার নিজস্ব অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ভীতিতে ছিল। মার্কিনী কারণগুলো ছিল আরও জটিল। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর আনুগত্য লাভে সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে প্রতিযোগিতায় ওয়াশিংটন আফ্রিকান সরকারগুলোর বিচ্ছিন্নতার ভয় করছিল। তাসত্ত্বেও কেনেডি ও জনসন প্রশাসন অবরোধের পক্ষে লবিং করা মার্কিন সিভিল রাইটস নেতাদের শান্ত করার চেষ্টা করেছে। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বৈধতাকে হেয় করার আশঙ্কায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভেটো ক্ষমতা প্রয়োগে অনীহ ছিল-এমনটা কখনওই করেনি তারা।
তবু ব্রিটেন ছিল ঠাণ্ডা লড়াইয়ের গুরুত্বপূর্ণ মিত্র এবং কোনও দেশের অভ্যন্তরীণ নীতি অবরোধ দাবী করার পক্ষে আন্তর্জাতিক শান্তির প্রতি যথেষ্ট ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ার ধারণায় সমর্থন জানানো বহু কর্মকর্তার কাছে বিপজ্জনক ঠেকেছে। স্বেচ্ছা অস্ত্র অবরোধ সমর্থন এবং বিভিন্ন কমিশন ও স্টাডিগ্রুপকে দূরে সরিয়ে রেখে ব্রিটেন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিরাপত্তা পরিষদে ভোটের মাধ্যমে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে অবরোধ আরোপ প্রতিহত করে।
কয়েক বছর পর, জাতি সংঘ অবশেষে প্রথমবারের মতো বাধ্যতামূলক অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করে। ১৯৬৫ সালে দক্ষিণ রোডেশিয়ার ব্রিটিশ উপনিবেশ যুক্তরাজ্য থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করে। ইয়ান স্মিথের নেতুত্বে প্রায় ২ লক্ষ শ্বেতাঙ্গ রোডেশিয় ৪০ লক্ষেরও বেশি সংখ্যাগরিষ্ঠ কৃষ্ণাঙ্গ রোডেশিয়দের শাসন করছিল। রোডেশিয় আইন শ্বেতাঙ্গ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে ভোট ও সম্পত্তির একচেটিয়া অধিকার দিয়েছিল।
এবার জাতি সংঘে নেতৃত্ব গ্রহণ করে যুক্তরাজ্য। সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন সংক্রান্ত একটি পরিকল্পনা খাড়া না করা পর্যন্ত রোডেশিয়াকে স্বাধীনতা দিতে অস্বীকৃতি জানায় তারা। স্মিথের একতরফা স্বাধীনতা ঘোষণায় ক্ষিপ্ত ব্রিটিশ প্রধান মন্ত্রী হ্যারল্ড উইলসন জাতি সংঘকে রোডেশিয়ার বিরুদ্ধে ১৯৬৬ সালে বাধ্যতামূলক অর্থনৈতিক অবরোধে পর্যবসিত বিভিন্ন ধরনের শাস্তি দিতে চালিত করেন। উইলসন আরও চরম পদক্ষেপ প্রতিহত করতেই অবরোধের পক্ষে জোর দিয়েছিলেন বলে কোনো কোনো পণ্ডিত মনে করেন। বহু আফ্রিকান দেশ ব্রিটিশ সামরিক হস্তক্ষেপের আশা করেছিল।
অবরোধ কার্যকর হওয়ার ব্যাপারে সন্দেহ থাকলেও-ঐতিহাসিকভাবেই 'অবরোধ (ইথিওপিয়া এবং কিউবা) অকার্যকর প্রমাণিত হয়েছে,' লিখেছেন জনৈক মার্কিন কর্মকর্তা-ওয়াশিংটন ব্রিটিশ মিত্রকে সমর্থন দিয়েছে। রোডেশিয়ার বিরুদ্ধে অবরোধে সমর্থন দান উন্নয়নশীল দেশগুলোর চোখে মার্কিন মর্যাদা রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ছিল। 'রোডেশিয়া সে অর্থে আমাদের কাছে তত গুরুত্বপূর্ণ নয়,' উপসংহার টেনেছেন জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের কর্মকর্তা রবার্ট কোমার। 'কিন্তু বাকি সব আফ্রিকানের বেলায় এটা গুরুত্ববহ।'
পূর্বসুরি লীগ অভ নেশন্সের মতো জাতি সংঘের অবরোধ সংক্রান্ত প্রথম অভিজ্ঞতাও ছিল ব্যর্থতার। রোডেশিয়ার অর্থনীতি ধ্বংস এবং এর সরকারকে বিচ্ছিন্ন করলেও স্মিথ ঠিকই ক্ষমতায় থেকে গেছেন। বিশেষ করে দক্ষিণ আফ্রিকার ভেতর দিয়ে ব্যাপক চোরাচালানি অবরোধকে অকার্যকর করে দেয়।
বিশেষত রিচার্ড নিক্সন দায়িত্ব গ্রহণের পর মার্কিন প্রয়াস ধাক্কা খায়। ১৯৭০ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জাতি সংঘে প্রথমবারের মতো ভেটো প্রদানের ক্ষমতা প্রয়োগ করে। রোডেশিয়ার বিরুদ্ধে অবরোধ জোরালো করার প্রস্তাব এভাবে প্রতিহত করা হয়। ১৯৭১ সালে বায়ার্ড সংশোধনী পাসের মাধ্যমে কংগ্রেস রোডেশিয়া থেকে কৌশলগত সামগ্রী, বিশেষ করে ক্রোম আমদানীর সুযোগ তৈরি করে দেয়। জাতি সংঘের ব্যর্থতায় হতাশ হয়ে দক্ষিণ আফ্রিকা ও রোডেশিয়ার বিরোধী গ্রুপগুলো ক্রমবর্ধমান হারে সশস্ত্র সংগ্রামের দিকে ঝুঁকে পড়তে শুরু করে।
একতরফা অবরোধের বিস্তার
মার্কিন প্রেসিডেন্টরা আমেরিকার শত্রুর বিরুদ্ধে অবরোধ আরোপ অব্যাহত রাখেন। ১৯৭৯ সালে ইরানি বিপ্লবের পর ইসলামি প্রজাতন্ত্রের নতুন সরকার ৫২ জন আমেরিকান নাগরিককে জিম্মি হিসাবে আটক করলে প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংকগুলোয় গচ্ছিত ইরানি সম্পদ জব্দ করেন। তবে তাতে খুব একটা সুবিধা হয়নি।
১৯৮১ সালে পোল্যান্ডের কমিউনিস্ট সরকার বিভিন্ন সিভিল সোসাইটি গ্রুপের উপর নির্যাতন শুরু করলে রেগ্যান প্রশাসন সাইবেরিয়া থেকে পশ্চিম ইউরোপ পর্যন্ত গ্যাস পাইপলাইন নির্মাণে বাধা দিতে অবরোধ আরোপ করে সোভিয়েত ইউনিয়নকে শায়েস্তা করে। মার্কিন লাইসেন্সের অধীনে সরঞ্জাম নির্মাতারা এই অবরোধ মানতে অস্বীকার করলে বিভিন্ন ইউরোপিয় প্রতিষ্ঠানে প্রদত্ত ভর্তুকী অন্তর্ভুক্ত করার লক্ষ্যে অবরোধকে সম্প্রসারিত করা হয়। এতে করে আমেরিকার পশ্চিম ইউরোপিয় মিত্রদের তরফে ব্যাপক বিরোধিতা সৃষ্টি হলে রেগ্যান প্রশাসন অবরোধ তুলে নিতে বাধ্য হয়।
সমাজ বিজ্ঞানীরা অবরোধের আদৌ গুরুত্ব আছে কিনা, এই প্রশ্ন তুলতে শুরু করেন। এসব কি লক্ষ্য দেশকে তাদের নীতি বদলাতে চাপ সৃষ্টি করতে পেরেছে, নাকি প্রতিরোধকে উৎসাহ যোগানো শ্রেফ 'পতাকা ঘিরে মিছিল'-এর প্রভাব সৃষ্টি করেছে? ১৯৮০ দশকের গোড়ার দিকে জনৈক পণ্ডিত অবরোধকে 'শ্রেফ হুঙ্কার তোলা নখদন্তহীন বাঘের' সাথে তুলনা করেছেন।
অবশ্য অবরোধের অকার্যকারিতা, প্রেসিডেন্টদের অবরোধ আরোপের ইচ্ছায় সামান্যই বাদ সাধতে পেরেছে। ওয়াটারগেট ও ভিয়েতনামের ঘটনার পর প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা হ্রাসে কংগ্রেসের বিভিন্ন প্রয়াস সত্ত্বেও অর্থনৈতিক লড়াইয়ের ক্ষেত্রে প্রেসিডেন্টের নির্বাহী ক্ষমতা প্রয়োগ যথারীতি অক্ষুন্ন থেকে গেছে।
অন্য দেশে সামরিক বাহিনী মোতায়েনে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা সীমিত করে পাস করা ১৯৭৩ সালের ওয়ার পাওয়ার্স অ্যাক্ট এবং ১৯৭৬ সালের ন্যাশনাল ইমার্জেন্সি অ্যাক্টের মাধ্যমে ট্রুম্যানের ১৯৫০ সালের জরুরি অবস্থার অবসান ঘটিয়ে কংগ্রেস প্রেসিডেন্টের অবরোধ আরোপের ক্ষমতার দিকে নজর দেয়। ১৯৭৭ সালের ইন্টারন্যাশনাল ইকোনোমিক ইমার্জেন্সি পাওয়ার্স অ্যাক্ট-এর অধীনে প্রেসিডেন্টের পক্ষে শান্তির সময় শত্রুপক্ষের সাথে বাণিজ্য আইন বহাল করার উপায় ছিল না। এই নতুন আইনটি এর আগের আ্ইনের সমস্ত বিধান অপরিবর্তিত রাখলেও এটি পুনর্বহাল করার লক্ষ্যে প্রেসিডেন্টকে প্রতিবারই নতুন করে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করতে হবে। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে কংগ্রেসের সেই সিদ্ধান্ত রদ করার ক্ষমতা রয়েছে। সংস্কারবাদীরা যখন তখন প্রেসিডেন্টের খেয়ালখুশিমতো অবরোধ আরোপের ক্ষমতার অবসান ঘটানোর আশা করেছেন। কিন্তু এক দশকের ভেতর সুপ্রিম কোর্টের বেশ কিছু সিদ্ধান্ত প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা হ্রাসের বেশিরভাগ সীমাকেই খাটো করে, ফলে আইনটি যাকে প্রতিরোধের লক্ষ্যে প্রণয়ন করা হয়েছিল তাই হয়ে দাঁড়ায়: সীমাহীন অবারোধ আরোপের ক্ষমতা দান।
ক্ষমতা রয়েই গেছে। ২০১৯ সালের আগস্টে ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেন, যারা চীনে মার্কিন প্রতিষ্ঠানগুলোর উৎপাদন বন্ধ করায় তার ক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন করছেন, তাদের উচিত '১৯৭৭ সালের ইমার্জেন্সি ইকোনমিক পাওয়ার্স অ্যাক্টের দিকে নজর দেওয়া। বাত খালাস!'
অবরোধের দশক
ঠাণ্ডা যুদ্ধের অবসান অবরোধের পক্ষে নতুন সম্ভাবনা তৈরি করে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন আধুনিক গণতান্ত্রিক পুঁজিবাদই সফলভাবে সমাজ গঠনে সক্ষম, এই ধারণায় ইন্ধন যোগায়। সত্যি বলতে নিরাপত্তা পরিষদে সোভিয়েত ভেটো দেওয়ার ক্ষমতা লোপ পাওয়ায় বিভিন্ন মানবিক প্রকল্প বাস্তবায়নে জাতি সংঘের অবরোধ কাজে লাগানো সম্ভব হয়ে ওঠে।
প্রায় দশক মেয়াদী অর্থনৈতিক চাপের মুখে ১৯৯৪ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠানে বাধ্য হলে অবরোধের ভাবমূর্তি জোরালো হয়ে ওঠে। জাতিসংঘে নিন্দিত হলেও বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলন সফলভাবেই বিভিন্ন কোম্পানি ও দেশকে দক্ষিণ আফ্রিকার সাথে সম্পর্কচ্ছেদে সম্মত করতে পেরেছিল। পণ্ডিতরা এখনও গণতন্ত্রে উত্তরণে অবরোধের সুস্পষ্ট ভূমিকা নিয়ে বিতর্ক করলেও অবরোধের পক্ষাবলম্বনকারীরা সফল হয়েছেন বলেই মনে করেন।
এভাবে ১৯৯০ এর দশক পরিণত হয় 'অবরোধের দশকে'। জাতি সংঘের নিরাপত্তা পরিষদ অন্তত ডজনখানেক অবরোধ আরোপ করে। এর আগের দশকের অবরোধের সংখ্যা ছিল মাত্র দুটি। একটি রোডেশিয়ার বিরুদ্ধে, অপরটি ১৯৭৭ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে আরোপিত অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা।
যুগোস্লাভিয়া, রোয়ান্ডা এবং অ্যাঙ্গোলায় মানবাধিকার লঙ্ঘন; কুয়েতে ইরাকের অবৈধ আগ্রাসন, এবং সুদান, লিবিয়া এবং আফগানিস্তান সরকারের সন্ত্রাসে সমর্থন যোগানোর বিরুদ্ধেই এইসব অবরোধ আরোপ করা হয়। আরও একবার অবরোধ বৈশ্বিক আদর্শ প্রতিষ্ঠায় আশা হয়ে দেখা দেয়। কিন্তু দশক শেষে বিশেষজ্ঞরা এইসব কর্মসূচির বেশিরভাগের ফলপ্রসূতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করতে শুরু করেন।
সামলোচকরা এখন সত্যিই অবরোধের ব্যয়কে সবার নজরে আনতে শুরু করেছেন। অর্থনৈতিক তৎপরতাকে অচল করে অবরোধ বিভিন্ন মৈত্রীকে ক্ষতিগ্রস্ত এবং দুর্বলতমের ক্ষতি করেছে। মার্কিন রপ্তানিকারীরা তাদের বাজার রুদ্ধ করা এক তরফা মাকির্নী অবরোধের বিস্তারের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছেন। অন্যদিকে মিত্ররা কিউবা, ইরান, এবং লিবিয়ার বিরুদ্ধে অবরোধকে হেয় করা বিদেশী প্রতিষ্ঠানকে উদ্দেশ্য করে আরোপিত তথাকথিত গৌণ অবরোধ বিস্তারের সমালোচনা করেছে।
ফরেইন অ্যাফেয়ার্স-এ জাতীয় নিরাপত্তা কর্মকর্তা রিচার্ড হাআস 'অবরোধের উন্মাদনা'র নিন্দা করেছেন। হতাশ মার্কিন রপ্তানিকারীরা ইউএসএ এনগেজ নামে একটি নতুন মার্কিন লবিং গ্রুপ গঠন করেছেন, এই গ্রুপটি প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা হ্রাসের লক্ষ্যে 'অবরোধ সংস্কার আইন' শিরোনামে একটি আইনের পক্ষে কাজ করছে।
ইরাকের বিরুদ্ধে অবরোধ সবচেয়ে বিতর্কিত প্রমাণিত হয়েছে।
উপসারগরীয় যুদ্ধের পর ইরাকি সৈন্যদের কুয়েত থেকে বিতাড়িত করা হলেও সাদ্দাম ক্ষমতায় থেকে যান। জাতি সংঘের বিভিন্ন অবরোধ তেল বিক্রি ও পণ্য আমদানীতে ইরাকের ক্ষমতায় নাটকীয় সীমা আরোপ করে। রাসায়নিক, পারমাণবিক এবং জীবানু অস্ত্রের ভাণ্ডার গড়ে তোলা থেকে সাদ্দামকে বিরত রাখতে পরিকল্পিত এইসব অবরোধ ইরাকের সাধারণ মানুষের খাবার ও চিকিৎসায় ঘাটতি সৃষ্টি করে।
সমালোচকরা অর্ধ মিলিয়ন শিশুর মৃত্যুর জন্যে এইসব অবরোধকে দায়ী করেছেন। বাস্তব সংখ্যা হয়তো আরও কম কিন্তু, তবু সেটাও ভয়ানক। এর জবাবে জাতি সংঘ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তথাকথিত 'চৌকষ অবরোধে'র দিকে ঝুঁকে পড়ে। ব্যাংক হিসাব এবং অভিজাত গোষ্ঠীর ভ্রমণ সুবিধাই এর লক্ষ্য। চৌকষ অবরোধ সাধারণ নাগরিকের কম ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। কিন্তু সহযোগিতা আদায়ে যথেষ্ট ফলপ্রসূ হওয়ার বিষয়টি অস্পষ্ট রয়ে গেছে।
অর্থনৈতিক অবরোধ এবং মার্কিন শক্তি
এরপর ঘটল সেপ্টেম্বর ১১, ২০১১-র বিমান হামলার ঘটনাগুলো।
এরই পরিপ্রেক্ষিতে মার্কিন সরকার শক্তিশালী নতুন অর্থনৈতিক অবরোধ গড়ে তোলে। খাদ্য সামগ্রী পরিবহন এবং ব্যাংক হিসাব জব্দের মাধ্যমে ক্রিয়াশীল প্রথাগত অবরোধের বিপরীতে অর্থনেতিক অবরোধ ব্যক্তি কুশীলবকেই আইনপ্রয়োগকারীতে পরিণত করেছে। নতুন আইন ও নির্বাহী আদেশের উপর নির্ভর করে ট্রেজারি ডিপার্টমেন্ট ক্রমবর্ধমান দীর্ঘ 'স্পেশিয়ালি ডেজিগনেটেড ন্যাশনালস (এসডিএন)' এবং 'প্রাথমিক মানি লন্ডারিং প্রতিষ্ঠানের' তালিকা তৈরি করে।
এমনি কোনো একটি তালিকায় নাম থাকার মানে রীতিমতো অর্থনৈতিক আত্মহত্যার শামিল। এমনি চিহ্নিত ব্যক্তিদের সাথে শুধু মার্কিন নাগরিকদের অর্থনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন নিষিদ্ধ নয়, বরং বিদেশী ব্যাংক ও প্রতিষ্ঠানও এই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার ভীতি থেকে দূরে সরে থাকে।
অভ্যন্তরীণ মার্কিন আইনের উপর ভিত্তি করে নেওয়া একতরফা সিদ্ধান্তের এভাবে বৈশ্বিক গুরুত্ব তৈরি হয়েছে। তার কারণ বিশ্ব বাণিজ্য এবং অর্থনীতির একটা বিপুল অংশ ওয়াশিংটনের নজরদারীতে থাকা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ডলারে সম্পাদিত হয়ে থাকে। সিআইএ-র পরিচালক মাইকেল হেইডেনের মতে অর্থনৈতিক অবরোধ 'অনেকটা বিশ শতকের নিখুঁত নিশানাভেদী গোলার মতো' কাজ করেছে।
এইসব নতুন কৌশলের ক্ষমতা স্পষ্ট হয়ে ওঠার সাথে সাথে বুশ, ওবামা এবং ট্রাম্প প্রশাসন ক্রমবর্ধমান হারে এগুলোর উপর নির্ভরশীল হয়ে উঠেছেন। ২০০৫ সালে শ্রেফ মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগ তুলে ট্রেজারি ডিপার্টমেন্ট কোরিয়ান সম্পদধারী ম্যাকাও ভিত্তিক একটি ব্যাংকের পতন ঘটায়।
সেই ১৯৭৯ সাল থেকেই ইরান ক্রমাগত বিভিন্ন মার্কিন অবরোধ মোকাবিলা করে এসেছে। কিন্তু ২০১১ সালের পর নতুন অর্থনৈতিক অবরোধ এবং ইউরোপিয় মিত্রদের সহযোগিতার মিশেল দেশটিকে আলোচনার টেবিলে বসতে বাধ্য করে অবরোধ শিথিলের শর্তে পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচি বন্ধ করার মতো যথেষ্ট চাপ সৃষ্টি করে।
ইউরোপিয় প্রতিবাদ সত্ত্বেও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ২০১৮ সালে ইরানের সাথে সম্পাদিত পারমাণবিক শক্তি চুক্তি থেকে সরে এলে মার্কিন অর্থনৈতিক অবরোধের পূর্ণ শক্তি পরিষ্কার হয়ে ওঠে। কেবল ইরানি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধেই অবেরোধ আরোপ করা হয়নি, তাদের সাথে ব্যবসায় নিয়োজিত যোকোনো ইউরোপিয় প্রতিষ্ঠানও অর্থনৈতিক ব্ল্যাক মেইলিংয়র মোকাবিলা করে। ইউরোপিয়রা তলে তলে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। ফরাসি অর্থমন্ত্রী ব্রুনো লে মেয়ারে বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই গ্রহের পুলিসে পরিণত হওয়া গ্রহণযোগ্য নয়। তবে তিনি মেনে নেন। ইরানের তেল রপ্তানির পরিমাণ অর্ধেকেরও বেশি কমে যায়।
এদিকে এসডিএন তালিকা ক্রমশ বড় হতে থাকে। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি নাগাদ এর পৃষ্ঠা সংখ্যা দাঁড়ায় ১,৩৪০। এমনি ক্ষমতার অধিকারী হয়ে টুইট বার্তায় তুরস্কের অর্থনীতি ধ্বংস করার ট্রাম্পের হুমকিকে মোটেই অবান্তর মনে হয়নি।
অবরোধের ভবিষ্যৎ
সবসেরা আদর্শিক রূপে অবরোধ মানবাধিকার লঙ্ঘন প্রতিরোধ করে বৈশ্বিক আদর্শ জাগিয়ে তোলার এক ধরনের সমন্বিত, অহিংস কৌশলের প্রতিশ্রুতি দেয়। প্রায়ই সেটা এই লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে। অনেক সময় নিরীহ মানুষের ভোগান্তি সৃষ্টি করে অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে অবদানও রেখেছে। কিন্তু অন্যান্য সময়ে, বিশেষ করে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক জোটের তরফ থেকে আরোপিত হলে, অবরোধ লক্ষ্য দেশের আচরণ পাল্টে দিতে সফল হয়েছে।
আমেরিকার বিপুল অথনৈতিক শক্তি এর নেতৃবৃন্দকে একতরফাভাবে অবরোধ আরোপে উৎসাহিত করেছে। নতুন অর্থনৈতিক অবরোধের ক্ষমতা বিশেষ করে তাদের ইদানীং জনপ্রিয় করে তুলেছে। কিন্তু ওবামা এবং ট্রাম্পের অধীনে অবরোধের ক্রমবর্ধমান ব্যবহারকে মার্কিন দুর্বলতার আলামত হিসাবেও বিবেচনা করা যেতে পারে।
অতি সম্প্রতি অকার্যকর ও রাজনৈতিকভাবে অজনপ্রিয় প্রমাণিত সামরিক তৎপরতার কোনো অঙ্গীকার ছাড়াই শত্রুর প্রতি অসন্তোষ প্রকাশ ও শাস্তি দেওয়া সম্ভব হয় বলেই অবরোধ অংশত নীতিনির্ধারকদের কাছে আবেদন সৃষ্টি করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একতরফা অবরোধের শক্তির মূলে রয়েছে মার্কিন ডলার। এই একচেটিয়া প্রভাব যতদিন বহাল থাকছে ততদিন সেই শক্তিও টিকে থাকবে।
অবরোধের উপর ওয়াশিংটনের সাম্প্রতিক নির্ভরতা সেগুলোর বৈধতাকে হেয় করেছে। আমেরিকার প্রতিদ্বন্দ্বী এবং মিত্র, সকলেই ডলার আধিপত্যাধীন আর্থিক বিনিময় ব্যবস্থার বিকল্পের সন্ধান করছে। যেমন রাশিয়া একটি নতুন আর্থিক আঞ্চলিক বিনিময় প্রতিষ্ঠায় তৎপর হয়ে উঠেছে। ইউরোপিয়রা ইরানের সাথে ডলার বিহীন বাণিজ্য সহজ করতে বিনিময় প্রথার আশ্রয় নিচ্ছে। ভেনেজুয়েলা ব্লকচেইন ভিত্তিক মুদ্রা চালু করেছে।
এ পর্যন্ত এসব চ্যালেঞ্জের কোনোটিই ফল বয়ে আনেনি। তবে যতদিন অবরোধেকে সমন্বিত মূল্যবোধ আরোপের বদলে বরং আমেরিকান শক্তির খেলা মনে হবে ততদিন সেগুলোর বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জও বহুগুণে বেড়ে উঠবে। মার্কিন নেতৃবৃন্দ অন্যান্য দেশকে সহযোগিতা করতে সম্মত করাতে না পারলে তারা হয়তো আমেরিকান বিদেশ নীতির মৌলিক অস্ত্র হিসাবে অবরোধের বিকল্প খুঁজতে বাধ্য হবেন।