করোনাকালের নোবেল লরিয়েট লুইস গ্লিক
আরো অনেকের মতো আমিও গণমাধ্যম প্রভাবিত মানুষ। গণমাধ্যমের হইচই, 'বুকিদের বাজির সংবাদ যতটুকু কানে পৌঁছেছে তাতে লুইস গ্লিক নোবেল পুরস্কার পেতে যাচ্ছেন এরা অনেকেরই আঁচ করার কথা নয়। আমিও ভাবিনি। আমি ১৯৯৩ সালে আমার প্রবাসবাসের দিনগুলোতে লুইস গ্লিক নামের একজন কবির কথা শুনি এবং কাগজেও পড়ি - তিনি কবিতার পুলিৎজার পুরস্কার পেয়েছেন।
১০ বছর পর ২০০৩ সালে দ্বিতীয়বার তার নাম আবার শুনি - তিনি আমেরিকার পোয়েট লরিয়েট হয়েছেন। আমি ধরেই নিই নিশ্চয়ই সরকারের সাথে ভালো সম্পর্ক - গুরুত্বপূর্ণ কবি হলে নিশ্চয়ই এই সম্মানটা এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করতেন। ১৯৯৩ সালের সংবাদ থেকে একটি পঙক্তি বেশ মনে পড়েছে তিনি বহু বছর অ্যানোরেক্সিয়া নার্ভোসা'য় (খাবারে অরুচি) ভুগেছেন। সে সময় প্রিন্সেস ডায়ানাও এরকম কঠিন নামের সহজ একটি রোগে ভুগতেন বলে রোগের নামটা অপরিচিত ছিল না।
২০০৩-র সতের বছর পর করোনাভাইরাস বিশ্বব্যাধিতে আক্রান্ত টুয়েন্টি টুয়েন্টিতে বুকি সংগঠন নাইস অড-এর দীর্ঘ তালিকায় নিচের দিকে একুশ নম্বরে লুইস গ্লিকের নামটি দেখেছি। এতে পেছন থেকে এসে আনএক্সপেক্টেড ডার্ক হর্স' বাজিমাত' করবে ভাবিনি, আমার ধারনা যারা তার ভীষণ ভক্ত তারাও ভাবেননি।
কেলেঙ্কারি থেকে উত্তরণে মরিয়া হয়ে ওঠা সুইডিশ একাডেমি নোবেল সাহিত্য পুরস্কার ২০২০ তাকেই পদান করল। তিনি কতোটা যোগ্য কতোটা বড় কবি - এসব আলোচনায় না গিয়ে এবারের নোবেলের এমন একটা প্রেক্ষাপট, নিউ ইয়র্ক টাইমসের সাথে পুরস্কার ঘোষণা পরবর্তী গ্লিক সাক্ষাৎকার এবং তার কিছু কবিতার অনুবাদ উপস্থাপন করা হলো। সঙ্গে নতুন নোবেল লরিয়েটের জন্য অভিনন্দন।
আরো একজন ইহুদির বরমাল্য
গণমাধ্যমে এতোটাই ইহুদি আধিপত্য যে লুইস গ্লিকের কবিতার জন্য নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তিকে একজন কবি ও একজন নারীর বিজয় হিসেবে চিহ্নিত করলে যতটা শোভন হতো ততোটা হয়ে উঠেনি কারণ বেশ কটি গণমাধ্যম এ প্রাপ্তিকে ইহুদি কবির বিজয় হিসেবে চিহ্নিত করেছে যদিও লুইস গ্লিক নিজে তার ধর্মীয় পরিচিত নিয়ে কখনো মাতামাতি করেননি, এমনকি নারী হিসেবে নিজেকে জায়োনিষ্ট গোত্রভুক্ত করতেও আগ্রহী হননি।
কোনো সন্দেহ নেই একই সঙ্গে যোগ্যতা ও ভূ-রাজনৈতিক এ অর্থনৈতিক কারণ ইহুদি মেধার প্রকাশ বেশ জাঁকালো হয়ে উঠেছে। নোবেল পুরস্কার প্রাপকের তালিকায় তাদের আধিপত্য লক্ষ্যণীয়। পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার শূণ্য দশমিক দুই শতাংশ হচ্ছে ইহুদি। ১৯০১ থেকে ২০২০ পর্যন্ত যারা নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন তাদের সংখ্যা ৯০০ ছাড়িয়ে গেছে, তাদের কমপক্ষে কুড়ি শতাংশই হচ্ছেন ইহুদি। এটাও অঙ্গীকার করা যাবে না। এমনকি পুরস্কৃত না হলেও। শ্রেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক, অর্থনীতিবিদ ও সাহিত্যিকদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ইহুদি বংশোদ্ভুত।
এ পর্যন্ত কতজন ইহুদি সাহিত্যিক নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন, তথ্য হিসেবে এটি কৌতুহলোদ্দীপ। তাদের মধ্যে দুই জনই ইসরায়েলি এবং অন্যরা আমেরিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশের নাগরিক। সাহিত্যে পুরস্কার প্রাপ্তদের তালিকাটি তাদের ভৌগলিক অবস্থান এবং আন্তর্জাতিক সাহিত্যে বিস্তৃতির ধারাটি প্রকাশ করে।
২০২০ লুইস গ্লিক (আমেরিকা)
২০১৬ বব ডিলান (আমেরিকা)
২০১৪ প্যাট্রিক মোদিয়ানো (ফ্রান্স)
২০০৫ হেরল্ড পিন্টার (ব্রিটেন)
২০০৪ এলফ্রিদ এলিনেক (অস্ট্রিয়া)
২০০২ ইমরে কার্তেজ (হাঙ্গেরি)
১৯৯১ নাদিন গর্দিমার (দক্ষিণ আফ্রিকা)
১৯৯৭ জোসেফ ব্রডস্কি (আমেরিকান)
১৯৮১ এলিয়াস কানেত্তি (ব্রিটেন)
১৯৭৮ আইজাক বাসোভিস সিঙ্গার (আমেরিকা-পোল্যান্ড)
১৯৭৬ সল বেলো (আমেরিকা)
১৯৬৬ নেলি ম্যাকস (জার্মানি)
১৯৬৬ স্যামুয়েল ইউসেফ অ্যাগনন (ইসরায়েল)
১৯৫৮ বরিস পাস্তেরনাক (রাশিয়া)
১৯২৭ অরি বার্গস (ফ্রান্স)
১৯১০ গল হেইসে (জার্মান)
ইহুদি হিসেবে সাহিত্যে ১৬তম নোবেল বিজয়ী, নারী হিসেবেও তিনি ১৬তম।
নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর সাথে লুইস গ্লিক
নোবেল সাহিত্য ঘোষিত হবার কয়েক ঘন্টার মধ্যে নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর আলেকজান্দ্রা অল্টা সাক্ষাৎকার দিতে রাজি করান গ্লিককে। করোনাভাইরাস বিশ্বব্যাধি অনেকদিন ধরে তাকে প্রায় গৃহবন্দী করে রেখেছে। আমাদের ঢাকা সময়ে নোবেল পুরস্কার পাবার মতো একটি ঘটনা তার জীবনে ঘটবে তা তিনি ভাবেননি। এটা ছিল লুইস গ্লিকের ভাষায় 'এক্সট্রিমলি আনলাইকলি'।
আলেকজান্দ্রা অল্টার: খবরটা প্রথম কিভাবে শুনলেন?
লুইস গ্লিক: সকাল সোয়া সাতটার দিকে একটা ফোন পাই। আমি কেবল ঘুম থেকে উঠেছি। নিজের পরিচয় দিয়ে একজন বললেন তিনি সুইডিশ একাডেমির সেক্রেটারি, বললেন, 'আমি জানাতে চাচ্ছি যে আপনি নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন।' আমি কি বলেছি মনে নেই, তবে এ নিয়ে কিছু সন্দেহ ছিল। আমার মনে হয় আমি অপ্রস্তুত ছিলাম।
আলেকজান্দ্রা: ব্যাপারটাকে সত্যি মেনে নিয়ে যখন হজম করলেন তখন কেমন অনুভূতি হল?
লুইস: পুরোপুরি হতবুদ্ধি হয়ে গেছি তারা একজন সাদা আমেরিকান লিরিক কবিকে পছন্দ করেছে। যা ঘটছে এর কোনো মানে নাই। আমার বাড়ির সামনের রাস্তা এখন সাংবাদিকে পরিপূর্ণ। মানুষ বলতে শুরু করেছে আমি কতো বিনয়ী। আমি বিনয়ী নই। বরং মনে করেছি আমি এমন দেশের মানুষ যে দেশকে মানুষ এখন প্রিয় চোখে দেখে না, আমি সাদা, আমাদের হাতে সব পুরস্কার এসেছে। এরকম একটি বিশেষ ঘটনা আমার জীবনে মোকাবেলা করতে হবে তার আদৌ কোনো সম্ভাবনা ছিল বলে আমি মনে করিনি।
আলেকজান্দ্রা : বিশ্বব্যাধির এই তীব্র অনুভূতির বিচ্ছিন্ন করা মাসগুলোতে জীবনটা কেমন ছিল?
লুইস : আমি বিক্ষিপ্তভাবে লিখে যাই, এটা খুব ধরাবাধা শৃঙ্খলাবদ্ধ ব্যাপার নয়। চার বছর ধরে আমি একটি বইয়ের উপর কাজ করছি, তা আমাকে বেশ যাতনা দিচ্ছিল। গত জুলাই এবং আগস্টে আমি অপ্রত্যাশিতভাবে কিছু কবিতা লিখে ফেলি এবং হঠাৎ বুঝতে পারলাম এবার পাণ্ডুলিপি গুছিয়ে শেষ করে আনতে পারব। এটা বিস্ময়কর। পুরস্কারের উচ্ছাস ও স্বস্তির সাথে সমঝোতা করতে হয়েছে, করোনার এই সময়ে নিত্যদিনের ভীতি ও প্রাত্যহিক জীবনের প্রয়োজনীয় সীমাবদ্ধতার সাথেও লড়াই করতে হয়েছে।
আলেকজান্দ্রা : আর নতুন কবিতা সংকলন?
লুইস : বিচ্ছিন্ন ও টুকরো টুকরো হওয়া - এই বইয়ে জোকের ছড়াছড়ি, অনেক কমেডিও আছে, কবিতাগুলো খুব ভীষণ পরাবাস্তব। আমি যখন থেকে লিখতে শিখেছি, তখন থেকে মৃত্যু নিয়ে লিখছি। আক্ষরিক অর্থেই আমার বয়স যখন ১০ বছর আমি মৃত্যুর কথা লিখেছিলাম। হ্যাঁ, আমি বেশ প্রাণবন্ত মেয়ে ছিলাম। বয়োবৃদ্ধ হবার ব্যাপারটা বেশ জটিল। ঘটনা কেবল এটুকুই নয় যে আপনি মৃত্যুর কাছে চলে এসেছেন - অপনি যে সব গুণাগুণের উপর নির্ভর করতেন শরীরের সৌন্দর্য, শক্তি, মনের তৎপরতা সবগুলোর সাথে আপনাকে সমঝোতা করতে হচ্ছে। এ বিষয় নিয়ে ভাবা ও লেখা আমার জন্য কৌতুহলোদ্দীপন হয়ে উঠেছে।
আলেকজান্দ্রা : আপনার অনেক কাজে ধ্রুপদী পুরান থেকে নিয়ে পৌরনিক ধাঁচকে আরো আন্তরি, পারিবারিক বন্ধন ও সম্পর্কের মধ্যে বর্ণনা করেছেন। এসব পৌরানিক চরিত্র আপনাকে কেনো টানে?
লুইস : প্রতিদিন যিনি লিখেন, বিষয় ও রসদ জোগাড় করেন প্রাচীনতম স্মৃতি থেকে - যা শৈশবে আপনাকে বদলে দিয়েছিল, স্পর্শ করেছিল কিংবা শিহরিত করেছিল। আমার দূরদৃষ্টি সম্পন্ন বাবা মা আমার শৈশবে গ্রিক উপকথা পড়ে শোনাতেন আর আমি নিজে যখন পড়তে শিখি সেই পাঠের ধারাটা অব্যহত রাখি। গ্রিক ঈশ্বর ও বীরদের অবয়ব লং আইল্যান্ডের যে ব্লকে আমরা থাকতাম সেখানকার শিশুদের চেয়ে আমার মনে বেশি স্পষ্ট হয়ে আছে। এটা এমন নয় যে আমার লেখাতে বিদ্যার প্রলেপ লাগাতে পরবর্তী জীবনের পড়াশোনা থেকে এসব টেনে এনেছি। এগুলো সব ছিল আমার ঘুম পাড়ানিয়া বইয়ের গল্পে। কিছু কিছু গল্প যেমন বিশেষ করে, পার্সিফোনের কাহিনী সারা জীবনই আমার মধ্যে প্রতিধ্বনিত হয়ে আসছে এবং গত পঞ্চাশ ধরে তাকে নিয়ে লিখে আসছি। আমি মনে করি পুরানের পার্সিফোনের এই বিশেষ উপকথাটি আমাকে সংগ্রামের নতুন একটি ধারায় তুলে নিয়েছে। আমি এটা বোঝাতে চাচ্ছি না যে এটা আমার দৈনন্দিন জীবনে কাজে লেগেছে।
আর যখন আমি লিখতে বসেছি আমার মায়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ না তুলে দিমিতারের বিরুদ্ধে তা করেছি।
আলেকজান্দ্রা : কেউ কেউ আপনার কাজ সিলভিয়া প্লাথের সাথে তুলনা করেছেন আর আপনার কবিতাকে বলেছেন স্বীকারোক্তিমূলক ও অন্তরঙ্গ কবিতা। আপনার কাজে কতদূর নিজের অভিজ্ঞতা আর কতটুকু বৈশ্বিক কিংবা মানবিক থিম থেকে নেওয়া?
লুইস : আপনাকে সবসময় আপনার অভিজ্ঞতা থেকে তুলে নিতে হয়, কারণ এটা আপনার জীবনের উপাদান, যার শুরুটা শৈশবে। তবে আমি সনাতন অভিজ্ঞতার অনুসন্ধান করি, আমি ধরেই নেই আমার সংগ্রাম ও আনন্দ অনবদ্য কিচ্ছু নয়। তাদের সাথে আপনার অভিজ্ঞতা মেলালে বুঝতে পারবেন তারা তাদেরটাকেই অনবদ্য বলে মনে করছে। আমার উপর বা আমার বিশেষ ধরনের জীবনের উপর আলো পড়ুক তাতে আমার আগ্রহ নেই বরং অন্য মানুষের সংগ্রাম ও আনন্দ, যারা জন্মগ্রহণ করেছে, বিদায় নিতে বাধ্য হচ্ছে, আমার আগ্রহ তাদের নিয়ে - আমি মরণশীলতা নিয়ে লিখি, কারণ শৈশবেই আমি আবিষ্কার করেছি এ জীবনটা চিরদিনের জন্য নয়।
আলেকজান্দ্রা : আপনার লেখালেখির জীবন কবিতার বিভিন্ন কাঠামো নিয়ে আপনি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন - যদিও আপনার স্বর বরাবর স্পষ্ট ও আলাদাভাবে চিহ্নিত করার মতো রয়ে গেছে। বিভিন্ন ধরনের কাঠামোতে নিরীক্ষার জন্য নিজেকে ঠেলে দেবার এই চেষ্টাটি স্বেচ্ছায় সচেতনভাবে করা?
লুইস : হ্যাঁ বরাবরই। আপনি লিখেছেন একজন অভিযাত্রী হবার জন্য। আমাকে এমন কোনো জায়গায় নিয়ে যাওয়া হোক - সেখানকার কোনো জ্ঞানই আমার নেই। আমি এমন একটি রাজত্বে আগন্তুক হতে চাই। বার্ধক্য সম্পর্কে বলার মতো কয়েকটি ভালো কথা আছে - আপনি নতুন অভিজ্ঞতা লাভ করছেন। নিঃশেষ হয়ে যাওয়াটা কারো সবচেয়ে প্রত্যাশিত আনন্দ নয়। কিন্তু এ পরিস্থিতিতেও ভিন্ন খবর থাকে - আর তা একজন কবি বা লেখকের জন্য অমূল্য। আমি মনে করি আপনাকে সবসময়ই বিক্ষিপ্ত হতে হবে - হতে হবে একেবারে শিশুর মতো - নতুবা একঘেয়েমিতে আমার কান্না এসে যেত। আর কখনো এমন সময় আসে - আমি ভাবি - ঐ কবিতাটি তুমি লিখেছ? বেশ সুন্দর কবিতা তো, কিন্তু এ কবিতাটিতো লেখা হয়ে গেছে।
আলেকজান্দ্রা : কবি হিসেবে নতুন রাজত্বের অনুসন্ধানে বেড়ে যাওয়া বয়স আপনাকে কিভাবে পরিচালনা করেছে বলে মনে করেন?
লুইস : আপনি বুঝতে পারছেন একটি 'বিশেষ্য' এখানে কিংবা ওখানে হারিয়ে গেছে, আপনার বাক্যের মাঝখানে বড় একটি গহ্বর রয়ে যাচ্ছে, সে ক্ষেত্রে আপনি বাক্যটিকে পুনর্গঠন করবেন। কিংবা পরিত্যাগ করবেন। কিন্তু বলার বিষয়টি হচ্ছে এখন যা ঘটেছে আগে তো তা ঘটেনি। যদিও এটা ভয়ানক, অসুখিকর এবং অসুস্থতার তবুও শিল্পীর প্রেক্ষাপট থেকে তা নতুন ও উত্তেজনাপূর্ণ।
আলেকজান্দ্রা : আপনার লেখার শৈলী বর্ণনায় বলা হয় তা 'ছেড়ে দেওয়া ও ছেটে ফেলা' ধরনের। আপনি যখন লিখেন এসবই কি আপনার কাছে স্বাভাবিকভাবে আসে? নাকি আপনি গড়ে তোলেন, ঘষেমেজে মসৃণ করেন?
লুইস : কখনো কখনো ছেটে ফেলি, কখনো কথোপকথনের ধরনে লিখি - আপনি তো স্বর নিয়ে কাজ করেন না। বাক্য নিজেই তার কথা বলার পন্থা খুঁজে নেয়। এটা ডেলফির বাণীর মতো বোঝায়। স্বর আলোচনার জন্য একটি কঠিন বিষয়। আমার মনে হয় বাক্যের গঠনের প্রতি আমার মোহগ্রস্ততা রয়েছে সব সময় এর শক্তি অনুভব করেছি। যে সব কবিতা আমাকে সবচেয়ে বেশি নাড়া দিয়েছে সেগুলো পড়ে শোনানোর প্রশ্নে সবচেয়ে ঐশ্বর্যশালী নয়। উইলিয়াম ব্লেক ও জন মিল্টনের মতো কবি রয়েছেন বাক্য গঠন বিষ্ময়কর, যেভাবে কবিতায় জোর দিতে হবে সেভাবেই প্রণয়ন করা।
আলেকজান্দ্রা : আপনি ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান। আপনার নিজের লেখা নিয়ে এগোতে যে সমস্যার মুখোমুখি হয়েছেন শিক্ষকতা তা উৎরে যেতে সাহায্য করেছে বলে আপনি উল্লেখ করেছেন। লেখক হিসেবে শিক্ষকতা কিভাবে আপনার সহায়ক হয়েছে?
লুইস : আপনি সর্বক্ষণই অপ্রত্যাশিত ও নতুনের মধ্যে অবস্থান করছেন। আপনাকে আপনার ভাবধারা পুনর্বিন্যস্ত করতে হয়, যাতে তা শিক্ষার্থীদের টেনে নেয় এবং তাদের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি করে। আমার ছাত্রছাত্রীরা আমাকে অবাক করে, আমাকে ঝলকে দেয়। যদিও আমি সবসময় লিখতে পারি না। আমি বরাবরই অন্যের লেখা পড়তে পারি।
ঘোড়া
ঘোড়া আমাকে কি দেয়
যা আমি তোমাকে দিতে পারি না?
তুমি যখন একা ঘোড়ায় চড়ে
খামারের পেছন দিক দিয়ে যাও
আমি তোমাকে দেখতে থাকি
তোমার হাত ঘোটকীর ঘন কালো
কেশরের মধ্যে সমাহিত থাকে।
তখন আমি জানি, তোমার নীরবতার পেছনের কারণটা কি।
বিদ্বেষ আমার ও বিয়ের উপর তোমার ঘৃণা; তবুও
তুমি চাও আমি তোমাকে স্পর্শ করি তুমি
চিৎকার করে কেঁদে উঠো।
যেমন করে মন কাঁদে কিন্তু আমি যখন
তোমার দিকে তাকাই আমি দেখতে পাই
তোমার দেহে কোনো শিশু নেই।
তাহলে সেখানে কি আছে?
আমার মনে হয় কিছুই নেই, কেবল তাড়াহুড়ো আছে
যেন আমার আগে তুমি মরতে পার।
আমি স্বপ্নে দেখি তুমি ঘোড়ায় চেপে ছুটছো
শুকনো মাঠের উপর দিয়ে, তারপর নেমে পড়লে।
তোমরা ছুটিতে একমাসে হেঁটেছো
অন্ধকারে, তোমাদের কোনো ছায়া নেই
কিন্তু আমি আমি তাদের অনুভব করেছি
তারা আমার দিকে এগিয়ে আসছে।
যেহেতু রাতের বেলায় তারা কোথাও যায়
তারা নিজেরাই নিজেদের প্রভু
আমার দিকে তাকাও। তুমি মনে করো আমি বুঝি না?
কীসের এ জন্তু
যদি জীবন থেকে বের করে নিয়ে যেতে না পারে?
বিদেশ থেকে আসা পরিদর্শক ১
আমি যখন জীবনের সেই সময়টাতে প্রবেশ করলাম
যখন নিজের জন্য নয়,
মানুষ অন্যেকে প্রলুব্ধ করতে চেষ্টা করে
সেই সময়টা এসে যাবার কিছুকাল পরে
মধ্যরাতে টেলিফোন বাজতে থাকে।
টেলিফোন বেজেই চলে বেজেই চলে
যেন আমাকে পৃথিবীর খুব প্রয়োজন
যদিও আসলে ঠিক উল্টোটাই
আমি বিছানায় শুয়ে ফোনের শব্দ
বিশ্লেষণ করতে থাকি। এই শব্দে
আমার মায়ের এক গুঁয়েমি আর আমার বাবার
যন্ত্রণাদায়ক বিব্রতদশার বিবরণ রয়েছে।
যখন ফোনটা তুলতে যাই লাইন ডেড হয়ে গেছে
নাকি ফোন ঠিকই আছে, আমাকে যে ফোন করেছে
সেই মরে গেছে? অথবা এমনও হতে পারে
শব্দটা ফোনের ছিল না, দরজার সম্ভবত।
বিদেশ থেকে আসা পরিদর্শক ২
সম্ভবত সিড়িতে আমার মা ও বাবা
হিমেল ঠাণ্ডায় দাঁড়িয়ে আছে
আমার মা আমার দিকে তাকায়, তার কন্যা,
তার মতোই একজন নারী
তাই বলে, তুই তো আমাদের কথা কখনো ভাবিস না।
যখন স্বর্গে গিয়ে পৌঁছে, আমরা তোর বই পড়ি
আমাদের কথা তো কোথাও লিখিস না তেমন
তোর বোনের কথাও তো লিখতে পারতিস
তারা আমার মৃত বোনের দিকে ইঙ্গিত করে -
সম্পূর্ণ ভিন্ন এক আগন্তুক, আমার মায়ের হাত
তাকে শক্ত করে ধরে আছে।
মা বলল, আব্বা না হলে তোর অস্তিত্বই থাকত না
আর তোর বোন - তোর শরীরে তো তারই আত্মা।
তারপর তারা বিলীন হয়ে গেল
যেমন বিলীন হয়ে যায় যারা মরমন মিশনারী।
বিদেশ থেকে আসা পরিদর্শক ৩
রাস্তা আবার সাদা হয়ে গেছে
সবগুলো ভারী তুষারে ঢাকা পড়ে আছে
বরফের মাচায় ঢুকে গাছগুলো চিকচিক করছে।
আমি অন্ধকারে শুয়ে থাকি - রাত শেষ হবার প্রতীক্ষায়
আমার মনে হয়েছে আমার জানা দীর্ঘতম রাত এটি
যে রাতে আমি জন্মগ্রহণ করেছিলাম
তার চেয়েও দীর্ঘ এ রাত।
আমি সব সময়ই তোমার কথা লিখি,
আমি জোর দিয়েই বলি। যতবার আমি
বলি 'আমি,' তার মানে তুমি।
বিদেশ থেকে আসা পরিদর্শক ৪
বাইরে রাস্তা নিঝুম
চাদরের ঝুলে থাকা অংশে পেঁচিয়ে আছে
ফোনের রিসিভার, এর বিরক্তিকর ধুকপুক শব্দ
থেমে গেছে কয়েক ঘন্টা আগে।
যেমন ছিল আমি তেমনই রেখে দিই
এর লম্বা তার আসবাবপত্রের নিচ দিয়ে গেছে
আমি তুষারপাত দেখলাম
তেমন অস্পষ্ট কিছু নয়
যে যেমন আছে তার চেয়ে বড় করে দেখতে হবে।
রাতের মধ্যভাগে কে ফোন দেবে?
সমস্যা ফোন দিতে পারে
হতাশা ফোন দিতে পারে
আমার ইচ্ছে শিশুর মতো ঘুমোনো।