একীভূতকরণের বিষয়ে সরকারের সিদ্ধান্ত চায় বেসিক ব্যাংক ও রাকাব
অন্য ব্যাংকের সঙ্গে প্রস্তাবিত একীভূতকরণের (মার্জার) বিষয়ে সরকারের অবস্থান স্পষ্ট করার অনুরোধ জানিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছে রাষ্ট্র-মালিকানাধীন দুই ব্যাংক বেসিক ব্যাংক লিমিটেড ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক (রাকাব)।
গত মাসের শুরুর দিকে একীভূতকরণের ঘোষণার পর ব্যাপকভাবে আমানত তুলে নেওয়ার বিষয়ে ব্যাংক দুটি উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তা সত্ত্বেও সরকারের পক্ষে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ যে সিদ্ধান্ত দেবে—তাতে একীভূত হোক বা না হোক—তা বাস্তবায়ন করবে বলে জানিয়েছে ব্যাংক দুটি।
এর আগে বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছিল, বেসিক ব্যাংক একটি বেসরকারি খাতের সিটি ব্যাংকের সঙ্গে এবং রাকাব রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের (বিকেবি) সঙ্গে একীভূত হবে।
গত সপ্তাহে বেসিক ব্যাংক ও রাকাব পৃথকভাবে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে চিঠি লিখে প্রস্তাবিত একীভূতকরণের বিষয়ে ব্যাংকগুলোর মালিক হিসেবে সরকারের অবস্থান স্পষ্ট করার অনুরোধ জানিয়েছে। ওই চিঠিগুলোর কপি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের হাতে এসেছে।
অস্বাভাবিকভাবে আমানত উত্তোলন নিয়ে উদ্বিগ্ন বেসিক ব্যাংক
গত ৭ মে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে দেওয়া পৃথক চিঠিতে বেসিক ব্যাংক বলেছে, গত ৮ এপ্রিল সরকারি এ ব্যাংকটিকে একটি বেসরকারি বাংকের সঙ্গে মার্জার করার সংবাদ প্রকাশ হওয়ার পর থেকে অস্বাভাবিকভাবে আমানত উত্তোলনের ফলে ব্যাংকটি গভীর সংকটে নিমজ্জিত হয়েছে।
বেসিক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও মো. আনিসুর রহমান স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়েছে, 'আমানতকারীরা ইতোমধ্যে প্রায় ২,৫০০ কোটি তুলে নিয়েছে। সরকারি বিভিন্ন দপ্তর, অধিদপ্তর ও সংস্থা আরও আমানত তুলে নেওয়ার জন্য ব্যাংকে চিঠি পাঠিয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে অন্য কোনো উৎস হতে নতুন করে আমানত পাওয়া যাচ্ছে না। তাছাড়া ব্যক্তি পর্যায়ে প্রতিনিয়ত আমানত উত্তোলন করা হচ্ছে।'
আনিসুর রহমান চিঠিতে বলেন, বেসরকারি ব্যাংকের সঙ্গে একীভূতকরণের সংবাদ প্রকাশিত হওয়াার কারণে গ্রাহকদের মধ্যে যে আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে, তাতে ব্যাংকের বিধিবদ্ধ তারল্য রিজার্ভ-এর (এসএলআর) ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ১,৮০০ কোটি টাকা।
চিঠিতে তিনি আরও বলেন, 'ইতোপূর্বে এ ব্যাংকে কখনও এসএলআরের ঘাটতি হয়নি বা চেক ডিজঅনারের ঘটনা ঘটেনি। বর্তমান পরিস্থিতির আশু উন্নতি না ঘটলে যেকোনো মুহূর্তে চেক ডিজঅনারের আশঙ্কা রয়েছে, যার ফলে ব্যাংকটির উপর আর কোনো ধরনের আস্থা অবশিষ্ট থাকবে না।'
এ অবস্থা চলতে থাকলে ব্যাংকটি অচিরেই গভীর সংকটে পড়বে এবং নেতিবাচক প্রভাব গোটা ব্যাংকিং খাতের ওপর পড়ার আশঙ্কা তৈরি হবে জানিয়ে মো. আনিসুর রহমান চিঠিতে লিখেছেন, 'এছাড়া উদ্ভূত পরিস্থিতি সামাল দেওয়া না গেলে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতাদি প্রদান করাও অনিশ্চিত অবস্থার মধ্যে পড়বে।'
চিঠিতে বেসিক ব্যাংক আরও বলেছে, 'এমতাবস্থায়, এই সৃষ্ট সংকট ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ায় বেসিক ব্যাংকের পক্ষে এককভাবে এ সংকট মোকাবিলা করা সম্ভব নয় বিধায় উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সরকারের আশু সায়তা প্রয়োজন।'
চিঠিতে 'একীভূতকরণ সংশ্লিষ্ট সংবাদটির বিষয়ে মালিকপক্ষ হিসেবে সরকারের অবস্থান স্পষ্টীকরণের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা'র অনুরোধ করেছেন বেসিক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক।
এছাড়া বেসিক ব্যাংকে সরকারি আমানত রাখার অনুরোধসহ স্বল্পসুদে সরকার থেকে আমানত সরবরাহসহ নীতি সহায়তা চেয়েছে ব্যাংকটি।
রাকাব বলছে দুর্বল ব্যাংকের সঙ্গে একীভূতকরণে সুফল আসবে না
গত ১ মে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব শেখ মোহাম্মদ সলিম উল্লাহর কাছে চিঠি পাঠিয়ে রাকাব তাদের আপত্তি বিবেচনায় নিয়ে একীভূতকরণের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে অর্থ মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করে।
আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ অবশ্য বিকেবির পাঠানো আরেকটি চিঠির জবাবে একীভূতকরণের বিষয়ে সম্মতি দিয়েছে।
রাকাবের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিরঞ্জন চন্দ্র দেবনাথ স্বাক্ষরিত চিঠিতে লেখা হয়েছে, ম্যানেজমেন্ট আশা করছে, রাকাব ২০২৪ সালের জুনে আর্থিক বছরের শেষ নাগাদ সমস্ত আর্থিক সূচকে উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে ব্রেকইভেন-এ চলে আসবে। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের সুস্পষ্ট নির্দেশনা হলো রাকাব ও বিকেবিকে জরুরি বোর্ড সভা ডেকে একীভূতকরণের পক্ষে স্ব-প্রণোদিত নীতিগত সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে হবে এবং সেই অনুযায়ী বাংলাদেশ ব্যাংককে অবহিত করতে হবে।
চিঠিতে বলা হয়েছে, গত ৩ এপ্রিল গভর্নরের সভাপতিত্বে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সভা ডেকে রাকাব ও বিকেবির ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং চেয়ারম্যানকে ব্যাংক দুটিকে একীভূত করার সিদ্ধান্তের কথা জানায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
চিঠিতে আরও বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় রাকাবের চেয়ারম্যান অন্যান্য ব্যাংকের অভিজ্ঞতা পর্যালোচনা করে একীভূতকরণের বিষয়ে ব্যাংকটির সিদ্ধান্তের রূপরেখা তুলে ধরে বক্তব্য উপস্থাপন করেন। জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তা, কৃষি উন্নয়ন, কৃষকের সামগ্রিক ক্ষমতায়ন এবং উত্তরাঞ্চলের অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে রাকাবের সরাসরি সম্পৃক্ততাকে এ সিদ্ধান্তের কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন চেয়ারম্যান। রাকাব বর্তমানে আধুনিক ব্যাংকিং পদ্ধতি গ্রহণ এবং ঋণ আদায়ের প্রচেষ্টা জোরদার করা, সিএমএসএমই খাতের ওপর জোর দেওয়া, নতুন ঋণ প্রদানের কর্মসূচি চালু এবং সার্বিক মনিটরিং ব্যবস্থা উন্নত করাসহ বিভিন্ন উদ্যোগ বাস্তবায়নের চেষ্টা করছে। এ প্রচেষ্টার ফলে সামগ্রিক পারফরম্যান্সের উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয় চিঠিতে।
গত ১৭ এপ্রিল বাংলাদেশ ব্যাংকের মৌখিক নির্দেশনা মেনে বিকেবির সঙ্গে একীভূতকরণের বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়ে আলোচনার জন্য বোর্ড সভা ডাকে রাকাব। বিকেবির মতো দুর্বল ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হওয়ার বিষয়ে উদ্বেগের কথা উল্লেখ করে একীভূতকরণের বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত নেয় বোর্ড।
একটি চিঠিতে রাকাব বলেছে, 'বোর্ড পর্যবেক্ষণ করেছে যে একীভূতকরণের উদ্দেশ্যগুলো অর্জনের জন্য একটি শক্তিশালী ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হওয়া প্রয়োজন। অন্যথায় একীভূতকরণের প্রাথমিক উদ্দেশ্য বিপন্ন হতে পারে।'
রাকাব বলেছে, তাদের বোর্ড বিকেবির সঙ্গে একীভূত হওয়ার বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যেহেতু রাকাব সম্পূর্ণ সরকারি মালিকানাধীন ব্যাংক, তাই সরকারই এর একমাত্র শেয়ারধারী। ব্যাংকটির সব প্রশাসনিক কার্যক্রম তত্ত্বাবধান করে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। রাকাবের বেশিরভাগ গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রমের জন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের লিখিত অনুমোদনের প্রয়োজন হয়।
চিঠিতে বলা হয়েছে, এই বিবেচনায়, বোর্ড সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে রাকাব ও বিকেবি একীভূত হওয়ার জন্য সরকারের, বিশেষ করে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের অনুমোদন, সিদ্ধান্ত বা পূর্ব-সম্মতি প্রয়োজন।
তাই বোর্ডের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করার আগে রাকাবকে বাংলাদেশ ব্যাংকের মৌখিক নির্দেশনা অনুসারে এ বিষয়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের আনুষ্ঠানিক অবস্থান জানতে সেখানে চিঠি পাঠাতে হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে এতে।
চিঠিতে বলা হয়েছে, 'রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক হিসেবে, রাকাবের একীভূতকরণের বিষয়ে সরকারের বিশেষ করে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হবে এবং সেই অনুযায়ী বাস্তবায়ন করা হবে।'
রাকাবের সঙ্গে একীভূত হতে বিকেবি বোর্ডের সবুজ সংকেত
দেশের বড় কৃষি খাতের সবচেয়ে বড় ঋণদাতাদের সঙ্গে একীভূত হতে রাকাবের আগ্রহ না থাকলেও বিকেবির বোর্ড সভায় একীভূতকরণের নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। গত ২৫ এপ্রিল ব্যাংকটির চেয়ারম্যান মো. নাসিরুজ্জামানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ব্যাংকের ৮৫৪তম বোর্ড সভায় এই অনুমোদন দেওয়া হয়। সভায় ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শওকত আলী খানসহ ছয়জন পরিচালক উপস্থিত ছিলেন।
ওই সভার কার্যবিবরণী টিবিএসের হাতে এসেছে। সভায় ব্যাংক দুটির একীভূতকরণের সম্ভাব্য ইতিবাচক দিক এবং চ্যালেঞ্জগুলো নিয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ আলোচনার পাশাপাশি ব্যাংকগুলোর ব্যবসায়িক কার্যক্রমের একটি বিশদ তুলনা উপস্থাপন করা হয়।
বোর্ড সভার কার্যবিবরণী অনুযায়ী, বিকেবি ও রাকাবের পরিচালন ব্যয় কমানো, বিস্তৃত ব্রাঞ্চ নেটওয়ার্ক স্থাপনের মাধ্যমে গ্রাহক সেবা বৃদ্ধি, রাজশাহী ও রংপুর বিভাগে রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধি এবং এ দুই বিভাগে কৃষি ও কৃষিভিত্তিক শিল্পের সার্বিক উন্নয়নের জন্য বৈদেশিক বাণিজ্য সম্প্রসারণ লক্ষ্যে রাকাব ও বিকেবির একীভূতকরণ অনুমোদন করেছে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একীভূতকরণের সিদ্ধান্ত
খেলাপি ঋণ কমাতে এবং ব্যাংকিং খাতে কর্পোরেট সুশাসন নিশ্চিত করতে একটি রোডম্যাপ ঠিক করেছে কেন্দ্রীয়। এর অংশ হিসেবে আগামী বছরের জানুয়ারির মধ্যে অন্তত ১০টি ব্যাংকের বলপূর্বক একীভূত করার পরিকল্পনার কথা গত মার্চের শুরুতে জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার গত ৪ মার্চ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এক সভায় বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের নেতৃবৃন্দকে এ পরিকল্পনা জানান। সভায় রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি ব্যাংকসহ সাতটি বাণিজ্যিক ব্যাংকের পরিচালকরা অংশ নেন।